১৬ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:৪৮

ব্যাংক খাতে ঝুঁকি বাড়ছে

দেশের ব্যাংক খাত চরম অস্থিরতায় ভুগছে। রাষ্ট্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যাংকের মালিক হওয়ায় এ সমস্যা আরো বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তাদের সমীহ করে চলে। কোনো ব্যবস্থা নিতে ভয় পায়। একটি প্রবাদবাক্য আছেÑ ‘আমার নৈতিকতা যখন দুর্বল থাকবে তখনই আমি অন্য কারো অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পাবো।’ এ কারণে বলতে হয়Ñ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নৈতিকভাবে শক্তিশালী না হলে আর্থিক খাতের দুর্নীতি কখনো দূর করা সম্ভব হবে না। কাগজে উঠেছেÑ ইসলামী ব্যাংকসহ আরো ৩০টি ব্যাংকের লভ্যাংশে ধস নেমেছে, খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ব্যাংক খাতে যেভাবে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে যা জনগণের কাছ থেকেই নেয়া হচ্ছে, তারপর জনগণকে সেবাও সঠিকভাবে দেয়া হয় না। ব্যাংক খাতে এক্সাইজ ডিউটি, লভ্যাংশের ওপর ১৫ শতাংশ কর্তন, চেকবই ও ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ নানা রকম আয়ের খাত তৈরি করা হয়েছে। এর পরও বছর শেষে জনগণকে ভালো একটা সুদ ও লভ্যাংশ দেয় না, উল্টো ব্যাংককে আরো দিতে হয়। প্রশ্ন হলোÑ জনগণের এসব টাকা কাদের পকেটে ঢুকছে, কোনো জবাবদিহিতা নেই কেন? দুর্নীতিবাজেরাই আমানতকারীর টাকা খেয়ে ফেলছে। ৭ নভেম্বর ২০১৭ পুঁজিবাজার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণের ওপর নতুন নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৬ নভেম্বর প্রকাশিত ‘কোড অব কন্ডাক্ট ফর ব্যাংকস অ্যান্ড নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন্স’ শীর্ষক এই নীতিমালা অনুযায়ী দেশে কার্যরত সব তফসিলি ব্যাংককে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নিজস্ব আচরণবিধি তৈরি করতে বলা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এ আচরণবিধি মেনে চলারও নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ নীতিমালায় বলা হয়েছে, পেশাগত সুবিধা আদায়ে রাজনৈতিক বা পর্ষদের প্রভাব খাটানো যাবে না, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের উপহার গ্রহণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ, কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন ছাড়া ব্যাংকের কোনো কর্মী অন্য কোনো ব্যবসায় বা কর্মে জড়াতে পারবেন নাÑ এমনকি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে কোনো ধরনের ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে পারবেন না ব্যাংকাররা।

সরকার প্রণীত জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ব্যাংক ও বহির্ভূত আর্থিক খাতে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোড অব কন্ডাক্ট ফর ব্যাংকস অ্যান্ড নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন জারি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সততা, নৈতিকতা, দক্ষতা ও দায়িত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হবে। এ নীতিমালায় এ কথা বলা হয়, ব্যাংকারদের পেশাগত পরিচয়ের অপব্যবহার বন্ধের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যাংকার অন্য কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কোনো উপহারসামগ্রী গ্রহণ করবেন না, যাতে তার নিজের পেশাগত দায় সৃষ্টি হয়। এমনকি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নিজ পরিবারের সদস্যদেরও এ ধরনের উপহার গ্রহণ করতে দেবেন না ব্যাংকার। ৬ নভেম্বর ২০১৭ জারি করা ওই নীতিমালায় প্রতিষ্ঠানের খরচে ব্যক্তিগত উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে বলা হয়েছে। ব্যক্তিগত সুবিধাসংশ্লিষ্ট কোনো ধরনের আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা প্রতিষ্ঠানকে এমন কোনো উপদেশ, পরামর্শ বা নির্দেশনা দেয়াও যাবে না, যা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি নিজস্ব ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাতে চান, সে ক্ষেত্রে তা অবশ্যই শুধু তাদের নিজ পরিবারের সদস্যদের দিয়ে পরিচালিত হতে হবে। নিজস্ব ছোট ব্যবসায় বিনিয়োগ করা সম্পদের পূর্ণ ঘোষণাসংবলিত তথ্য-উপাত্ত দিতে হবে। গ্রাহক তথ্যের ওপরেও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ১০ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে চট্টগ্রাম নগরীর মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেনÑ ব্যাংক থেকে সম্প্রতি হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রীও বলেছেন, দেশ থেকে যে টাকা পাচার হয়েছে তা দিয়ে দুটো বাজেট হতো। দুঃখজনক দশ টাকার দুর্নীতির জন্য পুলিশ কনস্টেবলকে গ্রেফতার করা হয়। কেরানিকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু আসল লুটেরাদের কিছুই হয় না।

বর্তমানে শুধু সরকারি ব্যাংকগুলো নয়, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপির জালে আটকে পড়েছে। ঋণ আদায় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ঋণ যারা নিচ্ছেনÑ এরা কারা। বেশির ভাগ লোকই হলো সরকারি দলের, এদের ঋণ দিতে হয় আপার লেভেলের লোকদের বিশেষ বিবেচনায়। ঋণ দেয়া হলো, কিন্তু সেই ঋণ কিস্তিভিত্তিক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও তা পরিশোধ করা হয় না। এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে লভ্যাংশের পরিমাণ আগের চেয়ে কমে গেছে। যারা ব্যাংকে টাকা আমানত রাখেন বিভিন্ন মেয়াদে, সেখানে দেখা যাচ্ছেÑ সর্বোচ্চ এক বছরে সুদ ও লভ্যাংশ দেয়া হচ্ছে ৪ থেকে ৬ শতাংশ হারে। এ দিকে, এই বছরেও আবার নতুন করে আরো দুই ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে এর আগেও ১০টি ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছিলÑ এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মালিকদের সাক্ষাতের জন্য তলব করেছিল। মালিক সরাসরি দলের একজন সাবেক মন্ত্রী। পত্রিকায় উঠেছে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের ডাকে সাড়া দেননি। ব্যাংকের মালিকেরা যেখানে দলের মন্ত্রী-এমপি, সেখানে জবাবদিহিতার শৈথিল্য বিদ্যমান থাকছে। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় জটিলতা ক্রমেই বাড়ছে। বেসিক ব্যাংকের একই অবস্থা। ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ মর্মে একটি সংবাদ পত্রিকায় দেখলাম। এ দিকে ‘পিপলস ইসলামি ব্যাংক ও বাংলা ব্যাংক নামে নতুন দুটো ব্যাংকের অনুমোদনের সুপারিশ করে ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে পত্র পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে (সূত্র : বণিক বার্তা, ২৩-১২-১৭)। পত্রিকায় উঠেছেÑ পিপলস ইসলামি ব্যাংকের আবেদনকারী এম এ কাশেম তার নিজ এলাকা সন্দ্বীপে একেবারেই অপরিচিত। তিনি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হলেও ব্যাংক পরিচালনা করার দক্ষতা এবং ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার মতো অর্থ থাকার কথা নয়। জানা গেছে, তৃতীয় কোনো পক্ষের স্বার্থ রক্ষার জন্যই সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার হচ্ছেন এম এ কাশেম। তার জন্মস্থান সন্দ্বীপের রহমতপুরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এম এ কাশেমের পুরো পরিবারই দীর্ঘ দিন ধরে য্ক্তুরাষ্ট্রে বসবাস করছে। সন্দ্বীপে তাদের বাড়ি থাকলেও কেউই সেখানে থাকেন না এবং এম এ কাশেমের পরিবারও সেখানে আসেন না। এম এ কাশেম গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে এ রকম ব্যক্তি যদি ব্যাংকের মালিক হন তাহলে বিগত সময়ে ১০টি ব্যাংক যেভাবে ফান্ড ক্রাইসিসে পড়েছে, একই অবস্থা নতুন ব্যাংক দুটোর ক্ষেত্রে হবে বলে অভিজ্ঞজনরা মনে করেন। এ দিকে, বাংলা ব্যাংকের জন্য আবেদনকারী বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো: জসিম উদ্দিন ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া মেঘনা ব্যাংকেরও উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার। পত্রিকার সাথে কথা বলে তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের আবেদনকৃত ব্যাংকের লাইসেন্স দেবে। এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুলেটিন আকারে কোনো নিউজ প্রকাশ করেনি ব্যাংক দুটোর অনুমোদনের ব্যাপারে। কিন্তু ব্যাংক দুটোর কর্তৃপক্ষ সব দিক থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনা অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্যে সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছেন এভাবে যাচাই-বাছাই না করে বিগত কয়েক বছর প্রায় এক ডজনের মতো ব্যাংক অনুমোদনের ব্যাপারে। তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা খুব একটা ভালো নয়। সামনের দিনগুলো কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে এমন কিছু দৃশ্যমান বা আশাপ্রদ ফল লক্ষণীয় নয়।

২৩ নভেম্বর ২০১৭ রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম অডিটোরিয়ামে ‘লোন টেকওভার ইন বাংলাদেশ : ইজ ইট এ হেলদি প্র্যাকটিসেস’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের গ্রাহকের ঋণ ক্রয় বা টেকওভার (ঋণ হস্তান্তরের) হচ্ছে। ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত চার হাজার ৩৩৯ কোটি টাকার ঋণ হস্তান্তরের ঘটনা ঘটছে। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ব্যাংকগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। বহুলাংশে গ্রাহকের সব ধরনের তথ্য সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেয়া হচ্ছে। পরে এসব ঋণ খেলাপিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহেল মোস্তফা। চার সদস্যের গবেষকদলে আরো ছিলেনÑ বিআইবিএমের সহকারী অধ্যাপক ড. মো: মহব্বত হোসেন, লেকচারার তোফায়েল আহমদ এবং লেকচারার রাহাত বানু। গবেষণা প্রতিবেদনে ৬০ শতাংশ ব্যাংকার বলেছেন, পরিচালনা পরিষদের অযৌক্তিক চাপে ঋণ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। ৫ শতাংশ ব্যাংকার জানিয়েছেন ঋণ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেয়া হচ্ছে। বৈঠকের প্যানেল আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং বিআইবিএমের চেয়ারপারসন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তরা এখন ব্যাংকিং খাতে ঢুকে পড়েছে। এ কারণে একটি ব্যাংকে গত তিন বছরে (২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭) তিনজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন ৯ মাস ধরে কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি এও বলেনÑ দুই থেকে চার টাকা দিলে এমডি পাওয়া যাবে, কিন্তু ব্যাংক চালানোর মতো উপযুক্ত লোক পাওয়া যাবে না। ব্যাংকার ভালো হলে নীতিমালার প্রয়োজন পড়ে না।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/276859