১১ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৫:১১

মারাত্মক হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট

আশিকুল হামিদ : মানুষের তৈরি রোবট বা যন্ত্রমানবী ‘সোফিয়া’কে নিয়ে মাঝখানে হইচই যথেষ্টই হয়ে গেলো। তৈরি করা থেকে বাংলাদেশে এনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলানো এবং বিদেশে ফেরৎ পাঠানো পর্যন্ত রাষ্ট্রের ১২ কোটি না ১৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে- এ ধরনের কিছু বিষয় নিয়েও আলোচনা কম হয়নি। আলোচনা চলছে এখনো। ওই রোবট অবশ্য বর্তমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু নয়। তা সত্ত্বেও ‘সোফিয়া’কে টেনে আনার কারণ, তাকে কেন্দ্র করে আয়োজিত ডিজিটাল অনুষ্ঠানমালায় অন্য অনেকের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি ঘোষণা শুনিয়ে জনগণকে আতংকিত করে তুলেছেন। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী বছর ২০১৮ সালের জুনে তিনি আরো একটি বাজেট পেশ করবেন এবং সে বাজেটে ‘ডিজিটালাইজেশনের’ খাতে বেশ কিছু বরাদ্দ রাখা হবে।

বলা দরকার, আতংকের সৃষ্টি হয়েছে আসলে আরো একটি বাজেটের কথা শুনে। কারণ, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার লক্ষ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করে চলেছে। এতে চমক সৃষ্টি হলেও দেশ বাস্তবে কঠিন সমস্যার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আয়-রোজগার কমে যাওয়ার পাশাপাশি লাগামহীন মূল্যষ্ফীতিতে অনেক আগেই মানুষের জিহবা বেরিয়ে পড়েছে। ঘুষ-দুর্নীতি এবং ভুল ও ক্ষতিকর নীতি ও অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সরকার নিজেই বল্পাহীনভাবে ঋণ নেয়ায় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাননি, এখনো পাচ্ছেন না। ফলে শিল্পখাত ধ্বংসের মুখে পড়েছে, বন্ধ হয়ে গেছে কর্মসংস্থান। এর প্রভাব পড়েছে রফতানি আয় এবং রেমিট্যান্সের ওপর। বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞদের অভিমত উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সব মিলিয়েই মারাত্মক মন্দার কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এখনো গলার স্বর নামিয়ে আনার নাম করছেন না।

অসত্য তারা বলতেই পারেন, অন্যদিকে প্রাত্যহিক জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতার আলোকে কিন্তু না মেনে উপায় নেই যে, দেশ আসলেও চরম মন্দার কবলে পড়েছে। মুহিত সাহেবরা বিশ^মন্দা এবং আন্তর্জাতিক বাজারের মতো কিছু গৎবাঁধা কারণের দোহাই দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেও প্রমাণিত সত্য হলো, ঘুষ-দুর্নীতির পাশাপাশি দলীয় লোকজনের পকেট ভারি করার লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে বিপুল অপব্যয়সহ সামগ্রিকভাবে সরকারের অব্যবস্থাপনাই অর্থনৈতিক মন্দাকে অনিবার্য করেছে। এ প্রসঙ্গে দেশের ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার কথা বলতেই হবে। খাতটিতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল সরকারের প্রথম বছরেই। শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং আমদানি-রফতানিসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার তখন ধুম পড়ে গিয়েছিল। এই ঋণ নিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলের লোকজন, যাদের খুব কম সংখ্যকই অর্থ ফেরৎ দিয়েছেন। ফেরৎ না দেয়ার কারণ, ঋণের টাকা মোটেও শিল্পায়নের কাজে লাগানো হয়নি। এর ফলে ব্যাংকগুলোই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, দেশের শিল্প-বাণিজ্যের খাতও স্থবির হয়ে পড়েছিল। সেই সাথে কর্মসংস্থানও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দলীয় লোকজনের পকেট ভারি করার জন্য প্রকল্প তৈরি করায় উন্নয়ন খাতে বিপুল অপব্যয়ের ছড়াছড়ি দেখা গেছে, যার কুফলও ব্যাংকগুলোকেই সইতে হয়েছে। সে অবস্থ’াই এখনও চলছে। প্রসঙ্গক্রমে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তথ্যটি হলো, ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে মুহিত সাহেবরা সীমা তো ছাড়িয়েছেনই, রেকর্ডও করে ফেলেছেন। ঋণের সুদও সরকারকে যথেষ্টই গুনতে হয়েছে। এদিকে সরকার একাই বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়ার ফলে ব্যাংকগুলো বিপন্ন হয়েছে। এখনো সে বিপদ কেবল বাড়ছেই।

কথা ওঠার কারণ হলো, যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে দেশটির ব্যাংকিং খাত। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনস্থ হয়ে পড়া বাংলাদেশে সে ব্যাংকিং খাতই ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বলা চলে, সুচিন্তিতভাবে ব্যাংকিংক খাতকে চূড়ান্ত সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই বলা হচ্ছে, সরকারের ভুল ও ক্ষতিকর নীতি এবং দলীয় বিবেচনার কারণে দেশের ব্যাংকিং খাত মারাত্মক বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদসহ তথ্যাভিজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে নীতিতে সংশোধন করার পাশাপাশি বাস্তবভিত্তিক ব্যবস্থা না নেয়া হলে ব্যাংকিং খাতই শুধু ধ্বংস হয়ে যাবে না, জাতীয় অর্থনীতিও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে এমন অবস্থার কারণ জানাতে গিয়ে বলা হয়েছে, একদিকে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও একের পর এক নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে সরকার, অন্যদিকে সরকারের অঘোষিত সহযোগিতায় একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী পুঁজি বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে পরিবর্তন করার এবং নিজেরা পরিচালক হওয়ার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ওই গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ঋণখেলাপি ও অসৎ ব্যবসায়ীরাও। লক্ষ্য হাসিলে তারা অনেকাংশে সফলও হয়েছেন। এর ফলেই একদিকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশসহ ইসলামী ধারার দুটি বড় ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে পরিবর্তন ঘটেছে, অন্যদিকে আতংকিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ আমানতকারীরা। তারা ব্যাংকগুলো থেকে তাদের জমা রাখা সঞ্চয়ের অর্থ উঠিয়ে নিতে শুরু করেছেন। অথচ ইসলামী ধারার এ দুটি ব্যাংক বহু বছর ধরে দেশের জনগণের মধ্যে সঞ্চয়ের ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি করেছিল। সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশেও ব্যাংক দুটির ছিল বিপুল অবদান। অন্যদিকে মূলত ইসলাম বিরোধী উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে সুচিন্তিত আক্রমণের শিকার হওয়ার পর দুটি ব্যাংকই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

ইসলামী ধারার প্রধান দুটি ব্যাংককে বিপন্ন করার পাশাপাশি সরকারের অন্য কিছু অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্তের পরিণতিতেও দেশের ব্যাংকিং খাত বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রাধান্যে এসেছে নতুন কয়েকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও সরকার নয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে রাজনৈতিক বিবেচনা। কিন্তু দেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারের পরিসর অত্যন্ত সীমিত হওয়ার কারণে এসব ব্যাংক মোটেও সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। কোনো কোনো ব্যাংক বরং প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই লোকসান গোনার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে উঠেছে।

উদাহরণ দেয়ার জন্য তথ্যাভিজ্ঞরা ফারমার্স ব্যাংকের কথা উল্লেখ করেছেন। সরকারি চাকরির শর্ত লংঘন করে ‘জনতার মঞ্চে’ নেতৃত্বদানকারী সাবেক সচিব ও পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে চেয়ারম্যান করে প্রতিষ্ঠিত ফারমার্স ব্যাংক সূচনাকাল থেকেই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ব্যবসা ও আমদানি-রফতানির জন্য বাণিজ্যিক ঋণের নামে ব্যাংকটি আওয়ামী ব্যবসায়ীদের হাতে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে। এসব ঋণের কোনো অর্থই ফিরে আসেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফারমার্স ব্যাংক একদিকে অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, অন্যদিকে নতুন নতুন আওয়ামী ব্যবসায়ীকে শত এবং হাজার কোটি টাকার অংকে ঋণ দেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এভাবে ব্যাংকটির ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে এসে গিয়েছিল।
উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠাকালে ঋণসহ কৃষকদের সহায়তা দেয়ার উদ্দেশ্যের ঘোষণা দিলেও ফারমার্স ব্যাংকের কাছ থেকে কৃষকরা কোনো সহায়তাই পায়নি। কৃষকদের দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি বরং আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ী নামধারীদের লুণ্ঠনের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাংকটির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। সবশেষে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে গত ২৭ নভেম্বর পদত্যাগ করে বিদায় নিয়েছেন চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন খান আলমগীর। বলা হচ্ছে, ‘মখা যুগের’ অবসান ঘটলেও ফারমার্স ব্যাংকের পক্ষে আর কখনো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া সম্ভব হবে না। এর দেয়া ঋণের কোনো অর্থও আর ফেরৎ পাওয়া যাবে না। কারণ, যারা এই ঋণ নিয়েছেন তাদের সকলেই ব্যবসায়ী নামের আওয়ামী লুটেরা।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে অন্য ব্যাংকগুলো সম্পর্কেও একই ধরনের আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গলদ ছিল আসলে এসব ব্যাংককে অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্তের মধ্যেই। কারণ, অত্যন্ত সীমিত অর্থনীতির বাংলাদেশে এত বেশি সংখ্যক ব্যাংকের লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, এখনো নেই। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে এক সমীক্ষায় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন কোনো ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও শুধু ২০১২ সালেই সরকার নয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছিল। এর ফলে দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা পৌঁছেছিল ৫৭টিতে। এ ছাড়া ছিল ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত, দুটি বিশেষায়িত এবং নয়টি বিদেশি ব্যাংক। এসবের বাইরে গ্রামীণ, আনসার-ভিডিপি, কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণসহ আরো কয়েকটি ব্যাংক এবং ৩২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও তৎপরতা চালিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মতো ক্ষুদে অর্থনীতির একটি দেশে এত বেশি সংখ্যক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাভজনক হওয়া এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সরকার সম্প্রতি আরো তিনটি নতুন ব্যাংককে অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। এগুলোর মধ্যে একটি ব্যাংকের নামের সঙ্গে ‘ইসলামী’ শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়েছে (‘পিপ্লস ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড)। বলা বাহুল্য, প্রস্তাবিত প্রতিটি ব্যাংকের সঙ্গেই ক্ষমতাসীন দলের রাঘব-বোয়ালরা জড়িত রয়েছেন। এমনকি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও একটি ব্যাংকের জন্য সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি লিখেছেন। ফলে ধরে নেয়া হচ্ছে, দেশে আরো অন্তত তিনটি নতুন ব্যাংক অনুমোদন পেতে চলেছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারের ভুল ও ক্ষতিকর নীতি এবং সিদ্ধান্তের কারণে দেশের ব্যাংকিং খাত এমনিতেই যখন বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে তেমন এক পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্তের পরিণতি ধ্বংসাত্মক হতে বাধ্য। ভীতি ও আশংকার বড় কারণ হলো, সব জেনে-বুঝেও সরকার অমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত বিদ্যমান ব্যাংকগুলোকে বিপর্যয়ের কবল থেকে উদ্ধার করার উদ্যোগ নেয়া এবং সে লক্ষ্যে দ্রুত তৎপর হয়ে ওঠা। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক বংলাদেশসহ ইসলামী ধারার দুটি প্রধান ব্যাংকের ব্যাপারে অবশ্যই নীতি ও কৌশলে পরিবর্তন ঘটানো উচিত। ব্যাংক দুটিকে তাদের প্রতিষ্ঠাকালীন নীতি ও নিয়মে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়া দরকার। না হলে এবং ঋণ ও বাণিজ্যের নামে লুণ্ঠনের বাধাহীন কারবারকে চলতে দেয়া হলে একদিকে কোনো ব্যাংকের পক্ষেই বিপর্যয় কাটিয়ে লাভজনক হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না, অন্যদিকে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে দেশের ব্যাংকিং খাত। আর ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হওয়ার অর্থই হলো দেশ ও জাতির কোমর ভেঙে যাওয়া।
প্রসঙ্গক্রমে খেলাপি ঋণ সম্পর্কেও বলা দরকার। কারণ, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে অবিশ্বাস্য হারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য-পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে জাতীয় দৈনিকগুলোতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, গত নয় বছরে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। অন্যদিকে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। সাড়ে তিন গুণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রয়েছে অবলোপনের নামে আরো ৪৫ হাজার কোটি টাকার মন্দ ঋণকে আড়াল করে ফেলার কৌশল। এই অর্থকে যোগ করা হলে দেশে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ বর্তমানে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সকল রিপোর্টে বলা হয়েছে, আইন ও নিয়ম না মেনে বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়ার ফলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এভাবে বেড়ে গেছে। ঋণের অর্থ নির্ধারিত সময়ে ফেরৎ না দিলে যেহেতু কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না সে কারণেও ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি ৫৭টি ব্যাংকের প্রতিটিই কমবেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। আশংকার অন্য এক কারণ হলো, অর্থের পরিমাণের সঙ্গে ঋণ খেলাপি ব্যক্তিদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেড় লাখের বেশি ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছেন। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নানা ধরনের যুক্তি দেখালেও গলদ রয়েছে আসলে তাদের উদ্দেশের মধ্যে। বড় কথা, খেলাপি ঋণের প্রতিটি ক্ষেত্রে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এই নেতারা প্রভাব খাটিয়ে ঋণের ব্যবস্থা যেমন করেন তেমনি আবার বাঁচিয়ে দেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কবল থেকেও। ফলে ঋণের অর্থ না দিয়েও পার পেয়ে যান খেলাপিরা। মূলত সে কারণেই বেড়ে চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি না থাকার সুযোগে ব্যাংকিং খাতের চরম অব্যবস্থাপনার কথাও বলেছেন তারা। এভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে ব্যাংকিং ইতিহাসে এক ‘বিরল ও অস্বাভাবিক বিষয়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, অবস্থায় পরিবর্তন না ঘটানো হলে দেশের ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিই মুখ থুবড়ে পড়বে।

ব্যাংকিং খাত এবং খেলাপি ঋণ সম্পর্কিত খবর অত্যন্ত আশংকাজনক হলেও ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ রয়েছে বলেই একে বিস্ময়কর বা অস্বাভাবিক মনে করা হচ্ছে না। এ যে শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অভিযোগ নয় তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে নিয়মিতভাবেই। প্রসঙ্গক্রমে শেয়ারবাজারের লক্ষ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা থেকে ঘুষ-দুর্নীতির মহোৎসবের অনেক ঘটনারই উল্লেখ করা যায়। কারণ, প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিটি কেলেংকারিতে ক্ষমতাসীনদের রথি-মহারথিরাই জড়িত ছিলেন, এখনো তারাই জড়িত রয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদগুলোর দিকেও লক্ষ্য করা যেতে পারে। সরকারের প্রথম আমলে এমন সব স্বল্প বয়সীকেই পরিচালনা পরিষদগুলোতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, যারা ব্যাংকিং-এর অ, আ, ক, খ সম্পর্কে কিছু জানেন কি না তা নিয়ে পর্যন্ত প্রশ্ন উঠেছে। তাদের প্রধান ‘যোগ্যতা’Ñ সবাই ছাত্রলীগের নেতা বা নেত্রী ছিলেন। এসব পরিচালকও ভালোই দেখিয়েছেন, যার প্রমাণ দেয়ার জন্য ‘হলমার্ক’সহ দু’চারটি মাত্র কেলেংকারির উল্লেখই যথেষ্ট। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক একাই কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ওদিকে রথি-মহারথিদের হুকুম তামিল করতে গিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তারাও ঘুষ খেয়েছেন যথেচ্ছভাবে। এভাবে সবার অংশগ্রহণেই সর্বনাশের চ’ড়ান্ত পর্যায়ে এসে গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত।

বলা দরকার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের সততা ও সদিচ্ছার অভাবই পরিস্থিতিকে এতটা ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। স্থবির হয়ে পড়েছে জাতীয় অর্থনীতি। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই বলা হচ্ছে, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের কবল থেকে রক্ষা করতে হলে সরকারকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। এজন্য শুধু ঘুষ-দুর্নীতির পথ থেকে সরে আসাই যথেষ্ট নয়, ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার দিকেও নজরদারি বাড়াতে হবে। কেবলই দলীয় পরিচিতির কারণে কাউকে ঋণ দেয়া চলবে না এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে। সেই সাথে এমন আয়োজন নিশ্চিত করা দরকার, যাতে প্রকৃত শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা ঋণের অভাবে বাধাগ্রস্ত না হন। এভাবেই একদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসতে পারে অন্যদিকে ‘কোমর’ সোজা করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে দেশের ব্যাংকিং খাত। অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে হলেও সরকারের উচিত সে লক্ষ্যে উদ্যোগী হয়ে ওঠা।

http://www.dailysangram.com/post/310741