১৩ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:৪৯

খেলা দেখায় পুতুল নাচায়

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : বর্তমান সরকার জনগণ থেকে যে কতটা বিচ্ছিন্ন হয়েছে তা তারা আঁচ করতে না পারলেও আমরা নাগরিকরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এই বিচ্ছিন্নতা সর্বব্যাপী এবং শোষণমুখী। সরকার জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন তো দূরের কথা, সাধারণ বাজার নিয়ন্ত্রণে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। চালের কেজি ৭০ টাকা, এই ভরা মৌসুমেও তরিতরকারির কেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা। পিঁয়াজের কেজি ১২০ টাকা। সরকারের সেদিকে কোনোরকম খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। দিন-রাত ২৪ ঘন্টা সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে নেতা-পাতিনেতারা কেবল বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন। ভাবখানা এরকম যে, লিখে দিলাম কলার পাতে, ঘোরো গিয়ে পথে পথে। সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে যখন সরকারের প্রতিটি লোকই নিমজ্জিত, যখন রডের বদলে বাঁশ দিয়ে ভবন নির্মাণ হয়, যখন রাস্তা নির্মাণে দেয়া হয় পীচের বদলে পোড়া মোবিল, তখন সরকার একেবারেই চুপ করে থাকে। ২০০০ কোটি টাকার প্রকল্প শেষ করতে যেখানে লাগে ১৩ হাজার কোটি টাকা। ফ্লাইওভার, সড়ক, রেলপথ নির্মাণে দুর্নীতির কারণে যেখানে খরচ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, সেখানে বিনা প্রমাণে বিএনপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করে চলেছে। কেউ বলছেন, বিএনপি ১২০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করছে। আবার সরকারের কোনো চামচা বলছে, বিএনপি ১২ বিলিয়ন ডলার দুর্নীতি করেছে। ১২০০ কোটি টাকা আর ১২০০ কোটি ডলারের মধ্যে কী পার্থক্য, সেটি বোঝার ক্ষমতা সম্ভবত ওবায়দুল কাদেরের নেই।

যেমন সাম্প্রতিক সময়ে তাদের অভিযোগ- বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সৌদি আরবে নাকি বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। বিএনপির তরফ থেকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে যে, জিয়া পরিবারের বাংলাদেশের বাইরে কোনো সয়সম্পত্তি নেই। প্রমাণ দিন তা না হলে বিএনপি আইনি ব্যবস্থায় যাবে। আওয়ামী চোঙ্গাদের প্রমাণ লাগে না। এখানে এক শিয়ালে রা করলে সকল শিয়াল একসঙ্গে রা রা করে ওঠে। এখন সে কাজই চলছে, প্রমাণ নেই, চাপা চলছে। বিএনপি বা জামায়াতের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আনা হয়, তার কোনোটাই প্রমাণ করা যায় না। বিএনপির সিনিয়র ভাইস- চেয়ার পারসন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। কিন্তু সরকার এ পর্যন্ত একটিরও প্রমাণ করতে পারেনি। তারা কথার তুবড়ি ফুটিয়েই চলেছে। আর জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করার জন্য গুম, খুন, পাইকারি গ্রেফতার এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কে কখন কোথায় গুম হয়ে যাবে, কে কাকে কখন তুলে নিয়ে যাবে, সেটা বুঝবার কোনো উপায় নেই। কোন বাহিনীর উপর কোন বাহিনী অধিকতর শক্তিশালী সেটা বোঝা দুষ্কর। সম্প্রতি কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহারের ভাষ্য থেকে আর একবার তা প্রমাণিত হয়েছে।

ফরহাদ মজহার যখন অপহৃত হয়েছিলেন তখনও সংবাদপত্রে এর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। র্যা ব যখন তাকে উদ্ধার করে তার নিরাপত্তার জন্য খুলনার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন সাদা পোশাকের আরেক বিশেষ বাহিনী ট্রাক দিয়ে তাদের যাত্রা পথ রোধ করেছিল। এ খবর তখনও ছাপা হয়েছিল। কারা এই সাদা পোশাকের বাহিনী, যে পুলিশ র্যা বের চেয়েও অধিক শক্তিশালী? সেটা বোঝা যায় না। ফরহাদ মজহার আশঙ্কা করেছিলেন তাঁকে ভারতে পাচার করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও এমন আশঙ্কা করেছিলেন যে, তাকে ভারতে পাচার করে দিলে বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটতে পারতো। কিন্তু আমরা এসব বাহিনীর সন্ধান জানি না। এই যে গুম হয়ে যায় একেক জন লোক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার দাবি করে যে, তাঁদের তুলে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সে কথা স্বীকার করে না। কখনও কখনও তাদের তুলে নেয়া হয় সন্ধ্যায়। সকালে পাওয়া যায় লাশ। বলা হয় ক্রসফায়ারে মারা গেছে। কখনও কোনো সন্ধানই পাওয়া যায় না। সম্প্রতি অপহৃত হয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। কেন কি কারণে অপহৃত হলেন কেউ বলতে পারে না। কারা তাকে তুলে নিয়ে গেল সরকারও কি তা বুঝতে পারে না? নাকি সরকার তাদের কাছে অসহায়?

একজন পাঠক ফোন করে আমাকে জানান যে, তিনি বিমানবন্দর সড়কে খিলক্ষেত অংশে সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে একটি অপহরণের ঘটনা দেখেছেন। রাস্তায় অসম্ভব ট্রাফিক ছিল, গাড়ি চলছিল ধীরে। তিনি দেখতে পান যে, বিপরীত দিকের একটি গাড়িকে সামনে একটি মোটর সাইকেল গিয়ে থামতে বাধ্য করে। গাড়িটি যখন থামে, তখন পেছন থেকে তিন জন সাদা পোশাকের লোক ছুটে গিয়ে ওই গাড়িতে উঠে পড়ে। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো গাড়িটি কাউকে ধাক্কা দিয়েছে। তাই হয়তো গাড়িটিকে থামানো হয়েছে। ততক্ষণে তিনি এলাকাটি পার হয়ে যান। তার পর সম্ভবত তারা খিলক্ষেতের দিকে চলে যায়। সংশ্লিষ্ট পাঠকের সন্দেহ, ওই ব্যক্তিটিই সম্ভবত ছিলেন মারুফ জামান। তার গাড়ি খিলক্ষেতের তিন শ’ ফুট রাস্তার পাশে পাওয়া যায়। যেখানে ঘটনাটি ঘটে তার পাশেই খিলক্ষেত যাবার ফ্লাইওভার। এরা সংঘবদ্ধ শক্তিশালী। এবং তারা নিশ্চয়ই মারুফ জামানের কাছ থেকে কোন গোপন তথ্য চায়। সেই কারণে তার বাসায় ফোন করিয়ে ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের হার্ডডিস্ক তাদের কাছে হস্তান্তর করতে বলেন। ধরা যাক, তার বিরুদ্ধে কোনো সন্ত্রাসমূলক কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে, তাহলে সেই সূত্রেই তাকে গ্রেফতার করা যাবে না কেন? কেন তাকে অপহরণ করে গুম করে রাখতে হবে? এই প্রশ্ন সবার।
কিন্তু সরকার এরকমই কণ্টকিত পথে এগুচ্ছে। গুম হয়ে যাচ্ছে মানুষ, অপহৃত হচ্ছে হরহামেশা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অপহরণ করতে গিয়ে, মুক্তিপণ আদায় করতে গিয়ে ধরা পড়ছে। গণপিটুনির শিকার হচ্ছে। তাহলে মানুষ কোথায় কার কাছে যাবে? সরকারের কাছে যাবে? এখানে তো সরকার নাগরিকদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড়িয়ে গেছে। মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সে দায়িত্ব দিতে সরকার সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। কিংবা কোনো কোনো বাহিনীর উপর সরকারের কি নিয়ন্ত্রণ নেই? বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমদ কি করে ভারতে পাচার হয়ে গেলেন? সরকারের তরফ থেকে তার কোনো ব্যাখ্যা কোনোদিন দেয়া হলো না। কেন? সম্ভবত ব্যাখ্যা দেয়ার মতো কোনো কিছুই সরকারের হাতে নেই বা নিয়ন্ত্রণে নেই।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা যদি ধরি তাহলে ভেবে আশ্চর্য হতে হয়, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। এখন ধান চালের মৌসুম, কিন্তু চালের দাম কমছে না কেন? ৭০ টাকা কেজি চাল কিনে খাবার ক্ষমতা কয়জন সাধারণ মানুষ রাখে? সবজির বাজার কেন নিয়ন্ত্রণহীন সরকার জানে না। পেঁয়াজের মূল্য কেন ১২০ টাকা, সরকার বলতে পারে না। লাট-বাহাদুর সরকার ঠ্যাঙ্গের উপর ঠ্যাঙ তুলে নির্বিকার বসে আছে। আগে তো দেখেছি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকলে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিত। যেমন এই পেঁয়াজের বাজারে আগেও আকস্মিক মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে। তখন আমরা দেখেছি, সে সময়ের সরকার দ্রুত পেঁয়াজ আমদানি করে ট্রাক সেলের মাধ্যমে তা সাধারণ মানুষকে দেবার আয়োজন করতো। বাজার নিয়ন্ত্রণে আসতো। এবার সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেই। বাণিজ্য মন্ত্রী টু শব্দটি পর্যন্ত করছেন না। চুপ করে বসে আছেন। কেন? জনগণের ভোগান্তি হলে সরকারের কি যায় আসে? এর আগেও আওয়ামী লীগ আমলে যেমন পেঁয়াজের অত্যধিক মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছিল, তখন, যতদূর মনে পড়ে, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন পেঁয়াজ না খেলে কি হয়? তিনি তো পেঁয়াজ ছাড়া মাংস রান্না করেছিলেন। ভাগ্যিস, এখনো কেউ বলেননি যে, ভাত না খেলে কি হয়? কিন্তু আটার দামও অনেক বেশি।
এরকম যখন পরিস্থিতি, তখন সরকার একটি ভেল্কি লাগিয়ে দেয়। বিপিএল-এর খেলা শুরু করে, কিংবা কোনো টেস্ট সিরিজ কিংবা টি-২০ লাগিয়ে দেয়। এবার তো আরো মজার কা- ঘটলো। যখন জনগণ এরকম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে, তখন হংকং থেকে সোফিয়া নামের এক পুতুল নিয়ে এসে তাকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা গাওয়ানো হলো। যেন রোবট সোফিয়া কথা বললে মানুষের সকল দুঃখ দুর্দশা দূর হয়ে যাবে আর ক্ষুধা ভুলে, দ্রব্যমূল্যের কথা ভুলে পেঁয়াজের মূল্য ভুলে মানুষ সোফিয়া সোফিয়া বলে উল্লাসে নৃত্য করতে থাকবে। এ সম্পর্কে নাগিরক ঐক্যের প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ১২ কোটি টাকা খরচ করে এক পুতুল এনে তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা গাওয়ানো চরম ভাঁওতাবাজি। কিন্তু সরকার মানুষকে ভুলিয়ে রাখার জন্য এভাবেই ভাঁওতা দিয়ে যাচ্ছে। আমরা খেলা দেখতে চাই না, রোবট পুতুল কথা বলেছে কি বলেনি, প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছে কি করেনি, সেটা আমাদের কাছে ইস্যু নয়Ñ আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় ইস্যু নিরাপদ জীবন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, গুম-খুনের হাত থেকে রেহাই Ñএসব। পুতুল নাচ আমাদের ক্ষুধার অন্ন যোগান দেবে না।
কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য এই যে, এই পুতুল নাচ মানুষের মনে তেমন কোনো সাড়া জাগাতে পারে নাই। টেলিভিশনের পর্দায় আমরা দেখেছি পুতুল কথা বলছে, পত্রিকায় পুতুলের কথোপকথনের রিপোর্ট দেখেছি। কিন্তু অমনি তা ভুলে গেছি। যখন থলে হাতে বাজারে যাই, তখন রংপুর না কুমিল্লা জিতলো সেটা চিন্তার বিষয় থাকে না। পুতুল প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করলো কি করলো না ভাবতে পারি না। তাছাড়া মানুষ তো জানেনই অনেক আগেই কথা বলার শক্তিসম্পন্ন রোবট উদ্ভাবিত হয়েছে। মানুষ কল্পনা করেছে তারও আগে। দু’ তিন যুগ আগে একটি সিনেমা হয়েছিল। তার নাম ছিল ‘বায়োসেন্টিনিয়াল ম্যান’। সেখানে একটি পুরুষ রোবট এতটাই মানুষের মতো আচরণ করছিল যে, সে এক বিজ্ঞানীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। এমন মানুষের স্বীকৃতির জন্য সে পুতুল আদালতে মামলাও করেছিল। শেষ পর্যন্ত আদালত তাকে মানুষের স্বীকৃতি দিয়েছিল। তার নাম দেওয়া হয়েছিল দুই শ’ বছর বয়স্ক মানুষ। সুতরাং পুতুল সোফিয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। এ কেবলই আমাদের ধোঁকা দেয়ার, দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা। কিন্তু আখেরে এসবে কোনো ফল হয় না। সরকার জনগণের দিকে না তাকালে জনগণও মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর প্রতি নির্বাচনই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হবার সম্ভাবনার অতি ক্ষীণ। তাই সাধু সাবধান!

 

http://www.dailysangram.com/post/311017