১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:০৩

গ্যাসের তীব্র সঙ্কট

দফায় দফায় গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি : তবুও মিলছে না

জ্বলছে না চুলা, শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত
প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম পাওয়ায় রাজধানীসহ সারা দেশে গ্যাসের সংকট চলছে। বাসা বাড়িতে চুলা জ্বলছে টিম টিম করে। সকাল সাড়ে ৭টার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকার বেশিরভাগ আবাসিক এলাকায় গ্যাগ থাকে না। গ্যাস সংকটে চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভারসহ আশপাশের এলাকার অধিকাংশ শিল্পকারখানা দিনে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আস্তে আস্তে এ সংকট সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু হয়েছে। এরপরও কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। ৯২ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক কাজে। আর মাত্র ৮ শতাংশ ব্যবহার করে আবাসিক গ্রাহকেরা।

সব শ্রেণির গ্রাহকের জন্য গ্যাসের দাম ২২ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। তা দুই দফায় কার্যকর করা হয়। প্রথম দফায় গত ১ মার্চ ও দ্বিতীয় দফায় ১ জুনে দাম বাড়ানো হয়। শীতকালীন মৌসুম পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই রাজধানীসহ সারাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের চরম সংকট শুরু হয়েছে। গ্যাস নেই, তাই পূর্ব কাজীপাড়ার একটি বাসায় খড়ির চুলায় চলছে রান্না। রাজধানীর অনেক এলাকায় চুলা জ্বলছে না। সিলিন্ডার কিনে বা ভাড়া নিয়ে রান্নার কাজ সারছেন ওই সব এলাকার বাসিন্দারা। অথচ প্রতি মাসে তিতাসের বিল দিচ্ছেন তাঁরা। নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব চাহিদা পূরণ করতে না পারায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ দিনদিন বেড়েই চলেছে। চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকদের সেচ কাজে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়েই রাজধানীসহ সারাদেশে কমবেশি লোডশেডিং হচ্ছে বলে দাবি জানিয়েছে গ্রাহকরা। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের সরবরাহ কম থাকায় এ সমস্যা হচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের মারাত্মক সংকট চলছে। গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় গ্যাসের লাইনে চাপও কম। ফলে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গ্যাস থাকছে না। শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। চলমান সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে দুই সপ্তাহ আগে। বিশেষ করে গাজীপুর, আশুলিয়া, টঙ্গী ও সাভারের শিল্প-কারখানায় প্রয়োজনীয় চাপে গ্যাস মিলছে না। ফলে কারখানা চালু রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ কারখানা দিন ও রাতের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকছে। এসব এলাকায় গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা তিতাস গ্যাস কোম্পানিও গ্যাস সমস্যায় বিব্রত। গ্যাস সংকট নিয়ে পেট্রোবাংলার সঙ্গে বৈঠকও করেছে তিতাস। তবে আপাতত পরিস্থিতির উন্নতির জোরালো কোনো আশ্বাস মেলেনি। পেট্রোবাংলা বলছে, দ্রæত পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। রাজধানী ছাড়াও গাজীপুর, আশুলিয়া ইপিজেট ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের শিল্পসমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে দিনের বেশিরভাগ সময়ই গ্যাস থাকছে না। বর্ধিত উৎপাদন দুরের কথা, বিদ্যমান উৎপাদন ক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশও গ্যাসের অভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে শিল্পমালিকদের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ভেস্তে যেতে বসেছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে অনেক শিল্প-কারখানাগুলো।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়. গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা থেকে তিতাসকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হয়। তবে এর মাত্র ৮ শতাংশ পান আবাসিক গ্রাহকেরা। তারপরও গ্যাসের স্বল্পচাপের সবচেয়ে বড় শিকার হন এই গ্রাহকেরা। বাকি ৯২ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক কাজে। শীতকালে তিতাস এলাকায় চাহিদা থাকে দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। এখন পর্যন্ত গ্যাস না থাকায় গ্রাহকের বিড়ম্বনার কথা স্বীকার করেন তিতাসের কর্মকর্তারাও।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, আগামী বছর দেশের গ্যাস সংকট ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা হবে। এ জন্য বিদেশ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে ১ কোটি ঘনফুট জাতীয় গ্রিডে যোগ করা হবে। ৫০ শতাংশের মধ্যে প্রথমার্ধে ২০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করা হবে। উপদেষ্টা বলেন, বিদুৎ ও জালানির পাশাপাশি গ্যাসের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। নির্ভরযোগ্য ও গুনগত মানের বিদ্যুৎ সরবহারের জন্য ৪০ লাখের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাশাপাশি সিস্টেম লস ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশের নিচে আনার চেষ্টা চলছে।

তিতাসের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী এইচ এম আলী আশরাফ ইনকিলাবকে বলেন, গ্যাস কম আসায় সরবরাহ কম হচ্ছে। যখন গ্যাস আসবে জনগন ঠিক ভাবে গ্যাস পাবে। তবে শীতকালে গ্যাস একটু সংকট থাকে।
পেট্রোবাংলা ও তিতাস গ্যাস সূত্রে জানা গেছে, সিলেট গ্যাসফিল্ড, তিতাস গ্যাস ক্ষেত্রসহ ১০টি বড় গ্যাসকূপ থেকে কয়েকদিন ধরে গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে। এর মধ্যে ভাঙ্গুরা গ্যাসফিল্ডে আগে উৎপাদন হতো ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস (এমএমসিএফ), সেখানে উৎপাদন হয়েছে ৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়া রূপগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে ৮ এমএমসিএফডি থেকে কমে উৎপাদন হচ্ছে দশমিক ৪ মিলিয়ন ঘনফুট। সেমুতাং গ্যাসফিল্ডে আগে হতো ৩ এমএমসিএফডি, এখন হচ্ছে দশমিক ৯ এমএমসিএফডি। শাহবাজপুরে আগে হতো ৫০ এমএমসিএফডি, এখন হচ্ছে ৩৭.২ এমএমসিএফডি, ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে আগে ২৬ এমএমসিএফডি হতো, এখন হচ্ছে ১২.০১ এমএমসিএফডি। সালদায় আগে ছিল ১০, এখন ৩.০৮ এমএমসিএফডি, রিয়ানীগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে আগে হতো ১৫, এখন ৯.২ এমএমসিএফডি। সিলেট গ্যাস ফিল্ডে আগে হতো ৮ এমএমসিএফডি, এখন হচ্ছে ৫ এমএমসিএফডি। তিতাস গ্যাসফিল্ডে আগে হতো ৫৪২ এমএমসিএফডি, এখন হচ্ছে ৩৩৫ এমএমসিএফডি। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৮৫ শতাংশের জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়। কেন্দ্রগুলোতে গড়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে ৭০ কোটি ঘনফুটের মতো। বর্তমানে প্রাতিদিন গ্যাসের চাহিদা ২’শ ৫০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে উৎপাদন ২’শ কোটি ঘন ফুটের কম। তাই বোরো মৌসুমের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখে তা বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সারাদেশে গ্যাসের অভাবে সাড়ে ১১’শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় গ্যাস সংকট বেড়েছে। ফলে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। তিতাস ও ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রের দুটো কূপের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এ জন্য প্রায় ছয় কোটি ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন কমেছে।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, দেশে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সংকট চলছে। বেশিরভাগ গ্যাস ক্ষেত্রগুলোয় উৎপাদন কমে গেছে। তারা আগেই ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম পেতেন। গত কয়েক দিন ধরে আরও ১০ থেকে ১২ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম পাচ্ছেন। ১৫৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস, যেখানে চাহিদা প্রায় ১৯০ কোটি ঘনফুট। ফলে গ্যাস সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে টঙ্গী ও গাজীপুরের শিল্প-কারখানায় সমস্যা প্রকট। বিষয়টি নিয়ে পেট্রোবাংলার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তাদেরকে সমস্যার কথা জানানো হয়েছে। শিল্প মালিকরা গ্যাস পাচ্ছেন না। তারা বারবার ফোন করে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে বলছেন। মীর মসিউর রহমান বলেন, বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে পেট্রোবাংলা বলেছে, এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তিনি অভিযোগ করেন, পেট্রোবাংলা ক›দিন আগেও এমন আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু সমাধান হয়নি, বরং গ্যাসের সরবরাহ কমেছে।

আশুলিয়ার একটি ফ্যাশন কারখানার ম্যানেজার রফিকুল হক বলেন, কয়েক দিন ধরে তাদের কারখানায় গ্যাসের সংকট চলছে। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ থেকে তারা দিনে দুই-তিন ঘণ্টাও গ্যাস পাচ্ছেন না। যখন আসছে তখন গ্যাসের চাপ ১০ ভাগের এক ভাগও মিলছে না। ফলে কারখানা বন্ধই রাখতে হচ্ছে। অনেক শিল্প মালিক গ্যাসের অভাবে সিএনজি দিয়ে কারখানা চালু রেখেছেন। কিন্তু এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শীত আসার আগে অনেক এলাকায় কারখানায় গ্যাস পাচ্ছেন না। সাভার, টঙ্গী, আশুলিয়া, গাজীপুর, কোনাবাড়ি, সফিপুর এলাকার কারখানা ধুঁকে ধুঁঁকে চলছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি হয় তো দ্রæত সমাধান হবে।

আজিমপুরের বাসিন্দা গৃহবধু আমেনা বেগম জানান, শুধু আজ না গত কয়েকদিন যাবত গ্যাসের সংকটে রান্নাবান্না করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। রাতের বেলা কিছুটা গ্যাস থাকলেও সকাল ৯টার পর থেকে গ্যাস থাকে না। কখনও কখনও টিপটিপ করে চুলা জ্বললেও সেই গ্যাসে কোন কিছু রান্না করা সম্ভব হয় না। কবে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব কে জানে বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। মোহাম্মদপুন এলাকার বাসিন্দার অ্যাডভোকেট নাজনীন আক্তার বলেন, তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে প্রতিটি পরিবারকে রান্নাবান্নার কাজে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কখনও রান্না শেষ হওয়ার আগে আবার কখনও রান্নার মাঝ পথে গ্যাস চলে যাচ্ছে। সকালে না খেয়ে আদালতে যেতে হয়। তিতাসের ধানমন্ডি জোনের কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন। সাধারণত শীতকালে ঠান্ডায় গ্যাস জমে যাওয়ায় লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকে।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/108357