১৬ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:৪৭

ছাত্ররাজনীতি যেনো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে!

ধীরে ধীরে আমরা কেমন যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। ব-দ্বীপ বাংলার কোমল মাটিতে জন্ম নেওয়া আমরা একসময় ছিলাম কায়ায়-মায়ায়, সভ্যতা-ভব্যতায় বিশ্বের গর্ব। কিন্তু শুধু নেতৃত্বের দুর্বলতায় আমরা কেন যেন সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছি।
স্বাধীনতাত্তোরকালে ১৯৭২-৭৫ সালে বাকশাল শাসনামলে রক্ষীবাহিনী অত্যাচার-নির্যাতনের এক বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল। সেই রক্ষীবাহিনীও ছিল হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর মতো একটি বাহিনী। বর্তমানে আইনশৃংখলা বাহিনীর পরেই ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বেআইনী তৎপরতা।

১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর ছাত্রলীগেরই একটি অংশ জাসদ গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। জাসদের আদর্শ প্রচারক গণবাহিনীর মুখ্য কাজই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম করা। জাসদ সে জন্য যা করা দরকার তা তারা করতে পিছপা হননি। বাড়িঘরে, পাটের গুদামে, পোস্ট অফিসে, থানায় আগুন দেওয়া, সরকারি অস্ত্র লুট করা, প্রকাশ্য ঈদের জামায়াতে এমপি হত্যা কোনো কিছু বাদ যায়নি। জাসদ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নিহত হতে থাকে।
শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও অভিভাবকদের স্বস্তির জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। ইসলামী ছাত্রশিবির বা ছাত্রদল তো নয়ই, অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের কর্মকা- এখানে প্রায় নেই বললেই চলে। ২০০৯ সাল থেকে গত ৮ বছর ১০ মাসে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই অন্তত ৬১ জন নিহত হয়েছেন। টেন্ডার, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব কারণে দেশের অন্তত ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদে বন্ধ ছিল।

প্রতিপক্ষ নেই বলে নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে লড়ছে ছাত্রসংগঠনটি। সংঘর্ষের বিস্তৃতি কখন কত দূর পর্যন্ত গড়াবে, তার আগাম অনুমান তো সম্ভব নয়। প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছাত্রদের ধাওয়া করছে এক যুবক-এ রকম ছবিও ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭)
অথচ কি প্রশাসন, কি কলেজ কর্তৃপক্ষ, কেউই এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারছে না। পারছে না কারণ ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একেক গ্রুপের সমর্থনপুষ্ট। ভাবতে অবাক লাগে। এ রকম সংস্কৃতি হলো কেন রাজনীতিতে? কথা বললেই খুনাখুনি এবং কাপুরুষের মতো খুন করা হয়। কয়েক মাস আগে সিলেট ছাত্রলীগের সুরমা গ্রুপের কর্মী জাকারিয়া মুহাম্মদ মাসুমের ছোট ভাইকে কিডন্যাপ করা হয়েছে এবং ফোন করে বলা হয়েছে তার ভাই অ্যাকসিডেন্ট করেছে। সে সরল মনে ফোনের নির্দেশনা মোতাবেক হাতিম আলী স্কুলের ওখানে যেতেই তাকে ছুরি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে হত্যা করা হয়। ধোঁকা দিয়ে কাপুরুষের দল হত্যা করে মাসুমকে।

খুনের ঘটনার পর সিলেট জেলা যুবলীগের সভাপতি শামীম আহমদ নিজের ফেসবুকে এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘সিলেটের নেতৃবৃন্দকে বলি-পুলিশ কর্মকর্তাদের এক একটি ফোন দিয়ে বলুন যে-তার সুবিচার পাওয়ার জন্য যে-ই হোক, যে কোনো গ্রুপের হোক, যে কোনো দলের হোক তাকে আইনের আওতায় এনে সুবিচারের দরজা খুলে দেন এবং এই পবিত্র নগরীতে আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয় সেই প্রতিশ্রুতি আদায় করুন।’
সিলেট ছাত্রলীগে নিজেদের অভ্যন্তরে হানাহানির ঘটনায় শুধু জেলা যুবলীগ সভাপতিই নয়, অনেকের মনে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যুবলীগের সভাপতির এমন স্ট্যাটাসেই সেটি প্রমাণিত হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৭ বছরে সিলেটে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রলীগের ৭ কর্মী খুন হয়েছে। আর এসব খুনের ঘটনার বিচার হয়নি একটিরও। খুন হওয়ার পর আবার অনেককেই ছাত্রলীগ পরিচয় দেয়াও হয় না। অথচ খুন হওয়া কর্মীরা মিছিল-মিটিংয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকেন।

২০১০ সালের ১২ জুলাই অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে নগরীর টিলাগড়ে খুন হন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের ৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো ১০-১৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন পলাশের বাবা বীরেশ্বর সিংহ।
২০১৪ সালের ১৪ জুলাই সিলেট নগরীর মদিনা মার্কেট-কালিবাড়ি রোডের মদিনা মার্কেট অংশে ইজিবাইকের (টমটম) একটি নতুন স্ট্যান্ডের দখল নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা ইমরান আহমদ ও গোলজার আহমদ গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ ওরফে কচি নিহত হয়। এ ঘটনায় কচির ভাই আসাদুল হক ভুঁইয়া বাদী হয়ে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেন। মামলাটি এখন সিআইডিতে তদন্তাধীন। একই বছরের ২০ নভেম্বর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের পার্থ-সবুজ গ্রুপের সাথে অঞ্জন-উত্তম গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী সুমন চন্দ্র দাস। এ ঘটনায় সুমনের মা প্রতিমা দাস বাদী হয়ে ছাত্রলীগের অজ্ঞাতনামা শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করেন। এই মামলাটিও এখন সিআইডি তদন্ত করছে।
২০১৫ সালের ১২ আগস্ট দুপুর আড়াইটায় সিলেট মদন মোহন কলেজ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজ দলের ক্যাডারদের ছুরিকাঘাতে খুন হন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোগলাবাজার থানার সিলাম তেলিপাড়া গ্রামের আকলিস মিয়া আরকানের ছেলে আব্দুল আলী। তিনি ছাত্রলীগ বিধান সাহা গ্রুপের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ঘটনার দিন বিকালে দক্ষিণ সুরমা থানার চন্ডিপুলস্থ ফুলকলি মিষ্টিঘর থেকে আটক করা হয় মূল ঘাতক সিলেটের ওসমানীনগর থানার দয়ামীর গ্রামের চিত্তরঞ্জন দাশের ছেলে প্রণজিৎ দাশ ও সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামের বাসিন্দা হারুনুর রশিদের ছেলে আঙ্গুর মিয়া। এ ঘটনায় ১৫ আগস্ট প্রণজিত দাশ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
২০১৬ সালের ১৯জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিলেটে আসার আগের দিন ছাত্রলীগের গ্রুপিংয়ের শিকার হন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী কাজী হাবিবুর রহমান। ওইদিন সকাল সাড়ে ১১টায় নগরীর শামীমাবাদে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মাঠে ছাত্রলীগ নেতা হোসাইন মুহাম্মদ সাগর ও সোহেলের নেতৃত্বে একদল ছাত্রলীগ কর্মী তার ওপর হামলা চালায়। এ সময় হাবিবকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তারা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় হাবিবের। এ ঘটনায় নিহতের ভাই ১১ জনের নাম উল্লেখ করে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন।

১৭ জুলাই ২০১৭ দুপুরে সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের শ্রেণিকক্ষের ভেতরে নিজেদের পাইপগানের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন জেলা ছাত্রলীগের আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক পাভেল গ্রুপের সমর্থিত কর্মী খালেদ আহমদ লিটু। পরে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ ও সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে খালেদ আহমদ লিটু ছাত্রলীগ কর্মী নয় দাবি করে বলেন, ‘লিটু আসলে ছাত্রলীগের কর্মীই নয়। লিটু একজন অছাত্র এবং মোবাইল দোকানের স্বত্ব্বাধিকারী। (সূত্র : দৈনিক মানব জমিন ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭)

১৪ আগষ্ট ২০১৭ সালাম না দেয়ার অভিযোগ তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের আবাসিক ছাত্র লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শামিমুর রহমার ও একই বর্ষের বাংলা বিভাগের আতিকুর রহমানকে মারধরের পর হল ছাড়া করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এসএম হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল গ্রুপের নেতাকর্মীরা এই কাজ করেছে।
হলের গেস্টরুম থেকে দেখার পরও কেন সালাম দেয়া হয় না, তার জবাবদিহি করতে ওই দুই ছাত্রসহ মোট তিনজনকে ১৭৭ নং কক্ষে ডাকেন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের তৃতীয় বর্ষের সাদিক খান। সেখানেও শামিম ও আতিকুর সালাম না দিয়ে প্রবেশ করলে তাদের চড়থাপ্পড় দেন সাদিক খান। পরে লাঠি ও রড দিয়ে মারধর করেন পরিসংখ্যান বিভাগের তানভীর ও সৌরভ, জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের তাহের, ফারসি বিভাগের সফিউল্লাহ, সংস্কৃত বিভাগের সোহরাব। এরা সবাই তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সভাপতি তাহসানের কাছ থেকে ছাত্রদেরকে রুমে ঢুকিয়ে মারার অনুমতি নিয়েছিলেন বলেও জানা যায়।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরেরদিন সকালে তাহসান গ্রুপের সকল দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মারধরের ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শামিমুর রহমার ও আতিকুরকে স্থায়ীভাবে হল থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দেন তাহসান আহমেদ। পরে হলের সিনিয়ররা তাহসানকে বুঝিয়ে তাদের হলে ফিরিয়ে আনলেও পরের দিন আবার তাদের বের করে দেয়া হয়। (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক ১৭ আগষ্ট ২০১৭)
১৮ আগষ্ট ২০১৭ ছাত্রলীগ কর্মীকে কোপানোর মামলায় টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক তানভীরুল ইসলাম হিমেলকে (২৫) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। টাঙ্গাইল সদর থানার ওসি নাজমুল হক ভুইয়া হিমেলকে গ্রেফতারের বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ১১ আগস্ট শহরের থানাপাড়া এলাকায় একজন ছাত্রলীগ কর্মীকে কোপানোর মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। (সূত্র : দৈনিক যুগান্তর ১৯ আগষ্ট ২০১৭)।

 

http://www.dailysangram.com/post/311327