১৩ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:৫১

দুষ্টচক্র পরিকল্পিতভাবে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করছে না

আজিমপুরের বাসিন্দা গৃহবধূ ফারাহ মাহজাবিন শখ করে বাজার থেকে স্বামীকে দিয়ে বড় ইলিশ মাছ কিনিয়ে এনেছেন। গতকাল মঙ্গলবার তার স্বামী এজাজ আহমেদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই স্বামী ও সন্তানকে নিজ হাতে মাছ রেঁধে খাওয়াবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু বিধি বাম। চুলায় ভাত আর ডাল চড়াতেই ধূপ করে চলে গেল গ্যাস। ফারাহ বারবার গ্যাসের চুলা জ্বেলে দেখছেন গ্যাস এসেছে কিনা।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, শুধু আজ না গত কয়েকদিন যাবৎ গ্যাসের সংকটে রান্নাবান্না করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। রাতের বেলা কিছুটা গ্যাস থাকলেও সকাল ৯টার পর থেকে গ্যাস থাকে না। কখনও কখনও টিপটিপ করে চুলা জ্বললেও সেই গ্যাসে কোন কিছু রান্না করা সম্ভব হয় না। কবে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব কে জানে বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি।

সেগুন বাগিচার একটি ক্যান্টিনের বাবুর্চি বেলাল হোসেন প্রতিদিন প্রায় ৪শ মানুষের রান্না করেন। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সকাল থেকে গ্যাস সংকটের কারণে রান্নায় মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে। বেলাল হোসেন গতকাল মঙ্গলবার দৈনিক সংগ্রামকে জানান, গত কয়েকদিন ধরে সেগুন বাগিচা এলাকায় গ্যাস সংকট চরমে। সকাল বেলায় অনেক খাবার হোটেল বন্ধ থাকে। কবে সংকট নিরসন হবে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
শুধু আজিমপুর আর সেগুন বাগিচা নয় শীত আসতে না আসতেই রাজধানীর বিভিন্নএলাকায় দেখা দিয়েছে গ্যাস সংকট। পুরান ঢাকার লালবাগসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে প্রতিটি পরিবারকে রান্নাবান্নার কাজে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কখনও রান্না শেষ হওয়ার আগে আবার কখনও রান্নার মাঝ পথে গ্যাস চলে যাচ্ছে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে পুরান ঢাকার লালবাগসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের মারাত্মক সংকট চলছে। গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় গ্যাসের লাইনে চাপও কম। ফলে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গ্যাস থাকছে না।
গ্যাস সংকটের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাসের ধানমন্ডি জোনের কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন। তিতাসের একজন কর্মকর্তা জানান, সাধারণত শীতকালে ঠান্ডায় গ্যাস জমে যাওয়ায় লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন অবৈধ সংযোগের কারণে গ্যাস লাইনে লিক করলে গ্যাসের স্বাভাবিক সরবরাহ ব্যাহত হয়। তবে এবার শীত আসার আগেই গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে বলে তিনি জানান।
রাজধানীতে প্রতিবছর শীতের শুরুতে এ সংকট দেখা দেয়। শীত বাড়লে সংকটও বাড়ে। তবে এ বছর গ্যাস সংকট তীব্রতর হয়ে উঠেছে। সকাল-সন্ধ্যায় গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় বাসাবাড়িতে রান্নাবান্না বন্ধ থাকেÑ নাগরিক জীবনে এ এক চরম ভোগান্তি।

রাজধানীসহ আশপাশের জেলাগুলোতে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বলছে, শীতে এমনিতেই গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সংকটও বাড়ে। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় উৎপাদনও কম হচ্ছে। ফলে সংকট সহজে নিরসনের কোনো উপায় নেই।
তেজগাঁও পূর্ব তেজতরি বাজার এলাকার বাসিন্দা হাবিব রহমান বলেন, তাদের ফ্ল্যাটে একেবারেই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। তীব্র সংকট চলছে। হোটেল থেকে খাবার এনে তাদের খেতে হয়। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, যদি গ্যাস না পাওয়া যায় তবে কর্তৃপক্ষ বলে দিলেই পারে। বিলও পরিশোধ করতে হবে। আবার গ্যাসও পাওয়া যাবে নাÑ এটা হতে পারে না।
পশ্চিম হাজীপাড়ার বাসিন্দা আনিসুজ্জামান বলেন, তাদের এলাকায় দিনের বেলা গ্যাস থাকে না। রাত ১২টার পর আসে। তাও আবার না আসার মতো অল্প অল্প করে জ্বলে। তিনি বলেন, প্রতিবছরই শীত এলে গ্যাস নিয়ে চরম সংকট পোহাতে হয়। এ বছর তা আরও তীব্র হয়েছে।
নয়বাজার এলাকার গৃহিণী আলো আক্তার বলেন, গ্যাসের কারণে রাজধানীতে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। এতে করে জনজীবনে নেমে এসেছে চরম ভোগান্তি । রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকার বাসাবাড়িতে সকাল থেকে দিনের অধিকাংশ সময় গ্যাসের চুলা জ্বলে না। বিকাল ৪টার পর টিমটিম করে চুলা জ্বললেও সন্ধ্যার পর আবার বন্ধ হয়ে যায়।

গত এক সপ্তাহে রাজধানীর মুগদা, রামপুরা, উলুন, বাড্ডা, বনশ্রী, কাওলা, উত্তরা, শাহজাহানপুর, রায়ের বাজার, ট্যানারি মোড়, শাহীনবাগ, মিরপুর, পল্লবী, শ্যামলী, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, শাঁখারী বাজার, গোয়ালনগর, মালিটোলা, লালবাগ, চকবাজার, ইসলামপুর, দারুসসালাম, কাজীপাড়া, গোড়ান, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, ধনিয়া এলাকায় গ্যাস সংকট চলছে। কিছু কিছু এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সংকট চলছে।
সূত্র জানিয়েছে, শীতকালে গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। এ ছাড়া গ্যাস সংকটের আরেক কারণ হলো অপর্যাপ্ত ও অনুন্নত বিতরণ ব্যবস্থার কারণে গ্যাসের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ কারণে নষ্ট হচ্ছে এসব মূল্যবান গ্যাস। তাছাড়া দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র ও আন্তর্জাতিক মহলের চাপে দেশে বিপুল পরিমাণ গ্যাস থাকলেও রহস্যজনক কারণে তা উত্তোলন করা হচ্ছে না। তাদের বক্তব্য মূলত দেশের শিল্পকারখানা ধ্বংস ও গার্মেন্ট কারখানার অর্ডার কেড়ে নিতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট পরিকল্পিত ও ইচ্ছাকৃতভাবে গ্যাসের ব্যবহার নিশ্চিত করছে না।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, গ্যাসের অভাবে দিনের পর দিন বাসাবাড়িতে রান্না বন্ধ থাকলেও নির্বিকার তিতাস কর্তৃপক্ষ। বাসাবাড়ি, সিএনজি স্টেশন ছাড়াও তীব্র গ্যাস সংকটে ধ্বংস হচ্ছে শিল্প-কারখানাও। শিল্পে নতুন সংযোগ বন্ধ রাখাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েও সংকট নিরসন করা যাচ্ছে না। বরং দিন যতই গড়াচ্ছে গ্যাসের সংকট বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বিপাকে পড়েছেন গ্যাস সংকটের কারণে। এদিকে রাজধানী ছাড়াও গাজীপুর, সাভার, কোনাবাড়ি, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার শত শত শিল্প-কারখানা গ্যাসের কারণে ২০ থেকে ৩০ ভাগও উৎপাদন করতে পারছে না। কারখানায় শ্রমিক আছে, মেশিন আছে, শুধু গ্যাস নেই। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬-১৭ ঘণ্টা গ্যাস থাকে না।

সরকারি হিসাবে বর্তমানে যে পরিমাণ সংযোগ আছে তার জন্য প্রতিদিন অতিরিক্ত গ্যাস প্রয়োজন কমপক্ষে ৫০ কোটি মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে দৈনিক গড়ে ২ হাজার ৩০৫ মিলিয়ন ঘনফুট। গড়ে ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি ঘাটতি চলছে। বেসরকারি হিসাবে এই ঘাটতি আরও বেশি। সরকারি হিসাবে দৈনিক চাহিদার পরিমাণ কমপক্ষে ২ হাজার ৩৫৪ মিলিয়ন ঘনফুট।
পশ্চিম রামপুরার বাসিন্দা রাবেয়া বেবী বলেন, কয়েক দিন ধরে ভোরেই গ্যাস চলে যায়। আসতে আসতে গভীর রাত। এ কারণে বাসায় চুলায় রান্না হয় না। হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হয়।
মিরপুর কাজীপাড়ার গৃহবধূ আখি আক্তার জানান, বাধ্য হয়েই প্রতিদিন গভীর রাতে তাকে রান্নার কাজ করতে হয়। এ কারণে দিনের বেলায় গ্যাস থাকে না। এভাবে রাত জেগে থাকতে গিয়ে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে গেছেন।
পাইকপাড়া, শেওড়া পাড়ায়ও সকাল ৭টা-৮টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা-৬টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। ঝিগাতলা কাঁচাবাজার এলাকার তামিম হোসেন জানান, সকাল সাড়ে ৯টা-১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ওই এলাকায় গ্যাসের কম চাপ থাকে। তা দিয়ে রান্না করা যায় না। এক হাঁড়ি পানি গরম করতে লেগে যায় ৩ ঘণ্টা।

উত্তর শাহজাহানপুরের বাসিন্দা গৃহবধূ সায়েমা বেগম জানান, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না বাসায়। কেরোসিন স্টোভে রান্না করতে হয়। বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা ফখরুল হোসেন জানান, তার এলাকায় প্রায় ৬ ঘণ্টা গ্যাসের প্রেসার থাকে না। ক্রমাগত গ্যাস সংকটে ওই এলাকায় এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে।
টিকাটুলি অভয় দাস লেনের বাসিন্দা আফরোজা বানু বলেন, সকাল ১০টার পর চুলা জ্বলে না। দুপুরের রান্না করতে হয় ভোর থেকে। সারাদিন গ্যাস থাকে না । রাত ১০ টার পর গ্যাসের চাপ বাড়ে। গ্যাসের সমস্যার কারণে গভীর রাতে রান্না করেন অনেকেই। কিন্তু গত দুই দিন তা-ও সম্ভব হয়নি- এমন মন্তব্য করেন ধলপুরের রহিমা বেগম। বাধ্য হয়ে তিনি কেরোসিনের চুলা কিনে এনেছেন।

এদিকে দেশে মোট গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও গ্যাসের উৎপাদন হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন থেকে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যে। ফলে গড়ে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সংকট বিরাজমান। এছাড়া সরকার সম্প্রতি প্রায় সাড়ে তিনশ শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ দিয়েছে। কয়েকটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর অপেক্ষায় আছে। ফলে গ্যাস সংকট বাড়ছে। এদিকে আরও অন্তত দুই হাজার শিল্প-প্রতিষ্ঠান গ্যাস সংযোগ ও নতুন লোড বৃদ্ধির অপেক্ষায় আছে, কিন্তু বাড়তি গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে সাধারণভাবেই বলা যায়- অদূর ভবিষ্যতে গ্যাস সংকট আরও তীব্র হবে।

http://www.dailysangram.com/post/310979