১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৯:৫৩

রাষ্ট্রের দায় ও জননিরাপত্তা

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : আর এম ম্যাকাইভার তার ‘ঞযব গড়ফবৎহ ঝঃধঃব’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ বা দায়িত্ব।’ মূলত নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার নিশ্চয়তা থেকে রাষ্ট্র নামক সংগঠনের সৃষ্টি হয়। আসলে নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণ ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে শৃক্সক্ষলাবোধের ধারণা থেকেই রাষ্ট্রীয় ধারণার ব্যুৎপত্তি। বস্তুত, সর্বসাধারণকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তির বিধান করা এবং সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃক্সক্ষলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকে। রাষ্ট্র আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষার্থে আইনশৃক্সক্ষলাবাহিনী ও অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনী গড়ে তোলে। এসব বাহিনী রাষ্ট্রকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখে। আর এটিই হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রে সংক্ষিপ্ত স্বরূপ।
জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় কাজ। দেশের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার এবং বৈদেশিক আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন ও পরিচালনা রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব। আধুনিককালে প্রতিটি রাষ্ট্রই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলেছে। স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এবং তা সব সময়ই আধুনিকীকরণের চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কূটনৈতিক বা বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে জাতি যত উন্নত সে জাতির বৈদেশিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ততই গতিশীল। কারণ, রাষ্ট্র এখন মধ্যযুগের ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে চলে না বরং রাষ্ট্রব্যবস্থায় সনাতনী ধ্যান-ধারণা পরিহার করে আধুনিক চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। ফলে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক ধারার। এতে যোগ হয়েছে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বহুপাক্ষিক স্বার্থ। মূলত আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনভাবেই স্বেচ্ছাচারিতা স্বীকৃত নয় বরং সব কিছুই সংবিধিবদ্ধ।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রকে পরিচিত করা, রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডে অবস্থিত সম্পদের ওপর দাবি প্রতিষ্ঠিত করা, অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন, আঞ্চলিক আদালত গঠন, বহিঃর্বিশ্বের অর্থনৈতিক বাজার সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ, বিদেশে অবস্থানরত দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সেবা প্রদান হচ্ছে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক অপরিহার্য কাজ। তাই রাষ্ট্রকে সফল ও সার্থক করতে হলে সময়োপযোগী ও গতিশীল পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সুসম্পর্কের বিষয়টিও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাংবিধানিক ও আইনের শাসনকে প্রাধান্য দেয়া হয়। সে জন্য দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষা, বোধ-বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতি, সংস্কৃতি-মূল্যবোধকে সামনেই রেখেই রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও যুৎসই আইন প্রণয়ন করা হয়। প্রয়োজনবোধে সংবিধান ও আইনে বারবার সংশোধনীও অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে। কারণ, সময় গতিশীল। তাই সময়ের প্রয়োজনেই সবকিছুতেই গতিশীলতা আনাও জরুরি হয়ে পরে। বস্তুত, সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন, আইনের শাসন ও ন্যাবিচার প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ।
রাষ্ট্রীয় আইনসভার মাধ্যমে আইন প্রণীত হয়। দেশের সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজ কোর্ট অধস্তন বিচারালয়ের মাধ্যমে দেশের সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের আবশ্যিক কাজের মধ্যে পড়ে। রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদন, নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠূভাবে পরিচালনার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ, তাদের কর্ম বণ্টন ও নির্দেশ, কাজ তদারক এবং পরিচালনা রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। মূলত সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এসব অনুসঙ্গ প্রতিটি কার্যকর রাষ্ট্রের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। যা কোন ভাবেই উপেক্ষা করার সুযোগ থাকে না।

অর্থ ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যয়নির্বাহে রাজস্ব বা কর আদায় ও বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের একটি মুখ্য কাজ। রাষ্ট্রের অধীন বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, মালিকানার উপর খাজনা ও কর নির্ধারণ, যথাযথবাবে আদায় এবং সুষ্ঠুভাবে ব্যয় করা, রাষ্ট্রের বাজেট প্রণয়ন, মুদ্রা প্রবর্তন ও বিনিয়োগ, গণনা ও পরিমাপের একক নির্ধারণ এবং মূল্য নির্ধারণ, অর্থনৈতিক পরিচালনা, মুদ্রাস্ফীতি রোধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণ এগুলোও রাষ্টের মুখ্য কার্যাবলি। তাই এসব কাজ রাষ্ট্র কোনভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না বরং রাষ্ট্রকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ রাখতে সরকার এসব দায়-দায়িত্ব কোন ভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না।
মূলত, রাষ্ট্রকে সফল, গণমুখী ও কল্যাণকামী করার জন্য উল্লেখিত কার্যাবলী যথাযথভাবে সম্পাদনের কোনই বিকল্প নেই। আর রাষ্ট্রের এই মহান দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করাও প্রতিটি সুনাগরিকের দায়িত্ব। আর এজন্যই নাগরিকরা রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় ও যৌক্তিক কর প্রদান করে। কিন্তু আমাদের দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা সেক্ষেত্রে কতখানি সফল ও সার্থক হচ্ছে এটিই এখন আলোচ্য বিষয়। কারণ, আমাদের দেশে আইন ও সাংবিধানিক শাসন নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা ও গুরুতর বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কারণ, দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে জোড়ালো অভিযোগ উঠেছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোন মহলকেও সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সরকার দেশে সুশাসন উপহার দিতে পারেনি বলেই জনশ্রুতি রয়েছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিয়েও গুরতর প্রশ্ন রয়েছে দেশী ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। অভিযোগ আছে যে, সরকার জনগণের কল্যাণে কাজ না করে নিজেদের ক্ষমতা রক্ষাকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। জননিরাপত্তা নিয়েও অসন্তুষ্টি রয়েছে সর্বসাধারণের মধ্যে।

সরকারের বিরুদ্ধে বিরাজনীতিকরণের অভিযোগও বেশ প্রবল। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করছে যে, সরকার তাদেরকে সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। সংবিধান অনুযায়ী রাজনৈতকি দলগঠন, রাজপথে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হলেও সরকার সে অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করছে। এমনকি বিরোধী দলগুলোর ঘরোয়া বৈঠকগুলোকে গোপন বৈঠক আখ্যা দিয়ে নেতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে আটক করে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে। ফলে দেশে সুশাসনের পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের কার্যক্রমকে ক্ষমতা রক্ষার মহড়া হিসেবেই দেখছেন অভিজ্ঞমহল। মূলত এসব অভিযোগের যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য সমাধান ছাড়া কোন রাষ্ট্র কার্যকর হয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে হয় না। যা রীতিমত উদ্বেগজনক।

সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দল, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল যেসব অভিযোগ তুলছে তা মোটেই কাক্সিক্ষত নয়। অভিযোগগুলো স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য বলেই মনে করছেন বোদ্ধামহল। কারণ, দেশে সুষ্ঠু ধারার গণতান্ত্রিক চর্চা আছে বলে মনে হয় না। একথার প্রমাণ মেলে সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ওপর হামলার বিষয়কে কেন্দ্র করে। কারণ, সরকার যদি একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে সাধারণ নাগরিকের কী হাল তা সহজেই অনুমেয়। প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাওয়ার পথে বারবার হামলার শিকার হয়েছেন। যা কাক্সিক্ষত তো নয়ই বরং আমাদের ভবিষ্যতের জন্যও অকল্যাণকর। মূলত আমাদের দেশে সুস্থধারার রাজনীতির পরিবর্তে রাজনীতির কক্ষচ্যুতি ঘটেছে। তাই রাজনীতিকে কক্ষপথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সকলের। কিন্তু এর দায়ভারটা অন্যদের চেয়ে সরকারের ওপর বেশী বর্তায়। বিষয়টি ক্ষমতাসীনরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারবে ততই কল্যাণ।
বিএনপি সূত্র খালেদা জিয়ার ওপর হামলার জন্য সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের দায়ী করছেন। কিন্তু সরকার পক্ষ এ হামলার জন্য বিএনপির লোকজনকেই দায়ী করছেন। কিন্তু কথা হলো হামলাকারীরা যে দলেরই হোক না কেন আইন-শৃক্সক্ষলাবাহিনী তাদেরকে আইনের আওতায় আনছেন না কেন? সন্ত্রাসীরা বিএনপি’র হলে তো সরকারেরই পোয়াবারো। কিন্তু সরকার এসব সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার না করায় প্রমাণ হয় যে, সন্ত্রাসী বিএনপির নয় বরং অন্যকোন গোষ্ঠীর। তা নাহলে হলে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না কেন? সঙ্গত কারণেই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। আর এ সুযোগটা করে দিচ্ছে সরকার পক্ষই।
বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দল, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে বরাবরই অভিযোগ করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। অভিযোগ আছে যে, কথিত এনকাউন্টার বা ক্রস ফায়ারের নামে সরকার বিরোধী দল নির্মূলের অভিযানে নেমেছে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক ও সভ্য রাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বরং তা রাষ্ট্রীয় অনাচার হিসেবেই স্বীকৃত। কিন্তু এই অপসংস্কৃতি আমাদের দেশে কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না বরং দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার রিপোর্টে ওঠে এসেছে দেশের ভয়াবহ চিত্র। যা আত্মসচেতন মানুষকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, চলতি বছরের নয় মাসে আইনশৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে তথাকথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ১০৭ জন। সংস্থার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এ বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইনশৃংখলা বাহিনীর ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ১০৭ জন। এদের মধ্যে র্যা বের ক্রসফায়ারে ১৮ জন, পুলিশের ক্রসফায়ারে ৮৭ জন ও যৌথবাহিনীর ক্রসফায়রে ২ জন নিহত হয়।
এছাড়া পুলিশ হেফাজত ও কারাবন্দী অবস্থায় বিভিন্ন কারণে মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের। সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ক্রসফায়ারে নিহতের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা, গভীর উদ্বেগের বিষয়। ক্রসফায়ারে নিহতের ঘটনা জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। একজন অপরাধীরও অধিকার আছে তার বিচারকার্য যেন দেশের আইনানুযায়ী হয়। কিন্তু সেদিকে কোন খেয়াল করা হচ্ছে না বরং ক্রমেই বাড়ছে বৈ কমছে না।
মূলত ক্রসফায়ারে নিহতের ঘটনা দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সমালোচিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়ন ও মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের উচিত এখনই এ বিষয়ে দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নেয়া। এখানেই শেষ নয়। আইনশৃক্সক্ষলাবাহিনী কর্তৃক ব্যবসায়ী অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটেছে আমাদের দেশে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা মুক্তিপণের ১৭ লাখ টাকাসহ গোয়েন্দা পুলিশের ৭ জনকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে। ফলে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাপ্ত অভিযোগে জানা যায়, সম্প্রতি টেকনাফ পৌর এলাকার মধ্য জালিয়াপাড়ার আবদুল গফুরকে অপহরণ করেন ওই সাত ডিবি পুলিশ। পরে তার পরিবারের কাছে কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। বিষয়টি গফুরের বড় ভাই সেনা ক্যাম্পে জানান।

পরিকল্পনা অনুযায়ী গফুরের পরিবার ১৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলে রাতে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেনাবাহিনীর চেক পোস্টে তল্লাশি করে ছয় ডিবি পুলিশকে পুরো টাকাসহ আটক করেন সেনাসদস্যরা। মূলত জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব আইনশৃক্সক্ষলা বাহিনীর। কিন্তু সম্প্রতি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে ৭ ডিবি সদস্য গ্রেফতার হওয়ায় সারাদেশে হৈচৈ পড়েছে। দেশের মানুষ আর নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করতে পারছেন না। এক অজানা অতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশেই। মূলত রক্ষক যদি এভাবে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং রাষ্ট্র যদি নির্লিপ্ত থাকে তাহলে তা রীতিমত আতঙ্কের বৈকি।
মূলত রাষ্ট্র (State) বলতে এমন এক রাজনৈতিক সংগঠনকে বোঝায় যা কোন একটি ভৌগোলিক এলাকা ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার সার্বভৌম ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্র সাধারণত একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের সমন্বযয়ে গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক সীমার ভেতর বসবাসকারী সমাজের সদস্যদের শাসনের জন্য নিয়ম-কানুন তৈরি করে। যদিও একথা ঠিক যে রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পাওয়া না পাওয়া বহুলাংশে নির্ভর করে, রাষ্ট্র হিসেবে তার উপর প্রভাব রাখা ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির উপর।
ম্যাক্স ওয়েবারের সংজ্ঞানুযায়ী রাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক সংগঠন যা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে আইনানুগ বলপ্রয়োগের সব মাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে, যাদের মধ্যে রয়েছে সশস্ত্রবাহিনী, নাগরিক, সমাজ, আমলাতন্ত্র, আদালত এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়ে মতভিন্নতার কারণে তাত্ত্বিক মহলে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এই আলোচনাকে কেন্দ্র করে যে ঠিক কিভাবে একটি “সার্থক রাষ্ট্র” এর অভ্যুদয়কে সমর্থন করা যেতে পারে।

আমাদের দেশ সাংবিধানিকভাবেই একটি গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সংবিধানে সাম্য, মানবাধিকার, আইনের শাসন, জননিরাপত্তা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়টিও স্বীকৃত। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ৫ দশক হয়ে গেলেও আমরা আজও সে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই আমাদের প্রায় সকল প্রাপ্তিই অধরাই রয়ে গেছে। রাষ্ট্র নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু অধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ দায় অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। আমাদের সংবিধানেও সে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।
পরিতাপের বিষয় এসব কিন্তু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। রাষ্ট্রের কর্ণধার জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না; পারছে না জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করতে। ফলে নাগরিক জীবন প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত হচ্ছে। এক অজানা আতঙ্ক প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরছে দেশের সাধারণ মানুষকে। বিঘিœত হচ্ছে জননিরাপত্তার বিষয়টিও। কিন্তু এ দায় রাষ্ট্র কোনভাবেই এড়াতে পারে না। smmjoy@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/311242