১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:০২

বছরে দুই সেমিস্টার জানুয়ারি থেকে!

উদ্যোক্তাদের উদ্বেগের মধ্যেই আগামী জানুয়ারি থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চার মাসে সেমিস্টারের বদলে ছয় মাসে সেমিস্টার ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। বছরে দুই সেমিস্টার করার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) যুক্তি হচ্ছে, এতে শিক্ষার মান বাড়বে, যেনতেনভাবে কোর্স শেষ করার বর্তমান সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া যাবে।

তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, এতে শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়বে, তারা সময় অপচয়ের ফাঁদেও পড়তে পারে। উদ্যোক্তারা মনে করছেন, সিদ্ধান্তটিতে হিতে বিপরীত হতে পারে। শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী প্রবণতা বাড়তে পারে, কমার আশঙ্কা রয়েছে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। দুই সেমিস্টার পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে পৃথকভাবে চিঠি দিয়েছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুই সেমিস্টার পদ্ধতি রয়েছে। ইউজিসি এর সঙ্গেও সমন্বয় করতে চাইছে।
ছয় মাসের সেমিস্টারের পক্ষে ইউজিসির যুক্তি হচ্ছে, চার মাসে সেমিস্টার শেষ করার জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দরকার তা আমাদের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক, অবকাঠামো ও ল্যাবরেটরির সংকট রয়েছে। ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই কোনোভাবে কোর্স শেষ করে পরীক্ষা নিয়ে নেয়।
শিক্ষার্থীরা কী শিখল সেদিকে তাদের কোনো খেয়াল নেই।
ইউজিসি আরো বলছে, বেসরকারি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী বেড়েছে, এখন মান বৃদ্ধি করা দরকার। এ ছাড়া দুই সেমিস্টার হলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীরা কিছুটা অবসরও পাবেন।
ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জানুয়ারি থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সেমিস্টার চালু হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাতে কোনো সমস্যা না হয় এ জন্য আমরা এক বছর আগেই তাদের জানিয়ে দিয়েছি। তবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় মনে করছে তারা ক্ষতির মুখে পড়বে। আমরা তাদের বুঝিয়েছি। দুই সেমিস্টারে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুবিধা হবে। উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। ’
বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সেমিস্টার বলে আমাদেরও করতে হবে এটা তো ঠিক নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে সরকারের টাকায় আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় নিজ খরচে। তাহলে দুই জায়গায় কেন একই হতে হবে?’ বিশ্বের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তিন সেমিস্টার রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছি। ’

তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন সেমিস্টার পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী একটি টার্মে ভর্তি না হলে বা কোনো কারণে উত্তীর্ণ হতে না পারলে তার ক্ষতি হয় চার মাস। কিন্তু দুই সেমিস্টার চালু হলে ক্ষতি হবে ছয় মাসের। কোনো শিক্ষার্থী যদি সঠিক সময়ে কোর্সে তাল মেলাতে না পারে তাহলে তার শিক্ষা ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়ও বেশি লাগবে।
গত মে মাসে রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি এক মতবিনিময়সভার আয়োজন করে। সেখানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ লিখিত বত্তৃদ্ধতায় বলেন, ‘স্নাতক শিক্ষার ক্ষেত্রে তিন সেমিস্টার পদ্ধতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের ডিগ্রির শর্ত পূরণ করা এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডিগ্রি অর্জন করা। যাদের জন্য শিক্ষা কার্যক্রমে সময় ব্যয় করাটা অর্থনৈতিকভাবে বোঝা সেসব শিক্ষার্থীর জন্য তিন সেমিস্টারবিশিষ্ট শিক্ষাবর্ষ অত্যন্ত উপযোগী। উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গেও এই সিস্টেমই সংগতিপূর্ণ। ’

সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাং কিং করে কিছু প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ‘কিউএস (কোয়াককোয়ারেলি সাইমন্ডস) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাং কিং’ অন্যতম। এ মুহূর্তে তাদের র্যাং কিয়ে সেরা ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র দুটিতে দুই সেমিস্টার চালু রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) তিন সেমিস্টার, স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে চার সেমিস্টার, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে দুই সেমিস্টার, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজে তিন সেমিস্টার, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে চার সেমিস্টার, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডে তিন সেমিস্টার, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ কিংডমে (ইউসিএল) তিন সেমিস্টার, সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখ-সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে দুই সেমিস্টার, যুক্তরাজ্যের ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনে তিন সেমিস্টার এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোতে চার সেমিস্টার চালু রয়েছে।

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ফিন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিংয়ের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান বলেন, ‘দুই সেমিস্টার ব্যবস্থায় ছয় মাসে কোর্স শেষ হয় বলে পড়ালেখার জন্য বেশি সময় পাওয়া যাবে ঠিক আছে, কিন্তু আর্থিক ব্যয়ভার বহন করা অনেকের পক্ষেই কষ্টকর হয়ে পড়বে। কারণ একটা বছরের পুরো টাকা মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে দুইবারে দেওয়া সম্ভব না। তাই আমার মনে হয়, বিদেশের মতো দুই সেমিস্টারের সঙ্গে একটা অপশনাল সেমিস্টার রাখা যেতে পারে। এতে কারো দরকার হলে অপশনাল সেমিস্টার নেবে, কারো দরকার না হলে নেবে না। ’
নাম প্রকাশ না করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা তিন সেমিস্টারে অভ্যস্ত। বছরের পুরো টাকা তারা তিনবারে দিতে পারে। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সেমিস্টার হলেও সেশনজটের কারণে তারা সময় বেশি পায়। ফলে তাদের তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু বেসরকারিতে যথাসময়েই কোর্স শেষ করতে হয়। তাই দুই সেমিস্টারে পড়ালেখার মান আরো নিম্নমুখী হবে। ’

তিন সেমিস্টারের পক্ষে আরো যুক্তি হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্ভাবনার নতুন খাত হিসেবে দেখছে সরকার। বর্তমানে প্রায় এক হাজার ৬০০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী পড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে তিন সেমিস্টার চালু হওয়ায় সহজেই বিদেশি শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধামতো সময়ে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে। এ ছাড়া কিছুদিন আগেও আমাদের দেশের প্রায় লাখো শিক্ষার্থী বিদেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেত। কিন্তু এখন তা অনেকাংশেই বন্ধ হয়েছে। কিন্তু দুই সেমিস্টার চালু হলে সুবিধামতো সময়ে ভর্তির নিশ্চয়তা না পেয়ে আবারও বিদেশমুখী হতে পারে এ দেশের শিক্ষার্থীরা। ফলে দুই সেমিস্টার চালু হলে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা।

জানা যায়, দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৬। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলায়ই সরকারি হোক বা বেসরকারি হোক অন্তত একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দিয়েছেন।

 

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/12/14/577348