১৩ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:৫৫

যে কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণ বন্ধ

রোহিঙ্গাদের ঘর ভর্তি ত্রাণ। রাখার জায়গা নেই। অতিরিক্ত এসব ত্রাণ বিক্রি করে দিচ্ছে হাট-বাজার ও পাড়া মহল্লায়। এমন অভিযোগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখলেও কি পরিমাণ ত্রাণ মজুত রয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারেনি প্রশাসন। তবে তারা জানিয়েছেন, জরিপ হচ্ছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নিকারুজ্জামান বলেন, অধিকাংশ রোহিঙ্গার বাসায় মজুত রয়েছে চাহিদার অতিরিক্ত খাদ্যপণ্য।

চাহিদার চেয়ে ত্রাণ বেশি পাওয়ায় রোহিঙ্গারা তা হাট-বাজারে বিক্রি করছে। বিষয়টি নজরে আসার পর ত্রাণ বিতরণে শিথিলতা আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে তিনি জরিপ চলছে জানিয়ে বলেন, কোনো রোহিঙ্গার ঘরে ত্রাণ না থাকলে তাদের ত্রাণ পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রতিদিন রোহিঙ্গারা ত্রাণ পাচ্ছে। অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঘর আছে যেখানে ত্রাণ রাখার জায়গাও নেই। এরপর উখিয়া কুতুপালংয়ের একাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখা যায়, ঘরগুলো সাধারণ শামিয়ানার ওপর হলেও কোনো ঘরেই এখন আর আসবাবপত্র ও নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের কমতি নেই। গ্যাস সিলিন্ডার, চুলা, জগ-গ্লাস, থালা-প্লেট, জামা-কাপড় সবই আছে পর্যাপ্ত। কোনো কোনো ঘরে এত বেশি ত্রাণের বস্তা রাখা আছে যে, সেসব ঘরে আর কোনো বাড়তি জিনিস রাখার জায়গা নেই। ফলে অতিরিক্ত ত্রাণ রোহিঙ্গারা কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। এসব ত্রাণসামগ্রী স্থানীয়রা কম দামে কিনে নিচ্ছে। অনেকে এসব ত্রাণ কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করছে বাইরে। রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ এসব ত্রাণ গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিক্রি করছে। রোহিঙ্গাদের অজুহাত- তাদের হাতে টাকা-পয়সা নেই, তাই অতিরিক্ত ত্রাণ রেখে লাভ কি? তাই তারা ত্রাণগুলো বিক্রি করে দিচ্ছে।

বালুখালীর স্থানীয় বাসিন্দা আলমগীর আলম নিশা বলেন, উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যামেপর ১২টি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে প্রতিদিনই লাখ টাকার ত্রাণ ও অর্থ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। প্রতিটি ক্যামেপই রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণ। এসব ক্যামেপ ত্রাণের কারণে ঘুমানোর মতো জায়গাও নেই। তবে কিছু রোহিঙ্গার অভিযোগ, তারা বিক্রি করার মতো ত্রাণ পায়নি। মাঝিরাই ত্রাণগুলো বেশি নিচ্ছে, তাই তারা বিক্রি করছে। এদিকে ত্রাণ বিতরণের কাজে যুক্ত কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ত্রাণসামগ্রী দেয়া হচ্ছে। খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি গৃহনির্মাণ সামগ্রী, কম্বল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেয়া হচ্ছে। বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যামেপর ২নং ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের গোলজার বেগম জানান, বাংলাদেশে আসার পর থেকে বিপুল পরিমাণ ত্রাণ পেয়েছেন। মিয়ানমারে যে অভাব ছিল তা এখন রোহিঙ্গা ক্যামেপ নেই। প্রতি সপ্তাহেই ত্রাণ পাচ্ছেন। তার ছোট ঘরে এত ত্রাণ রাখার জায়গা নেই। তাই ত্রাণ বিক্রি করে কিছু নগদ টাকা পাচ্ছেন।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যামেপর লম্বাশিয়া বস্তিতে ঝুপড়িতে বসবাস করা সোনা আলী ও গোল মেহেরের ঘরে গিয়ে দেখা গেছে ত্রাণের জন্য তাদের ঝুপড়িতে তিল ধারনের জায়গা নেই। এমন কি তারা দুই সন্তান নিয়ে রাতে ত্রাণের উপরই ঘুমান। সোনা আলী বলেন, আল্লাহর রহমতে খুব ভালো আছি, বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো। তিনি বলেন, আসার পর থেকে অনেক ত্রাণ পেয়েছি, তাই এত চাল, ডাল ও তেল নিয়ে কী করবো। এজন্য স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছি। হাতে কিছু নগদ টাকা থাকলে আর কোনো ভয় থাকে না। চার জনের পরিবার ১৫-২০ কেজি’র মতো চাল ত্রাণ হিসেবে প্রতিবার পাণ বলে জানান তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগদ টাকার জন্য দেশি-বিদেশি সাহায্য সংস্থা, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দেয়া বিভিন্ন ধরনের ত্রাণসামগ্রী বিক্রি করে দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। বাজারে থাকা দামের চেয়ে অর্ধেক দামে এসব সামগ্রী বিক্রি করছে। আর অল্পমূল্যে কেনা এসব ত্রাণসামগ্রী কিনে বেশি দামে বিক্রি করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ত্রাণ কিনতে রোহিঙ্গা ক্যামপভিত্তিক কয়েকটি সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে এরই মধ্যে। কুতুপালং, বালুখালী, হাকিম পাড়া, তাজনিরমার ঘোনা, জামতলীসহ সব ক্যামেপই একই চিত্র। ত্রাণ বিক্রির হিড়িক।
রোহিঙ্গা ক্যামপ ও বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে এক কেজি চালের দাম ৫০-৬০ টাকা। সেখানে রোহিঙ্গারা ত্রাণের চাল বিক্রি করছে মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি। ৬০ টাকা কেজি দরে চিনি কিনে রোহিঙ্গাদের দেয়া হচ্ছে। আরা রোহিঙ্গারা সেই চিনি বিক্রি করছে ৩০ টাকায়। বাজারে প্রতি কেজি ডালের দাম ১২০ টাকা। সেখানে রোহিঙ্গারা বিক্রি করছে ৬০ টাকায়। ১২০ টাকা লিটারের সয়াবিন তেল বিক্রি করছে মাত্র ৬০ টাকায়। এ ছাড়া ৫০০ গ্রাম ডানো দুধ বিক্রি করছে ৮০ টাকায়। চিঁড়া বাজারে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর রোহিঙ্গারা বিক্রি করছে ১৫ টাকা কেজি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৫-৭ জন সদস্যের একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে সপ্তাহে দুই বার ত্রাণ দেয়া হয়। এর মধ্যে ১০-১৫ কেজি চাল, ২-৩ কেজি ডাল ও ২-৩ লিটার তেল দেয়া হয়। এ হিসাব অনুযায়ী, তারা সপ্তাহে ২০-৩০ কেজি চাল, ৪-৬ কেজি ডাল ও ৪-৬ লিটার তেল পান।
বালুখালী ক্যামেপর আজমত মিয়া বলেন, আমার বাড়িতে অনেক ত্রাণ আছে। এখন টাকার প্রয়োজন তাই ত্রাণ বিক্রি করে দিচ্ছি। কুতুপালং বাজারে চাল বিক্রি করতে আসা রোহিঙ্গা মরিয়ম বলেন, গত ২০ দিনে বাসায় পাঁচ বস্তা চাল জমা হয়েছে। এত চাল আমাদের লাগবে না। প্রতিদিন চাল পাচ্ছি। তাই টাকার প্রয়োজনে দুই বস্তা চাল ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে দিয়েছি।

রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিক্রির ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বালুখালী ক্যামপ ইনচার্জ সোহেল রানা বলেন, চেকপোস্টগুলোতে প্রতিদিন ত্রাণসহ লোকজন আটকের ঘটনা ঘটছে। আমরা বিষয়গুলো নজরদারির মধ্যে রেখেছি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, সারাক্ষণ মনিটরিং রাখতে হলে তিন থেকে চারশ’ সার্বক্ষণিক বাড়তি লোক দরকার যা নেই। তিনি বলেন, অনেক জায়গাতেই রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের কাছে অথবা আগে যারা এসেছেন তাদের কাছে ত্রাণ বিক্রি করে দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে বুধবার থেকে সাত দিন ব্যক্তি ও অন্য বেসরকারি সংস্থার ত্রাণ বিতরণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেও জানান মোহাম্মদ আলী হোসেন। তিনি জানান, আগামী এক সপ্তাহ দেশি-বিদেশি সকল সংস্থা ত্রাণ বিতরণ স্থগিত রাখবে। তবে কোন রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে ত্রাণ সংকট দেখা দিলে সরবরাহেরও ব্যবস্থা থাকবে। এডিসি আশরাফ বলেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা দেশি-বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে খাদ্যসহ নানা সামগ্রী ত্রাণ হিসেবে পর্যাপ্ত সহায়তা পেয়েছে। এখনো পর্যন্ত এ ত্রাণ সহায়তা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। অনেকের বাসায় মজুত রয়েছে চাহিদার অতিরিক্ত খাদ্যপণ্য। তিনি বলেন, মজুদ থাকা অতিরিক্ত এসব খাদ্যপণ্য রোহিঙ্গারা ক্যাম্পসহ বাইরে এনে স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করছে। স্থানীয় অনেক হাট-বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে ত্রাণের এসব খাদ্যপণ্য। এ নিয়ে প্রশাসন আগামী এক সপ্তাহ পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণ বন্ধ রাখতে দেশি-বিদেশি সকল সংস্থার প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে। এডিসি আশরাফ বলেন, বিতরণ বন্ধ রাখার এ নির্দেশিত সময়ে যদি কোন রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে ত্রাণের সংকট দেখা দেয়; তাহলে প্রশাসন বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ওই রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিতে ব্যবস্থাও নিয়েছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=95984