১১ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৫:১৩

শহরমুখী গ্রামীণ ঢল

একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে যদি আমরা একটি সমাজে, দেশে, অর্থনীতিতে কী ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা অবলোকন ও উপলব্ধির চেষ্টা করি তাহলে ওই একই সময়ে অন্য সমাজ, দেশ ও অর্থনীতি থেকে আমাদের অবস্থানের দূরত্বের একটি তুলনামূলক ব্যাখ্যা পেতে পারি। ছেচল্লিশ বছর বয়সী বাংলাদেশের অর্থনীতি সাধারণ বিবেচনায় এখন উন্নয়ন অভিমুখী এবং স্বয়ম্ভরতা অর্জনের পথে সম্ভাবনাময় অবস্থায় থাকলেও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পোড় খাওয়া সমস্যার বিবরে তার অবস্থানের বিষয়টিও আমাদের দৃষ্টিসীমানায় আসে। এটা সঙ্গত ও স্বাভাবিক যে, তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নকামী দেশ হিসেবে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ও অগ্রগতির খতিয়ানে চড়াই-উতরাই পেরোনোর পর্ব থাকবেই। বাইরের নানা প্রভাব, ভালো-মন্দ মিলিয়ে, এ অর্থনীতির উন্নয়ন দর্শন নির্মাণ ও প্রক্রিয়ায় এসে শামিল হয়ে এর স্বকীয় সাফল্যকে শর্তসাপেক্ষ করে দিচ্ছে। এ বাস্তবতাও মেনে নিতে হয় যে অভ্যন্তরীণ এক অনির্বচনীয় অন্তঃসলিলা শক্তির জোরে বাইরের বৈরী বাতাস ও বিব্রতকর বাসনাকে উপযুক্ত মোকাবেলা করার মতো শক্তি ও সামর্থ্য এ অর্থনীতির আছে। আর সেজন্য ‘জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’ এ আত্মশক্তিতে বলিয়ান বাংলাদেশের অর্থনীতি নানা দৈব দুর্বিপাক মোকাবেলা করে টিকে আছে যেখানে সাফল্যের অন্তঃপ্রবাহ বিদ্যমান।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও পল্লীপ্রধান, কৃষিনির্ভর এবং সমাজ কাঠামো সে নিরিখে বহমান। তবে দ্রুত পরিবর্তনের পথে বটে; কিন্তু মধ্যবিত্তের বৃত্তেই এর আর্থ-সামাজিক পরিবেশ দ্রুত ভাঙা-গড়ার অবয়বে প্রবেশ করছে। বহির্বিশ্বে যখন চলছে নানা বিপরীতমুখী সাধ সাধ্যের সম্মিলন ঘটানোর প্রয়াস- বড় বড় অর্থনীতিতে মন্দা আর আরব বিশ্বজুড়ে বিভ্রান্ত বসন্তবাতাসের বিলাস, উদার আর কঠিনের সন্ধিক্ষণে যখন বিশ্বায়ন- উন্নয়ন অভীপ্সা, প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনগণ তখন উদ্বাহু অর্থনীতির আখড়ায় খিস্তিখেউড়ে এবং ভঙ্গুর সামাজিক ভিত্তির মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে, খুঁজে ফিরছে কোনো বা পথে হবে তার যাত্রা। গ্রামে এখন সাধারণ শ্রমিক মিলে না। তারা সব শহরমুখী। অথচ পাস করা বেকাররা কর্মহীন।

গ্রামবাংলার মানুষ দ্রুত নগরমুখী হচ্ছে, হতে বাধ্য হচ্ছে। গ্রামে নাগরিক সুবিধা (শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুবিধা, বিনোদন, নাগরিক নিরাপত্তা ও জীবিকা সংগ্রহ) অপ্রতুল এবং ক্রমশ দুর্লভ হচ্ছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত মানসিকতায় দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে, সেখানে পুঞ্জীভূত হচ্ছে তাবৎ সুযোগ-সুবিধা সম্পদ ও অবকাঠামো। গ্রামের মানুষের ধারণা নগরে গেলেই জীবন ও জীবিকা উপার্জনের সোনার হরিণের দেখা পাওয়া যাবে। সেখানে ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় ব্যক্তি স্বার্থ ও সুবিধার ব্যাপক অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও নগরের দিকে ছুটছে মানুষ। প্রবল জনপ্রবাহে পরিকল্পিত অবয়বে নগর গড়ে তোলা যাচ্ছে না, অবকাঠামো গড়ে ওঠার আগেই সেখানে জনস্রোতে দিকনির্দেশনা এবং মাপ-পরিমাপের সব মানদণ্ড তলিয়ে যাচ্ছে। এত মানুষের জায়গা দেয়ার কথা আগে তো ভাবা হয়নি। গত শতাব্দীতে যে অবকাঠামো তৈরি হয় তা তো সীমিতসংখ্যক অধিবাসীর জন্য, তাদের ন্যায়নীতিনির্ভরতায় সুশাসন ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার উপযোগী করেই নির্মিত হয়েছিল। এখন সেটিকে সে অবস্থায় সুবিধা সংবলিত রাখা যাচ্ছে না বা উপযোগী করা যাচ্ছে না। এখন সেখানে জনস্রোত এমন বাড়ছে যে একজনের নাগরিক সুবিধা ১০ থেকে ১৫ জন ব্যবহার করতে চাইছে। ফলে গ্রামে যেমন তার ঠাঁই মিলছে না নগরেও সে পতিত হচ্ছে ব্যাপক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। অথচ গণতান্ত্রিক পরিবেশে, স্বাভাবিক উন্নয়ন দর্শনে এ সত্যটি অস্বীকৃত থাকার কোনো অবকাশ ছিল না যে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হবে, স্থানীয়রা স্থানীয়দের উন্নয়ন ঘটাবে, অবকাঠামো গড়ে তুলবে, সুশাসন দেখভাল করবে নিজেদের বসবাসের বলয় নিজেরা নির্মাণ করবে। কর্ম ভাবনাটা সেদিকে নিয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল যে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে এবং তাহলে গ্রামের মানুষ গ্রামে থাকবে আর নগরের মানুষ নগরে। বিপুল বৈদেশিক ঋণ নিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে বটে। ফলে গ্রামের মানুষ এবং সেখানকার উৎপাদিত সব সামগ্রী এখন সহজে নগরে যাতায়াত করতে পারে, পরিবাহিত হতে পারে। এখন গড়ে ৬ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে দেশের যে কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়া যায় । যে মানুষ গ্রাম থেকে নগরে যাচ্ছে সে গ্রামে আর ফিরতে চাচ্ছে না এবং পারছেও না। তার গ্রামীণ জীবনযাপন চাহিদা এখন নগরের চাহিদার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে মহানগরের মহাচাহিদায় পরিণত হয়েছে। ফলে গ্রাম থেকে শুধু মানুষ যাচ্ছে না, নগরে তার সঙ্গে সঙ্গে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পুষ্টি প্রোটিন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। খাদ্যসামগ্রী পথে নষ্ট হওয়ার ভয়ে তাকে অধিকতর নিরাপদে পৌঁছানোর তাগিদে তাতে মেশানো হচ্ছে ফর্মালিন আর তাকে চটকদার করতে, অসময়ের ফল ফসলকে সময়ের করতে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতা থেকে সেখানে মেশানো হচ্ছে নানা ধরনের রাসায়নিক। পথেই মূল ফল ফসলের ঘটছে অপমৃত্যু। এক সময় যে ছিল গ্রামে যে ছিল নিজের জৈব সারে তৈরি শাকসবজি ও মৎস্যের অধিকারী। আর এখনও গ্রামে যারা থেকে যাচ্ছে তারা পাচ্ছে না প্রোটিন দুধ শস্য লোকবল মজুর নিজেদের জন্য। সবই চলে যাচ্ছে শহরে। এখন নগরে গ্রামীণ গান ও সংস্কৃতিতে মেশানো হচ্ছে ব্যান্ড ও বিকৃত সুর, তার মাছ মাংশ নানা উপায় উপকরণের মিশেলে কৃত্রিমতায় ফুলে ফেঁপে উঠছে, তার গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের ফেরে পড়ে অস্বাভাবিক মোটা হচ্ছে বিদ্যা-বুদ্ধি বিবেচনাহীন অবস্থায়। তার বাঁধা দোতারার চিরায়ত গান এখন কিবোর্ডের বেঁধে দেয়া হাইব্রিড সুরে বাঁধা হচ্ছে।

গ্রামের মানুষ গ্রাম থেকে বিতাড়িত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তার নিজস্ব ফলমূল, মৎস্যের মৌলিক স্বাদ থেকে। আর নগরের ব্যস্ত সব জীবনে নিজ হাতে রান্না খাবারের পরিবর্তে এসব এডালট্রেডেড খাবার খেয়ে, এসব জাঙ্ক ফুড খেয়ে জনস্বাস্থ্য আক্রান্ত হচ্ছে নানান ব্যাধিতে উদ্ভব ঘটছে জটিল সব রোগবালাই। চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে অর্থনীতিতে, প্রতারণা বাড়ছে সামাজিক চিকিৎসায়। সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর বাসস্থান ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির আবহে, তার মূল্যবোধ ও জীবন সাধনা তার চিন্তাচেতনার চৌহদ্দি এখন নগরের কিম্ভূতকিমাকার জীবন সাধনার নিগড়ে বন্দি।

বলা হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে বিল্পব ঘটে চলেছে। কোথায়? শহরে কোচিংনির্ভর বাণিজ্য বলয়ে হাইব্রিড জ্ঞান বিতরণের দ্বারা মেধাকে ছকে বাঁধা সৃজনশীল তালবাহানায়? গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যায়তনে নিবিড় শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং সেই আদর্শবান শিক্ষক তারা এখন কোথায় হারিয়ে গেলেন? গ্রামের পাস করা কতজন এখন শহরের অতি প্রতিযোগিতায় আসতে পারে বা টিকে থাকতে পারছে? সেই বিপুলসংখ্যক অপারগ শিক্ষার্থী গ্রামেই পড়ে থাকছে। সেখানে নিন্মমানের শিক্ষকের হাতে দেয়া হয়েছে মানবসম্পদ তৈরির দায়িত্ব। এখন বিদ্যালয়ে পড়ানো তেমন তো হয়ই না তাদের হাতে গাইড বইসহ এটা সেটা সবই তাদের মনোযোগ ও সৃজনশীলতাকে, ধীশক্তিকে বেঁধে দিচ্ছে, নিচ্ছে অচলায়তনের অলস মানসিকতার বিবরে। কম্পিউটার দেয়া হয়েছে, কিন্তু ব্যাপক ব্যবহার দূরে থাকুক অধিকাংশ কম্পিউটার কক্ষবন্দি হয়ে আছে থাকে ব্যবহার না জানার কারণে কিংবা ঘনঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার অজুহাতে। শিক্ষা উপকরণ দেয়ার নামে বিপুল ব্যয় হয় কেন্দ্র থেকে, শিক্ষা বৃত্তির টাকা, স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের সামগ্রী অপাত্রে পড়ছে কিনা তা দেখার যেন কেউ নেই। কাগজ কলমে বেতনের তালিকায় নিরীক্ষা ও পরিদর্শনে বিরাট আকারের বিভাগ আছে, তারা কেন্দ্রে বসে প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিবেদন ইচ্ছামত তৈরি করিয়ে নেন। এখানেও নগরে বসে পল্লীকে প্রশান্ত দেখানোর পাঁয়তারা।

শিক্ষা এখন নগরে ও গ্রামেও পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক পণ্যে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সংখ্যা বাড়ছে কিভাবে? তাদের শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষ নগরে নানা প্রতিযোগ আয়োজনের ধাঁধায় দৃষ্টিবিভ্রম ঘটাচ্ছে না তো? গ্রামে হাজার হাজার লাখ লাখ শিক্ষার্থী অত্যন্ত নিন্মমানের লেখাপড়া করতে বাধ্য হচ্ছে। এখানেও দায়ী ওই কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ ও দৃষ্টিভঙ্গি। বিদ্যায়তনের স্থানীয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এখন সবই প্রশাসন ও সেই জনপ্রতিনিধির কবজায়- যারা তার বা তাদের পছন্দমতো শিক্ষক নিয়োগ দেবেন অভিভাবক সেজে, অনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত অযোগ্য অদক্ষ শিক্ষকরা তাদের চাকরি প্রাপ্তিতে বিনিয়োজিত অর্থ উদ্ধারে ব্যস্ত, প্রশ্ন ফাঁসের উপলক্ষ তৈরি, মদদপুষ্ট পক্ষপাতিত্বের প্ররোচনায় চলছে স্কুল, তাদের কাছে পাঠ নিচ্ছে ভবিষ্যতের প্রজন্ম। প্রকৃত জ্ঞানার্জনের অবকাঠামো সেখানে অনুপস্থিত। দেশের অর্থনীতি, জিডিপি, উন্নয়ন কৌশল, আরও কত সূচক নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে- কিন্তু দেশের শিক্ষা খাতের প্রকৃত হাল-হকিকত বা সুরতহাল রিপোর্টে মনোনিবেশের সময় যেন কারো নেই। আজকের অমনোযোগী শিক্ষা আখেরে গোটা দেশ ও জাতিকে যে মেধাশূন্য পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে ছাড়বে এবং সভ্যতার সংকট তৈরি হওয়ার এই উপাদানগুলো দুঃখজনকভাবে এখনও কারও দৃষ্টি সীমানায় আসছে না। এটা একটা আত্মঘাতী অবয়ব। স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের ‘দ্য অ্যানশেন্ট ম্যারিনার’ গল্পে আত্মগ্লানিতে ভরা অতিশয় পিপাসার্ত নাবিক সমুদ্রে প্রচুর পানি পরিবেষ্টিত হয়েও পানযোগ্য পানির তীব্র সংকটময় পরিস্থিতিতে যেমন বলেছিল ‘Water water everywhere nor aû drop to drink’ তার মতো পরিস্থিতি যদি সৃষ্টি হয় তাহলে তখন দেখা যাবে অসংখ্য শিক্ষিতের ভিড়ে আমাদের সেই দরকারি শিক্ষিতের ভারি অভাব। বিদেশিদের বেঁধে দেয়া ছকে, পদ্ধতি প্রক্রিয়া অনুসরণে, বাজেটের টাকায় এক ধরনের নিষ্ফল প্রয়াস চলছে এদেশের মাটি ও মানুষের চরিত্র গঠনে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

 

https://www.jugantor.com/window/2017/12/11/178603