৮ ডিসেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৪১

আমন উঠছে, তবু চড়া চালের বাজার

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে দফায় দফায় দাম বেড়েছে চালের। এরপর দুই দফা বন্যা ও ব্লাস্ট রোগে ফসলহানিকে ইস্যু করে আরো কয়েক দফা দাম বৃদ্ধি করে চাল ব্যবসায়ীরা।
চালের ঊর্ধ্বগতি মাস দুয়েক আগে নিয়ন্ত্রণে আসে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে আমন তোলার মৌসুম। ঘরে ঘরে আমন ধান উঠেছে। মিল মালিকরাও এ ধান কিনে চাল তৈরি করে বাজারজাত করা শুরু করেছে। ধান-চালের সরবরাহ বাজারে বাড়লেও দরে এর প্রভাব চোখে পড়ছে না। বরং সপ্তাহখানেক ধরে মোটা চালের দর পাইকারি ও খুচরা বাজারে ৫০ পয়সা থেকে বিক্রেতা বিশেষে দেড় থেকে দুই টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

গত ৩০ নভেম্বর সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে তিন লাখ মেট্রিক টন আমনের চাল কেনার ঘোষণা দেয়। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম তখন জানান, এবার আমন চালের উৎপাদনে খরচ পড়েছে ৩৭.০২ টাকা। এখানে দুই টাকা লাভ ধরে ৩৯ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহ করা হবে।
কৃষকদের স্বার্থের কথা বিবেচনায় সরকার এই দাম নির্ধারণ করে, যাতে তাদের লোকসান না হয়, মজুদ বৃদ্ধির ফলে ভোক্তাদের নিরাপত্তাও বাড়ে। তবে ওই ঘোষণার পরই একশ্রেণির ব্যবসায়ী নতুন করে চালের দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা শুরু করে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. আরিফুর রহমান অপু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল কিনতে যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তার সুপারিশ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। দাম বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে দুই দফায় বন্যায় কৃষকের ক্ষতির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে তারা যুক্তি দেখিয়েছে। কৃষক যাতে এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে আমনে ভালো দাম পায় সে বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছে। ’
এক প্রশ্নের জবাবে খাদ্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা চালের মজুদ বৃদ্ধি করছি। যাতে করে সামনে আরো বেশি করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে খোলাবাজারে চাল বিক্রি করতে পারি। সাময়িক একটু দাম বাড়লেও একটা পর্যায়ে এটা কমবে এবং স্থিতিশীল পর্যায়ে আসবে। ’

সরকার ৩৯ টাকা করে চাল সংগ্রহ করার ঘোষণাটি দেওয়ার দুই দিন পর রাজধানীর খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যায়, যা গতকাল বৃহস্পতিবারও পরিবর্তন হয়নি। বেশ কিছুদিন ধরে মোটা চালের দাম কমে খুচরা বাজারে ৪২-৪৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। পাইকারি মূল্য নেমেছিল ৩৭-৩৮ টাকা। গতকাল বিভিন্ন বাজারে মোটা চালের পাইকারি দাম আরো পঞ্চাশ পয়সা বেশি দেখা যায়। অর্থাৎ পাইকারিতে আগে যে চাল বিক্রি হতো প্রতি কেজি ৩৯ থেকে ৩৯ টাকা ৫০ পয়সায়, সেটা এখন বিক্রি হচ্ছে বিক্রেতাভেদে ৩৯ থেকে ৪০ টাকা দরে।
একই ধারাবাহিকতায় বিআর-২৮ চালের দাম পাইকারিতে এক থেকে দেড় টাকা এবং খুচরা বাজারে দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। আগে এই চাল বাজারে বিক্রি হতো ৫২-৫৩ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকায়। এ ছাড়া প্রকারভেদে মিনিকেট চালের দাম সর্বনিম্ন ৫৮ টাকা টাকায় নামলেও এখন সেটা আবার ৬০ টাকায় উঠে গেছে।

ধানমণ্ডির শুক্রাবাদের এক মুদি দোকানি আতিকুর রহমান বলেন, ‘এই সিজনে পাইকারি ব্যবসায়ীরা কেন দাম বাড়াল সেটা বুঝতে পারছি না। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলেই আমরা বেশি দামে বিক্রি করছি। ’ রামপুরার এক চাল বিক্রেতা ইকবাল হোসেন বলেন, ‘চালের পাইকারি বাজার একটু চড়া। এ কারণে দুই-তিন দিন ধরে দাম বেড়েছে। ’ বাড্ডার কামরুল রাইস এজেন্সির ম্যানেজার খোকন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মোটা চাল পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৯-৪০ টাকা কেজি। ’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটা স্থিতিশীল বাজারের জন্য সরকারের চালের মজুদ বৃদ্ধি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকার যদি উৎপাদন খরচ থেকে দুই টাকা বেশি দামে চাল কিনে তবে সেটা ঠিক আছে। যদি দেখা যায় উৎপাদন ব্যয় ও কেনা দামের ফারাক বেশি, সেটা কিন্তু ভোক্তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে। ’

গত বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে আমনের চালের উৎপাদন খরচ হয়েছিল ২৯ টাকা। সরকার সংগ্রহ করেছিল ৩৩ টাকা কেজি দরে। তখন দুই লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করেছিল সরকার। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে আমনের চাল উৎপাদনে খরচ হয়েছিল ২৮ টাকা, সরকার সংগ্রহ করেছিল ৩১ টাকা কেজি দরে।
নওগাঁর চাল আমদানির সঙ্গে জড়িত মেসার্স এনডি সাহার মালিক এবং নওগাঁর ধান-চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমন মৌসুমে চালের মান ভালো থাকে। বেশিদিন রাখা যায়। যে কারণে কৃষক থেকে শুরু করে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা কিছু কিছু মজুদ করে রাখে। ডলারের মূল্যের কারণে আমদানি করা চালের দামও কিছুটা বেড়েছে। এদিকে আবার সরকার একটা ভালো দামে চাল সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে। সব মিলিয়ে কিছুটা দাম বেড়েছে। ’

এদিকে বগুড়া থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বগুড়ার ধুনট উপজেলার ধেরুয়াহাটি গ্রামের কৃষক জাকির হোসেন জানান, এক বিঘা জমিতে রোপা আমন ধান চাষে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৬০০ টাকা। এর মধ্যে জমি তৈরি ৮০০ টাকা, ধানের চারা ক্রয় ৮০০ টাকা, জমিতে চারা লাগাতে দুই হাজার টাকা, জমিতে রোগবালাই দমনে ৫০০ টাকার কীটনাশক, এক হাজার ৫০০ টাকার সার, পানি সেচ ৫০০ টাকা এবং ধান কাটা ও মাড়াইয়ে তিন হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এবার প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ১২ মণ ধানের ফলন হয়েছে। বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ ধানের মূল্য এক হাজার টাকা। তবে এবার গোখাদ্যের সংকট দেখা দেওয়ায় এক বিঘা জমির খড় বিক্রি করা হয়েছে ছয় হাজার টাকা। এতে প্রতি বিঘায় লাভ হয়েছে আট হাজার ৪০০ টাকা।
কিন্তু কৃষকের হিসাবের সঙ্গে কৃষি অফিসের পরিসংখ্যানে কোনো মিল নেই। উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস ছোবাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, এক বিঘা জমিতে রোপা আমন ধান চাষ করতে মোট খরচ হয়েছে সাত হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় উৎপাদন ১৬ থেকে ১৮ মণ।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/12/08/574897