১১ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৫:১৮

অসন্তোষ চরমে বিআরডিবিতে

এ মাসেই ৩৮ বদলি ; শোকজ ও বরখাস্ত আতঙ্ক

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে (বিআরডিবি) অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করেছে। কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা, সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে জুনিয়রদের পদোন্নতি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন জেলায় হুটহাট বদলি করা, শ্রমিকদের নামে মামলা, সাময়িক বরখাস্ত ও শোকজ করাসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছে। এ মাসেই সাত দফায় ৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিভিন্ন জেলায় বদলি করা হয়েছে। এতে অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বদলি আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফলে ঢাকা ও রাজধানীর বাইরে বিআরডিবির দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

গতকাল দুই দফায় কুষ্টিয়া কার্যালয় থেকে ঝালকাঠি, নরসিংদী থেকে বরগুনা, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থেকে সিরাজগঞ্জ এবং বরগুনার আমতলী থেকে পটুয়াখালী জেলাদফতরে তিন কর্মকর্তা এবং একজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে বদলির আদেশ জারি করা হয়েছে। ৭ ডিসেম্বর ১৯ কর্মকর্তাকে সদর দফতর ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বদলি করা হয়। এর আগে ৫ ডিসেম্বর দুই দফায় ছয় কর্মকর্তা ও পাঁচ কর্মচারী এবং ৪ ডিসেম্বর দুই দফায় তিন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। ২৮ নভেম্বরে বিআরডিবির সিবিএ সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ও যুগ্ম সম্পাদক এ কে এম রফিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই সাথে তাদের যথাক্রমে চট্টগ্রাম, মেহেরপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলায় বদলির আদেশ দেয়া হয়েছে। গত মাসেও কয়েক দফায় বদলি ও বরখাস্তের ঘটনায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং বদলি দিন কাটান।
এ প্রসঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক এ কে এম রফিকুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, এই বরখাস্ত ও বদলির আদেশ বেআইনি। শ্রম আইনের ১৮৭ ধারা লঙ্ঘন করে এই আদেশ জারি করা হয়েছে। ১৮৭ ধারায় বলা আছে, ট্রেড ইউনিয়নের কোনো নেতাকে তাদের মতামত ছাড়া অন্য জেলায় বদলি করা যাবে না। নতুন করে এসব বদলি ও বরখাস্ত করায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অস্থিরতা বেড়েছে। শিগগিরই বিআরডিবির এই অচলাবস্থা নিরসন না হলে সিবিএ কঠোর কর্মসূচির দিকে যাবে বলে জানিয়েছেন নেতারা। সিবিএ সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, ৯ নভেম্বর যুগ্ম পরিচালক (পরিকল্পনা) পদটি বিলুপ্ত করে যুগ্ম পরিচালক (নির্মাণ) পদ সৃষ্টি করে সেই পদে পদোন্নতি নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি সাবেক মহাপরিচালক মো: আবদুল কাইয়ুম প্রতিশ্রুত ‘মির্জাপুরে তিন কোটি ৬৬ লাখ টাকায় বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের টাকা প্রদানের বিষয়টি উঠে আসে। এ নিয়ে বিআরডিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষোভ চলছিল। যুগ্ম পরিচালক (নির্মাণ) পদ সৃষ্টি করা এবং এ পদে পদোন্নতির জন্য সিনিয়র ৮৬ জনকে বাদ দিয়ে জুনিয়র কর্মকর্তা (৮৭তম) প্রকল্প পরিচালক (ইরেসপো) মো: রাশেদুল আলমের নাম সুপারিশ করায় পদোন্নতি বাতিল চেয়ে মহাপরিচালকের কাছে স্মারকলিপি দেয় বিআরডিবি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। এ ছাড়াও উপপরিচালক পদের পদোন্নতির সিদ্ধান্ত বাতিল চেয়ে আদালতে দায়ের করা মামলা বিচারাধীন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গত দুই বছর থেকে নানা অনিয়মে এমনিতেই বিপর্যস্ত বিআরডিবি। এ নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারপর আবার নতুন করে সিনিয়র কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে যুগ্ম পরিচালক পদে জুনিয়রকে পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করা নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ১২ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটিতে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে মহাপরিচালক মো: আকরাম হোসেনের সাথে বিভিন্ন দাবি নিয়ে অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন ও সিবিএ যৌথভাবে সাক্ষাৎ করতে গেলে বাগি¦তণ্ডা হয়। ওই সময় সিবিএ আন্দোলন করলে চাকরিচ্যুতির হুমকি দেন তিনি। মহাপরিচালক এ সময় আওয়ামী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ ও মন্ত্রীকে নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলেন বলে সিবিএ নেতারা অভিযোগ করেন। এ ঘটনার আগে থেকে মোতায়েন করা পুলিশের সহায়তায় মহাপরিচালক বিআরডিবি কার্যালয় ত্যাগ করেন। পরদিন ১৩ নভেম্বর কর্মচারীরা পরিচালক প্রশাসন বা ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের পদত্যাগের দাবিতে বিআরডিবির সামনে মিছিল-সমাবেশ করেন। এ ছাড়া প্রকল্প পরিচালক (ইরেসপো) মো: রাশেদুল আলমের পদোন্নতি বাতিল করা, বিআরডিবির নিজস্ব তহবিলের অর্থ অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে না দেয়া, মোবাইল সিম ট্র্যাকিং বন্ধের পাশপাশি ইতঃপূর্বে যাদের বেতন কাটা হয়েছে; তাদের বেতন ফিরিয়ে দেয়া, স্বেচ্ছাচারী বদলি ও পদোন্নতি নীতিমালা বাতিল করাসহ ১৬ দফা দাবি সংবলিত স্মারকলিপি দেয়া হয়। এ ঘটনার পর তিন দিন মহাপরিচালক বিআরডিবিতে অফিস না করে মন্ত্রণালয়ে অফিস করেন। বিআরডিবি অফিসের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করায় ১১ জনকে চাকরি থেকে সাময়িক বহিষ্কার, ২০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং ৭০ জনের বিরুদ্ধে মামলা এবং ওয়ারেন্ট জারি করা হয়। রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মহাপরিচালকের করা ১৪ নভেম্বরের এক মামলায় গ্রেফতারের ভয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন অফিস না করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ওই মামলায় মাঠপর্যায়ে বিআরডিবিতে শূন্যতা এবং কাজে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বিআরডিবির সিবিএ সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা ন্যায্যদাবি দাওয়া নিয়ে মহাপরিচালকের কাছে গেলে উনি আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বের করে দেন। আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। অবিলম্বে নিঃশর্তে মামলা প্রত্যাহার এবং যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত, বিভিন্ন জেলায় বদলি ও শোকজ করা হয়েছে তাও প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় শিগগিরই কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

বিআরডিবি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি (উপপরিচালক, পদাবিক) মো: শহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা আমাদের ন্যায্যদাবি দাওয়া নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মহাপরিচালকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। আমরা কোনো সভা-সমাবেশ করিনি। বিআরডিবির প্রতি আমাদের কমিটমেন্ট আছে। আর এ কারণেই আমি তিনবার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। এ রকম অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত অনেকেই আছেন। অথচ আমাদের নামে ফৌজদারি মামলা দেয়া হয়েছে।
বিআরডিবির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব মো: আকরাম হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে অসন্তোষ অনেক আগে থেকেই ছিল। সম্প্রতি কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে সেই অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছে।
তিনি বলেন, গত ১২ তারিখে কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে তারা যা করেছেন; তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পরে তারা বের হয়ে অফিসের সামনে সমাবেশ করে বিশৃঙ্খলা করেছেন। বিষয়টি মন্ত্রণালয় অবগত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির আদেশ জারি করে চিঠি পাঠিয়েছে। মন্ত্রীর নির্দেশে কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত ও বদলি করা হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ, মন্ত্রীকে কটাক্ষ করে কেন কথা বলব। যদি এ রকম হতো তাহলে বর্তমান সরকারের সময় এত বড় দায়িত্ব পেতাম না, পদোন্নতি পেতাম না। এটা ভিত্তিহীন, সম্পূর্ণ মিথ্যা। পদোন্নতি দেয়া প্রসঙ্গে বিআরডিবির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক বলেন, এ জন্য একটি নিয়োগ বোর্ড আছে। ওই বোর্ডের সিদ্ধান্তের আলোকে রাশেদুল আলমকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/275602