১৩ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:৫৮

মিয়ানমারে অবরোধের ডাক ইউরোপীয় পার্লামেন্টের

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য নতুন করে অবরোধ আরোপের ডাক দিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। একই সঙ্গে তাঁরা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নকারী সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের দাবি জানিয়েছেন।

গতকাল মঙ্গলবার রাতে ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গে ইউরোপের ২৮টি দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্টে ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নিয়ে তাঁরা ওই দাবি জানান। এর আগে গত ৬ ডিসেম্বর মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়াসহ চলমান সংকটের মূল সমস্যাগুলো সমাধানের তাগিদ দিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ১২ দফা প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। আগামীকাল বৃহস্পতিবার ওই প্রস্তাবের ওপর ভোট হওয়ার কথা রয়েছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গত রাতে আলোচনায় ইউরোপীয় কমিশনের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ফেদেরিকা মোগেরিনি ছাড়াও ২৬ জন এমপি অংশ নেন। ফেদেরিকা মোগেরিনি ছাড়া বাকি প্রায় সবাই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি, দায়ী সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য অবরোধ আরোপ ও বাণিজ্য সুবিধা বন্ধের তাগিদ দেন। তাঁরা মিয়ানমার পরিস্থিতিকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ ও ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেন।

গত মাসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ফেদেরিকা মোগেরিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া এখন আর রাজনৈতিক কোনো বিষয় নয়, বরং এটি এখন নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির
পরিদর্শনের কথা তুলে ধরে বলেন, তিনি যে দৃশ্য দেখেছেন তা কখনো ভোলার নয়। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশই শিশু।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনার সময়ও মোগেরিনি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় কেবল সহযোগিতা নয়, এ সংকট সমাধানের বিষয়েও কথা বলেছেন। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে গিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বৈঠক করেছেন। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি বলেছেন, তাঁর সরকার আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ।

আলোচনা পর্বে ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি গ্রুপের ওয়ের্নার লাঙ্গেন বলেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। সেখানে গণতন্ত্র আছে কি না সে বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স অব সোশ্যালিস্ট অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটস গ্রুপের সোরায়া পোস্ট বলেন, চলমান গণহত্যা বন্ধে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অবশ্যই দায়িত্ব আছে। সামরিক বাহিনী কখনো দায়মুক্তি পেতে পারে না। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে কাঠগড়ায় তুলতে হবে।
ইউরোপিয়ান কনজারভেটিভস অ্যান্ড রিফরমিস্টস গ্রুপের আমজাদ বশির বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। সম্ভবত সেখানে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা চলছে। এটি মোকাবেলায় ইইউকে নেতৃত্ব দিতে হবে।

অ্যালায়েন্স অব লিবারেলস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটস ফর ইউরোপ গ্রুপের উরমাস পায়েট বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিপীড়নকারীদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করা উচিত। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে সময়সীমা ঘোষণা করতে হবে। ইইউর উচিত মিয়ানমারের ওপর বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করা।
ইউরোপিয়ান ইউনাইটেড লেফট কনফেডারেশন গ্রুপের ইউনুস ওমরজি মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হওয়া এক রোহিঙ্গা শিশুর বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই শিশুদের জন্য ইইউকে উদ্যোগ নিতে হবে।
গ্রুপ অব দ্য গ্রিনসের বারবার লকবিহলার বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। বেসামরিক সরকারকে পরিস্থিতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে। গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টে হতে হবে।

ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি গ্রুপের জোরোয়েন লেনারস বলেন, এক বছর আগেও পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। আজ পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরো খারাপ হয়েছে। মানবাধিকারের জন্য ইউরোপের শাখারভ পুরস্কার পাওয়া সু চিকে হৃদয় বন্ধ করে রাখা চলবে না। তাঁকে তাঁর জনগণের দুর্ভোগের কথা শুনতে হবে।
প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স অব সোশ্যালিস্টস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটস গ্রুপের লিন্ডা ম্যাকাভান বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি নিয়ে তিনি সন্দিহান।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কবিষয়ক ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদলের চেয়ার ও গ্রিস গ্রুপের সদস্য জিন ল্যাম্বার্ট বলেন, মিয়ানমার বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে খেলছে। মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপের প্রস্তাবকে তিনি সমর্থন করেন।

প্রস্তাবে যা আছে : সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ১২ দফা প্রস্তাবের শুরুতেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর ধারাবাহিকভাবে বলপ্রয়োগ, হত্যা, যৌন নির্যাতন, সম্পত্তি ধ্বংসসহ বিশেষ করে শিশুদের পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানানো হয়েছে। সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আহ্বানকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, মানবিক সহায়তা ও সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের উদ্যোগের প্রশংসা করা হয়েছে। মিয়ানমার সরকারকে অনতিবিলম্বে রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘ ও তাদের শরিক এবং অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়া, গুরুতর সব মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যৌন সহিংসতার পূর্ণ তদন্ত এবং দায়ীদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনার আহ্বান রয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমার সরকারকে অনতিবিলম্বে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতি পূর্ণ সহযোগিতা দেওয়ার আহ্বান, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে রাখাইন রাজ্যে পূর্ণ ও অবাধ প্রবেশাধিকার দিতে এবং গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে পূর্ণ সংগতি রেখে ওই চুক্তি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভূমিতে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনকভাবে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে মিয়ানমারের প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্ট আহ্বান জানিয়েছে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক : মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে গত রাত ২টার দিকে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক হওয়ার কথা। গত মাসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমার পরিস্থিতিতে প্রেসিডেনশিয়াল বিবৃতি গ্রহণের পর থেকে একই ইস্যুতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটি গত মাসে এবং মানবাধিকার পরিষদ গত সপ্তাহে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। থার্ড কমিটি গৃহীত প্রস্তাবটি এ মাসেই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্লেনারিতে ওঠার কথা রয়েছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/12/13/576959