১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৯:৫৯

বিআইবিএমের গবেষণা প্রতিবেদন

অনিয়মের কারণে ব্যাংকের ওপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ

ব্যাংক হলো আস্থার প্রতীক। আস্থার ভিত্তিতে মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ নিজ ঘরে না রেখে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখেন। অথচ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর এখন আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। এর সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর। আগামী দিনে গ্রাহকের আস্থা ফেরানোই হবে এ খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
গতকাল ‘করপোরেট ইথিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইন ব্যাংকস : বাংলাদেশ পারসপেক্টিভ’ শীর্ষক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। গতকাল রাজধানীর মিরপুরে কর্মশালাটি আয়োজন করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা: রাজী হাসান। কর্মশালায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করে বিআইবিএমের পরিচালক ড. শাহ মো: আহসান হাবীবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টির বিষয়ে আবু হেনা মোহা: রাজী হাসান বলেন, ব্যাংকিং ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে আস্থার ওপর নির্ভরশীল। আমানতকারীদের আস্থার সঙ্কট শুরু হলে ব্যাংকিং ব্যবসা করা কঠিন। সম্প্রতি একটি ব্যাংক (ফারমার্স ব্যাংক) আমানতকারীদের মধ্যে আস্থা সঙ্কটের কারণে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গ্রাহকেরা তাদের আমানত ফিরিয়ে নেয়া শুরু করেছে। এ ব্যাংকের শাখাগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন গ্রাহকেরা। উদ্বিগ্ন গ্রাহকেরা আমানতের অর্থ ফিরিয়ে নিতে চাইলেও চাহিদামতো সে অর্থ ফিরিয়ে দিতে পারছে না ব্যাংকটি। এ সঙ্কট ব্যাংকটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্যাংক পরিচালকদের ভাগাভাগি করে ঋণ নেয়া বন্ধ করার ওপর জোর দিয়ে সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি এস এ চৌধুরী বলেন, ‘ব্যাংকের পরিচালকেরা যোগসাজশ করে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। এটা বন্ধ করতে হবে।’ দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির কারণে ব্যাংকের ওপর থেকে মানুষের আজ আস্থা কমে যাচ্ছে। ব্যাংকের ওপর মানুষ এখন আর ভরসা করতে পারছে না। এর উন্নতি করতে হবে। ব্যাংক পর্ষদের সাথে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালনা পর্ষদের সাথে ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনার দূরত্ব বাড়ছে। অনেক েেত্র ব্যবস্থাপনা কর্তৃপ বোর্ডের সাথে আপস করে চলছে। কোনো ব্যাংকার অনিয়মের তথ্য দিতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংককে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া মানুষের কষ্টের কথা শোনার জন্য আর্থিক ন্যায়পাল গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।

বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং খাতে সুশাসন বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু আমাদের এখানকার বোর্ড সুশাসন বাস্তবায়নের পরিবর্তে ঋণ অনুমোদন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পৃথিবীর সব জায়গায় ব্যাংকের বোর্ডের মূল কাজ হলো নীতি প্রণয়ন এবং নজরদারি করা। কিন্তু বাংলাদেশে সুশাসনের সংস্কৃতির প্রচলন নেই। বরং ধীরে ধীরে আরো অবনতি ঘটছে।
মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: নুরুল আমিন বলেন, একটা ব্যাংকের স্টেকহোল্ডার হলো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বোর্ড এবং অপরাধ চক্র। আজকের এ আয়োজনে তারা কেউ নেই। এখানে আছি তারাই যারা বলছি আর শুনছি। একটি বিদেশী ব্যাংকের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, মাত্র একজন ব্যক্তির অপরাধের কারণে ২০০ বছরের একটি ব্যাংক ধসে পড়েছে। একটি ব্যাংকে অপরাধীর সংখ্যা বেশি হওয়ার প্রয়োজন নেই। কয়েকজন অপরাধীর কাছেও ব্যাংকিং খাত জিম্মি হয়ে যায়। বার বার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটতে থাকে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়। ব্যাংকের আস্থার সঙ্কট খেলাপি ঋণের চেয়েও ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার মতে, ইমেজ সঙ্কট একটি ব্যাংকের জন্য খুবই খারাপ দিক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সম্পর্কে বলেন, সব গণ্ডগোল ব্যাংকের মাথায় (পরিচালনা পর্ষদ)। এটা ঠিক না হলে কিছুই ঠিক হবে না। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে ছাঁটাইয়ের প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে দু’টি ঘটনা আমি জানি। একটি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত একজন পাগল হয়ে গেছেন। আরেকটা ব্যাংকের একজন হার্ট অ্যাটাক করেছেন।
বিআইবিএমের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতা ঘাটতির কারণে আর্থিক অনিয়মের ঘটনা বাড়ছে। অনিয়ম করলেও শাস্তি না হওয়াকে আর্থিক অনিয়মের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/276684