১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৮:৫৮

জেরুসালেম সম্পর্কে ট্রাম্পের ঘোষণা : ইসরাইল জেরুসালেমের নেপথ্য কাহিনী

গত ৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমগ্র জেরুসালেম নগরীকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং মার্কিনী দূতাবাস ইসরাইলের বর্তমান রাজধানী তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সুখের বিষয়, মার্কিনী সিদ্ধান্তে এখন পর্যন্ত, অর্থাৎ আজ ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত একমাত্র ইসরাইল ছাড়া আর কেউই সমর্থন জানায়নি। এমনকি যারা আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত সেই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি কোনো দেশই এই ১০ দিন পর্যন্ত মার্কিন সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানায়নি, এমনকি ইসরাইলের মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৫/২৬ টি দেশের একটিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানায়নি। অন্যদিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি রাশিয়া এবং উদীয়মান পরাশক্তি গণচীনও জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বিশ্বের বৃহত্তম শক্তিগুলোর মধ্যে ইন্ডিয়া এখনো দোদুল্যমান। তারা আমেরিকারও বন্ধু, আবার ইসরাইলেরও বন্ধু। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে ভারত শেষ পর্যন্ত মার্কিন সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেবে না। কারণ তারা ইসরাইলের জন্য অথবা শুধুমাত্র আমেরিকার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায় এবং মুসলিম জাহান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।
চিত্রের অপর পিঠ বেশ আশাব্যঞ্জক। ওআইসিভুক্ত ৫৭ টি মসলিম দেশ অর্থাৎ মুসলিম জাহান মার্কিনী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পাল্টা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ওআইসি ভুক্ত দেশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে জেরুসালেলমের পূর্বাংশ, যেটি পূর্ব জেরুসালেলম নামে পরিচিত, সেটি হবে ফিলিস্তিনের রাজধানী। সুখের বিষয়, আরব জাহানে মার্কিন পন্থী বলে পরিচিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশও ওআইসির এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। দেশ তিনটি হলো সৌদি আরব, মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। সবচেয়ে খুশির বিষয় হলো এই যে আমেরকিার সমগ্র জনগোষ্ঠিও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানায়নি। আমেরিকার বেশ কয়েকটি শহরে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। ট্রাম্প তো নিজেই বলেছেন যে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন, প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ, প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ এবং প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু তারা সাহস পাননি। তিনি সাহস করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভুল বলেছেন। তার পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট গণ সাহসের অভাবে তার মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন নাই, একথা ঠিক নয়। প্রকৃত ঘটনা এই যে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তারা কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেন যে সমগ্র জেরুসালেলমকে ইসরাইলের রাজধানী করা সম্ভব নয়। সেটি বিশ্ব সম্প্রদায় তথা জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের পরিপন্থী হবে। তারা দেখেন যে ইসরাইলকে খুব বেশি ফেভার করলে বড় জোর পশ্চিম জেরুসালেলমকে তাদের রাজধানী করা যায়। তাই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন সেটি তার একক সিদ্ধান্ত। কেউ কেউ একথাও বলছেন যে মি. ট্রাম্প রাজনীতির কিছুই বোঝেন না। রাজনীতির ব্যাপারে তার এই সিদ্ধান্ত একজন বিকারগ্রস্থ মানুষের সিদ্ধান্ত। কারণ ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিনও ছিল এবং জেরুসালেলমও ছিল। তখন সেখানে বংশ পরম্পরায় বাস করতেন প্রধানত ফিলিস্তিনি মুসলমান এবং ফিলিস্তিনি খৃষ্টান। ইহুদীরা কোনদিনও সেখানকার বাসিন্দা ছিল না। ১৯৩০ সালের পর ইহুদীদেরকে ফিলিস্তিনে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে রফতানী করা শুরু হয়। এভাবে ফিলিস্তিনে ধীরে ধীরে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারপরেও তারা মুসলমান এবং খৃষ্টান জনসংখ্যার তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম থাকে।

১৯৪৮ সালে যারা বিদেশ থেকে এসে ফিলিস্তিনে বসত গাড়ে তাদের তরফ থেকে বেনগুরিয়ন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। (এ সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ এই কলামের পরবর্তী অধ্যায়ে পড়–ন)। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরাইল শুধুমাত্র পশ্চিম জেরুসালেলম দখল করে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুসালেলমও দখল করে। কিন্তু জাতিসংঘ ইসরাইলের জেরুসালেলম দখলকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং জেরুসালেলমকে আন্তর্জাতিক শহরের মর্যাদা দেয়। ১৯৮০ সালে ইসরাইল সমগ্র জেরুসালেলমকে তাদের রাজধানী ঘোষণা করে। কিন্তু জাতিসংঘ এই ঘোষণাকেও অবৈধ বলে আখ্যায়িত করে। ৩৭ বছর পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরাইলের এই ঘোষণাকেই দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দিলেন। সুতরাং সেটিও অবৈধ। এ ব্যাপারে একটি পরিস্কার ধারণা পেতে গেলে আমাদেরকে ১৯৪৮ সালে ফিরে যেতে হবে।
॥দুই॥
১৯৪৮ সালের ১৪ই নভেম্বর ডেভিড বেন্গুরিয়ন ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরদিন ১৫ই নভেম্বর এই স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি ও অনুমোদন দেয়ার জন্যে তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকো জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান। আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং সোভিয়েট ইউনিয়ন সহ ৩৩টি দেশ ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণাকে স্বীকৃতি দেয়। ১৩ টি দেশ এর বিরোধিতা করে। এই ১৩ টি দেশই ছিল মুসলিম দেশ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে’র পূর্বে পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে বাস করার মত ইসরাইলের কোন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ছিল না।

ইহুদি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা যদি কাউকে বলা যায় তাহলে তিনি হলেন ইহুদী লেখক ও সাংবাদিক থিওডোর হাজল। তার রচিত গ্রন্থ ‘দার জুদেনসতাত’ বা ইহুদী রাষ্ট্র। এই গ্রন্থে তিনি ইহুদী রাষ্ট্রের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরপর সুইজারল্যান্ডের বাসেল নামক স্থানে ইহুদীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে বিশ্ব ইহুদী সম্মেলন বা ওয়ার্ল্ড জায়নিস্ট অর্গানাইজেশন গঠিত হয়। সেই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে প্রস্তাবিত ইহুদী রাষ্ট্রটি গঠিত হবে ফিলিস্তিনে। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষ করে ইউরোপ থেকে ইহুদীগণকে ইমিগ্রান্ট হিসেবে দলে দলে ফিলিস্তিনে পাঠানো হয়। ১৯০৩ সাল নাগাদ ইহুদীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ হাজারে। ১৯১৭ সাল নাগাদ ইহুদীদের সংখ্যা দাাঁড়ায় ৫৬ হাজার। তখন মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৫ লক্ষ ৭০ হাজার।
ওপরের এই আলোচনা থেকে দেখা যায় যে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তুতি হিসেবে ইহুদীদের প্রধান কাজ ছিল সেখানে ইহুদী বসতি স্থাপন করা। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে ১৯৩০ সালের মধ্যে তারা ফিলিস্তিনে রপ্তানী করে মোট ৮২ হাজার ইহুদী। নিজ ভূমে বিদেশীদের এই বিপুল অনুপ্রেবেশের ফলে ফিলিস্তিনে আরবদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ দানা বাধতে থাকে। ১৯২৯ সালে আরব ও ইহুদীদের মধ্যে সংঘর্ষে ১৩৩ ব্যক্তি মারা যায়। বৃটিশ পুলিশ ইহুদীদের পক্ষ অবলম্বন করে। বৃটিশ পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ১১০ জন ফিলিস্তিনী। ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী লর্ড পিলের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে ভাগ করার সুপারিশ করে। এক ভাগে ইসরাইল ও অপর ভাগে ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনিরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ফিলিস্তিনে ইহুদী অভিবাসন বন্ধ করার জন্য বৃটিশ সরকারের নিকট দাবি জানান।

কিন্তু অভিবাসন বন্ধ হয় না। ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ জাতিসংঘের নিকট হস্তান্তরিত হয়। ততোদিনে ইহুদীদের সংখ্যা ৫৬ হাজার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৮ হাজারে। অর্থাৎ প্রায় ১০ গুন। পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৭ লাখ থেকে ১১ লাখ ৩২ হাজারে। অর্থাৎ ইহুদীদের বৃদ্ধি যেখানে ১০ গুন সেখানে আরবদের বৃদ্ধি ২ গুনেরও কম। আরব ইসরাইল বিরোধ বা ফিলিস্তিন ইসরাইল বিরোধের মূল কারণ এটাই। রাশিয়া ও ইউরোপ থেকে ইহুদীরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ফিলিস্তিনে। আর ফিলিস্তিনিরা ধীরে ধীরে নিজ ঘরে হয়েছেন পরবাসী। দখলদারদের জুলুম নির্যাতনে লাখ লাখ ফিলিস্তিনী তাদের স্বদেশ ভূমি থেকে হয়েছেন মোহাজির। চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন প্রতিবেশী আরব দেশগুলোতে।

ফিলিস্তিন বিভক্তির পরিকল্পনাঃ ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব করে। এক ভাগে ইহুদী রাষ্ট্র, অপর ভাগে আরব রাষ্ট্র। জেরুসালেলমকে আন্তর্জাতিক নগরী করার প্রস্তাব করা হয়। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত এই প্রস্তাবের নম্বর হলে ১৮১। ফিলিস্তিনের এই পার্টিশন প্রস্তাবের সারমর্ম নি¤œরূপ:
(১) জেরুসালেলম ছাড়া বৃটেনের ম্যান্ডেট ভূক্ত ফিলিস্তিনের ৫৬.৪৭ শতাংশ নিয়ে গঠিত হবে একটি ইহুদী রাষ্ট্র। (২) অবশিষ্ট ৪৩.৫৩ শতাংশ নিয়ে গঠিত হবে একটি আরব রাষ্ট্র। (৩) জেরুসালেলমের শাসনভার পড়বে একটি আন্তার্জাতিক ট্রাস্টি বোর্ডের ওপর। (৪) বৃটিশ সৈন্য চলে যাওয়ার পর দেশটির শাসনভার গ্রহণ করবে ৫টি দেশ সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিশন। এই কমিশনের সদস্য হবে পানামা, চেকোস্লোভাকিয়া, ডেনমার্ক, বলিভিয়া ও ফিলিপাইন। এই কমিশন আরব ও ইহুদী উভয় রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ করবে। (৬) এই দুটি রাষ্ট্রে গঠিত হবে দুটি অন্তবর্তী সরকার। তারা কমিশনের নিকট থেকে ধীরে ধীরে ক্ষমতা বুঝে নেবে। অতঃপর উভয় দেশে দুই মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ দুটিতে দুটি গণ পরিষদ গঠিত হবে।
ইহুদিরা ফিলিস্তিনের এই পার্টিশন প্রস্তাব মেনে নেয়। কারণ বিগত ৪০ বছর ধরে তারা যে পরিকল্পনা করেছিল সেই পরিকল্পনারই বাস্তবরূপ হলো এই পার্টিশন প্ল্যান। পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনীরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। ফিলিস্তিনীরা তো প্রত্যাখান করবেই। কারণ তাদের পিতৃভূমির ওপর ছুরি চালাচ্ছে এই প্রস্তাব। ফিলিস্তিনকে দুই টুকরা করে ছোট টুকরা দিতে চাচ্ছে ফিলিস্তিনীদেরকে।

॥তিন॥
ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণাঃ ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর ডেভিড বেন গুরিয়ন ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আমেরিকা, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ইংল্যান্ড সহ অনেকগুলো দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হল এই যে নবগঠিত ইসরাইলের কোন আন্তর্জাতিক সীমানা ছিল না। ছিলনা কোন সুনির্দিষ্টন জনগোষ্ঠি। ছিলনা কোনো সরকার। ছিল না কোনো সার্বভৌমত্ব। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হতে গেলে যেসব পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয় তার একটিও ইসরাইল পূরণ করতে পারেনি। তবুও অন্যায়ভাবে গায়ের জোরে পরাশক্তিগুলো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে থেকে ইসরাইলের স্বাধীনতা কার্যকর হয়। ১৫ই মে কে ফিলিস্তিনীর ‘আল-নাকবা’ বা বিপর্যয়ের দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই সময় ফিলিস্তিনীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ৯২ শতাংশ ভূ-খন্ড। জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশেরও বেশী ছিলেন ফিলিস্তিনী।
১৯৪৮ সালে প্রথম যুদ্ধঃ ফিলিস্তিনের বিভক্তি ঠেকানোর জন্য ১৫ মে ৫টি আরব রাষ্ট্রের সমর্থনে ফিলিস্তিনীরা ইসরাইলে অভিযান চালায়। এই ৫টি আরব রাষ্ট্র হলো ইরাক, মিশর, সিরিয়া, জর্ডান এবং লেবানন। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ইসরাইলকে সাগরের দিকে ঠেলে দেয়া এবং ফিলিস্তিনের ভিভক্তি ঠেকানো। একই সময় মেনাচিম বেগিনের নেতৃত্বাধীন (পরবর্তীকালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী) ইহুদীবাদি সন্ত্রাসী সংগঠন ‘ইরগুন জাভাই লিউমী’ জেরুসালেলমের নিকটবর্তী ‘ডার ইয়াসিন’ গ্রামে এক বর্বর হামলা চালিয়ে ১৫৪ জন অরবকে হত্যা করে। এই ঘটনায় সন্ত্রস্থ হয়ে ফিলিস্তিনীরা তাদের আবাসভূমি ত্যাগ করতে শুরু করে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনী লেবানন, মিশর ও বর্তমানে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর বলে পরিচিত স্থানে পালিয়ে যায়। ইহুদী বাহিনী নেগেভ, গালিলি, পশ্চিম জেরুসালেলম ও উপকূলীয় সমতল ভূমির অনেকটা দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে ইসরাইল ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ ভূখন্ড দখল করে। অবশিষ্ট এলাকা অর্থাৎ গাজা উপত্যকা মিশরের দখলে এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেলম জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এই যুদ্ধ শেষে সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তু হয়ে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোতে চলে যান। পক্ষান্তরে ইউরোপ ও রাশিয়া থেকে ৯ লাখ ইহুদীকে ফিলিস্তিনে আমদানী করা হয়। এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরেও কোনো আরব বা মুসলিম রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি।

॥চার॥
তৃতীয় আরব ইসরাইল যুদ্ধঃ ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পিএলও বা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অগানাইজেশন। নেতা ইয়াসির আরাফাত। পিএলওর মূল বক্তব্য ছিল, ফিলিস্তিন অবিভাজ্য। এটি তাদের মাতৃভূমি। নিয়মিত যুদ্ধে আরবরা বার বার পরাস্ত হওয়ায় পিএলও গেরিলা যুদ্ধের পথ অনুসরণ করে। ঐদিকে কতিপয় আরবদেশ ইসরাইল আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। তখন ইসরাইল ঝটিকা হামলা চালায়। এটাই ৬ দিনের আরব ইসরাইলী যুদ্ধ নামে সারা বিশ্বে পরিচিত। ১৯৬৭ সালের ৫ জুন থেকে ১১ই জুন পর্যন্ত সংঘঠিত এই যুদ্ধে ইসরাইল নি¤েœাক্ত এলাকা সমূহ দখল করে:
(১) মিশরের নিকট থেকে গাজা ও সিনাই এলাকা। (২) সিরিয়ার নিকট থেকে গোলান মালভূমি। (৩) জর্ডানের নিকট থেকে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর। (৪) পূর্ব জেরুসালেলম এবং ওল্ড সিটি বা প্রাচীন নগরী। দুঃখের বিষয় হলো, একটি অপ্রীতিকর সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে সমগ্র জাহানের বিরুদ্ধে ইসরাইল সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি।

১৯৭৩ ইয়ম কিপুর: চতুর্থ আরব ইসরাইল যুদ্ধঃ এ বছরের প্রায়শ্চিত্ত দিবসে (এই দিনকে বলা হয় ইয়ম কিপুর) মিশর ও সিরিয়া ইসরাইলের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। তিন সপ্তাহ ব্যাপী পরিচালিত এই যুদ্ধে ইসরাইল প্রথমে কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও যুদ্ধ শেষে ইসরাইলের বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৬৭ সালে যে যুদ্ধ বিরতি রেখা প্রতিষ্ঠিত হয় সেই রেখা ছাড়িয়েও ইসরাইল আরো এলাকা দখল করে। গোলান মালভূমি অতিক্রম করে ইসরাইল সিরিয়ার আরো অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। মিশরেও তারা ঢুকে পড়ে এবং সুয়েজ খাল পর্যন্ত এগিয়ে যায়। এই যুদ্ধে মিশরের মোট সাড়ে ৮ হাজার এবং ইসরাইলের ৬ হাজার সৈন্য প্রাণ হারায়। এই যুদ্ধের এক উল্লেখযোগ্য দিক হলো এই যে, এবারই প্রথম সৌদী আরব জ্বালানী তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। ইয়ম কিপুর যুদ্ধে যেসব দেশ ইসরাইলকে সমর্থন করেছিল তাদের ওপর সৌদী আরব তেল অবরোধ আরোপ করে। ফলে বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য অনেক বেড়ে যায়। এসব দেশের তহবিলে বিপুল অংকের আন্তার্জাতিক মুদ্রা অর্থাৎ ডলার জমতে থাকে। এসব কারণে অবরোধকে বলা হয় ‘তৈলাস্ত্র’, তেলকে বলা হয় ‘তরল সোনা’ এবং ডলার অর্জনে সক্ষম বলে তেলের আরেক নাম হয় ‘পেট্রো ডলার’।

আরব জাহানে ভাঙ্গনঃ মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত অকস্মাৎ ইসরাইলে যান এবং ইসরাইলী পার্লামেন্টে ভাষণ দেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও মিশরের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করা হয়। ১৯৮০ সালে ইসরাইল ঐক্যবদ্ধ জেরুসালেলমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করে। ১৯৮১ সালে গোলান মালভূমিকে ইসরাইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ এর মধ্যে মিশরের কাছে সিনাই ফেরৎ দেওয়া হয়।

মানব ইতিহাসে যদি কোনো গোষ্ঠির ওপর জুলুম হয়ে থাকে তাহলে সেটা হয়েছে ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে, যার নজির সমকালীন ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। ইসরাইলী দখল দারিত্বের পর থেকে অন্তত ৪০ লক্ষ ফিলিস্তিনীকে নিজ ঘর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। ৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধের পর অন্তত ১১ লক্ষ ইহুদীকে ফিলিস্তিনে আমদানী করা হয়েছে। মসজিদুল হারাম শরীফে ইহুদীরা অনেকবার হামলা করে এবং ১৯৬৯ সালে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রথম ইন্তিফাদায় ১৫৪৯ জন ফিলিস্তিনী শহীদ হয়েছেন। ইসরাইলের পক্ষে নিহত হয়েছে ৪২১ জন। দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় পশ্চিম তীর ও গাজায় শহীদ হয়েছেন ৩ হজার ১৯৬ জন। ইসরাইলের পক্ষে নিহত হয়েছে ১ হাজার ৯৪৬ জন।

আজ থেকে ৭০ বছর আগে ইসরাইলের অবাঞ্ছিত জন্ম হয়। ৬০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু স্বাধীন ফিলিস্তিনির দেখা নাই। কিন্তু ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস আরো দীর্ঘ। সেটি শুরু হয়েছে ১৯২০ সাল থেকে। ফিলিস্তিনী প্রথম গণআন্দোলন শুরু হয় ১৯৩০ সালে। তারপর ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত। এখন চলছে তৃতীয় ইন্তিফাদা। ৯৭ বছর ধরে চলছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম। কিন্তু আজও স্বাধীনতার সূর্য উঁকি দেয় নাই। তবে এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের একটি ইতিবাচক দিক হলো এই যে, প্রেসিডেন্ট নাসের এবং ইয়াসির আরাফাত যে সংগ্রামকে সেক্যুলার কালার দিয়েছিলেন আজ হামাস, আল আকস্ াব্রিগেড ইসলামিক জিহাদ প্রভৃতি সংগঠন সেই সংগ্রামকে লক্ষের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/311433