১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:১৭

১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়াল পরিচালকদের ‘সমঝোতা ঋণ’

ব্যাংকের আমানত খেয়ে ফেলছেন মালিকরা

যোগসাজশের এ ঋণ বন্ধ না হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আমানতকারীরা -এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

ব্যাংক পরিচালকদের ‘সমঝোতা ঋণ’র পরিমাণ ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়াল। এর সঙ্গে তাদের শেয়ারের ৫০ শতাংশ পরিমাণ নেয়া ঋণের হিসাব যুক্ত করলে তা দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে জুন পর্যন্ত মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবে পরিচালকরা যে ঋণ নিয়েছেন তা মোট ঋণ বিতরণের প্রায় ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি খাতে বিদ্যমান ৫৭টি ব্যাংকের বেশিরভাগ পরিচালক এভাবে নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। ব্যাংকগুলোর পরিচালকের সংখ্যা এক হাজারের কাছাকাছি হলেও এ ধরনের সমঝোতাভিত্তিক বড় অংকের ঋণ বিনিময় করেন প্রায় ৫০ জন। যাদের কয়েকজন বেশি বিতর্কিত। মূলত এদের কাছে পুরো ব্যাংকিং খাত জিম্মি।

ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আসলে ব্যাংকের ঋণ গিলে খাচ্ছে ব্যাংকের মালিকপক্ষ তথা কিছু পরিচালক। আরও সহজ করে বলা যায়, ব্যাংক মালিকরাই আমানত খেয়ে ফেলছেন। যাদের নিজেদের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানও আছে। তাদের কাছে ব্যাংক কোনো সেবামূলক লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়, এটিকে তারা ধরে নিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাতিয়ে নেয়ার মেশিন হিসেবে। ব্যাংকের পরিচালক বা মালিক বলতে এখন যা বোঝায় তা হল, সাধারণ মানুষ নিরাপত্তার প্রশ্নে ব্যাংকে তাদের আমানত রাখবেন, আর ঋণ দেখিয়ে সে টাকা নিজেরা ভাগাভাগি করে নেবেন। আবার ঋণ খেলাপি হয়ে তা একপর্যায়ে অবলোপন করে অদৃশ্য করা হবে। এসব কারণে কয়েকটি ব্যাংকের ভেতরের অবস্থা খুবই নাজুক। তাদের আশঙ্কা, এক সময় ভেতরের খোলস বেরিয়ে এলে বহু আমানতকারীকে পথে বসতে হবে। আর ব্যাংকের পরিচালক হয়েও যারা ঋণ নিচ্ছেন তাদের কোনো চিন্তা নেই। পরিস্থিতি খারাপ দেখলে সপরিবারে বিদেশে সটকে পড়বেন। ভবিষ্যতে এমন আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে তাদের প্রত্যেকে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে গেছেন। সেখানে তারা বাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনা থেকে শুরু করে নানা খাতে বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার ব্যাংক থেকে তুমি ঋণ নাও- দিতে হবে না আর, তোমার ব্যাংক থেকেও আমি ঋণ নেব; কিন্তু ফেরত দেব না। এ ধরনের যোগসাজশের ব্যাংকিং খুবই ভয়াবহ নজির।’ তিনি বলেন, ব্যাংক পরিচালকদের যোগসাজশের এ লেনদেন বন্ধ করতে হবে। তিনি মনে করেন, ‘কানেক্টিং’ বা যোগসাজশের লেনদেন বন্ধ করতে না পারলে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এতে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে, যা ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৩১ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৬ হাজার ১৯৪ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন ব্যাংক মালিকরা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, এর মধ্যে শুধু এক ব্যাংকের পরিচালক অপর ব্যাংকের পরিচালকের সঙ্গে যোগসাজশ করে ঋণ নিয়েছেন ১ লাখ ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। যা ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ বিতরণের ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গত জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতের প্রায় সবক’টি ব্যাংকের পরিচালকরা একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ঋণ দেয়া-নেয়া করেন।

এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক প্রায় ৬ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া ৪ হাজার ৪৩ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংক ৪ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক ৪ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৪ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংক ৩ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা, এবি ব্যাংক ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা, ইউসিবিএল ৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা, এমটিবিএল ৩ হাজার ৮২ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংক ৩ হাজার ৪০ কোটি টাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংক ২ হাজার ১৪২ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংক ২ হাজার ২৩ কোটি টাকা এবং আইএফআইসি ব্যাংকের ২ হাজার ৫ কোটি টাকা উল্লেখযোগ্য। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জুন পর্যন্ত নতুন কার্যক্রমে আসা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক (এনআরবিসিবি) যোগসাজশ করে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে ঋণ দিয়েছে ৭০৬ কোটি টাকা। এসব ঋণের বড় অংশ মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসান নিয়েছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের মুখে পদত্যাগ করেন এনআরবিসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাছত আলী। এর আগে ব্যাংকটির এমডি দেওয়ান মুজিবুর রহমানকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া নতুন ব্যাংকের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে আরও ঋণ দেয়ার তালিকায় সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ৬২৭ কোটি টাকা, মিডল্যান্ড ব্যাংক ৪৫৫ কোটি টাকা, মধুমতি ব্যাংক ৪২৭ কোটি টাকা, মেঘনা ব্যাংক ৪১৩ কোটি টাকা, ফারমার্স ব্যাংক ১৯৪ কোটি এবং এনআরবি ব্যাংকের ১৩০ কোটি টাকা উল্লেখযোগ্য।
এদিকে সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এসব ব্যাংকের পরিচালকরা সরাসরি ব্যাংকের মালিক না হলেও পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যথারীতি ব্যাংক মালিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বাস্তবতা হল, তাদের ঋণ অনিয়ম করার সুযোগ বেশি।

অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালকরাও খুব সহজে তাদের কাছ থেকে ঋণ নিতে পেরেছেন। এছাড়া কেউ কেউ ঋণের গ্যারান্টার হয়েও ঋণ দিয়েছেন। তাই এমন চরিত্রের পরিচালকরা সরাসরি নিজেরা ঋণ না নিলেও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বড় অংকের ঋণ দিয়ে গোপনে কমিশন ভাগাভাগি করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে গেছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্রে আরও জানা গেছে, সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংক জুন পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে ঋণ দিয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংক ৬৮২ কোটি টাকা, কৃষি ব্যাংক ৫৭২ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংক ৪৪০ কোটি টাকা এবং বিডিবিএল দিয়েছে ১২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এটা ব্যাংক খাতের জন্য অশনিসংকেত। কিন্তু বাস্তবতা হল, আইন করে বন্ধ করা যাবে না। তিনি বলেন, ব্যাংকের মালিকরা সৎ না হলে এটা বন্ধ হবে না। এভাবে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী যুগান্তরকে বলেন, পরিচালক হিসেবে ঋণ নিতে কিছু বাধা থাকলেও ব্যবসায়ী হিসেবে ঋণ নিতে কোনো বাধা নেই। তবুও যে ব্যাংক ঋণ দেবে যাচাই-বাছাই করে দেয়া উচিত।
অপর এক ব্যাংকের পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের কোনো পরিচালক নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারবেন না। একই সঙ্গে গ্যারান্টার হওয়ারও সুযোগ নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতিসাপেক্ষে মূল শেয়ারের ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন, যা উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এছাড়া এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকের সঙ্গে সমঝোতা করে ঋণ নিতে পারবেন না। তবে ব্যবসা উন্নয়নের লক্ষ্যে কোনো ভালো ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন। যদিও তিনি অন্য ব্যাংকের পরিচালক হন। এসব ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে ঋণ গ্রহীতার প্রোফাইল এবং তার উদ্দেশ্য পর্যালোচনা করে ঋণ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/12/14/179355