৮ ডিসেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৩৯

অর্থায়ন এখনও অনিশ্চিত

পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর

পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে অর্থায়ন এখনও নিশ্চিত হয়নি। নামফলক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দরের প্রথম যাত্রা হয়েছিল ২০১৩ সালে। পরবর্তী সময়ে পায়রাকে গভীর সমুদ্রবন্দরে রূপান্তরের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে মহাপরিকল্পনা তৈরি করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী কিছু কাজও চলছে। এর অংশ হিসেবে গত বছরের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা বন্দরের আংশিক কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

মোট ১৯টি অংশে পায়রা গভীর বন্দর বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মূল অবকাঠামো নির্মাণ, নদী খনন, বহুমুখী বা মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, চারটি কন্টেইনার টার্মিনাল ও একটি এলএনজি টার্মিনাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, রেলপথসহ শিপইয়ার্ড স্থাপন ইত্যাদি। সামগ্রিকভাবে এই বন্দর তৈরিতে মোট যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে, তার সত্তর ভাগই যাবে এসব কাজে। জানা যায়, উল্লিখিত পরিকল্পনাগুলো এখনও কাগজেই সীমাবদ্ধ। দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। যদিও সরকার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ২০১৮ সালের মধ্যে পায়রাবন্দর পুরোপুরি চালু করা এবং গভীর সমুদ্রবন্দর ২০১৯ সালে চালু করা। সূত্র জানায়, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ সম্পন্ন করতে মোট এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার প্রয়োজন। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। দাতা দেশ ও বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে এ অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু দাতাদের অর্থায়ন এখনও নিশ্চিত হয়নি। শিগগির অর্থ পাওয়া যাবে- এমন কোনো আশাও নেই। সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা সরকারের একার পক্ষে কঠিন হবে। পায়রা হবে বাংলাদেশের তৃতীয় বাণিজ্যিক সমুদ্রবন্দর।

এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য কমডোর সাইদুর রহমান সমকালকে বলেন, বিদেশি অর্থায়ন পেতে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। পায়রা বন্দরের ১৯ অংশের মধ্যে ১২টি বাস্তবায়ন করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বাকি চারটি করবে শিল্প, পর্যটন, বিদ্যুৎ ও রেল মন্ত্রণালয়। বারোটি অংশের মধ্যে সাতটি হবে জি টু জি ভিত্তিতে। আর পাঁচটি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে। কমডোর সাইদুর রহমান আরও জানান, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে এসব কাজ সম্পন্ন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পিপিপি অফিস এ বিষয়ে কাজ করছে।

পায়রা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১৫ সালে একনেকে এক হাজার ১২৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। এ বন্দর নির্মাণের প্রাথমিক কাজের ব্যয় মেটানো হচ্ছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। ইতিমধ্যে বরাদ্দের ৮০ ভাগ অর্থ খরচ হয়েছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত দেড় হাজার কোটি টাকা চেয়েছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক তায়বুর রহমান বলেন, এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের পর আলোচ্য প্রকল্পটি সংশোধনের জন্য শিগগিরই একনেকে উপস্থাপন করা হবে।

অগ্রগতির চিত্র :সূত্র জানায়, পূর্ণাঙ্গ পায়রা বন্দরেরে জন্য মোট সাত হাজার একর জমি লাগবে। এর মধ্যে ২২০ একর জমি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বাকি জায়গা অধিগ্রহণের কাজ চলছে। এই বন্দর করতে গিয়ে ওই এলাকার আশপাশের সাড়ে তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। পুনর্বাসনে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। তবে পুনর্বাসন এখনও শুরু হয়নি।

সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- পণ্য রাখার জন্য ওয়্যার হাউস স্থাপন, বন্দর উন্নয়নে যারা কাজ করছেন তাদের থাকার আবাসিক ভবন, অধিগ্রহণকৃত জায়গায় চারদিকে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, বন্দর এলাকা থেকে মহাসড়ক পর্যন্ত চার লেন-বিশিষ্ট পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ, পানি শোধনাগার স্থাপন ইত্যাদি। জানা যায়, সাতটি টাগ বোট কেনার প্রক্রিয়া চলছে। এতে আনুমানিক ব্যয় হতে পারে ২৩০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ভূমি অধিগ্রহণে ২৮৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। চার লেন রাস্তায় খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পায়রা বন্দরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে- মূল বন্দর রামনাবাদ চ্যানেল থেকে গভীর সমুদ্র পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার ড্রেজিং করা। এ কাজের জন্য বেলজিয়ামের বিখ্যাত কোম্পানি জান ডি নুলের সঙ্গে সমঝোতা সই (এমওইউ) করেছে সরকার। পিপিপিতে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে এ কাজ করা হবে। যদিও অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি। মূল বন্দর এলাকায় একটি টার্মিনাল তৈরি করা হবে। এর সঙ্গে ৬ কিলোমটিার রাস্তা ও এক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। এ জন্য নতুন করে একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এসব কাজ করার কথা।

সূত্র জানায়, পায়রা বন্দরের মূল অবকাঠামো নির্মাণের কাজ পাচ্ছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। জি টু জি ভিত্তিতে এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১৬০ কোটি ডলার বা ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। নদী অববাহিকার নাব্য রক্ষা ও পাড় সংরক্ষণের কাজ করবে চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন লিমিটেড। এক হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণ কাজের জন্য ভারতের ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল প্রাইভেট লিমিটেডকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫ কোটি ডলার বা ছয় হাজার কোটি টাকা। ভারতীয় তৃতীয় ক্রেডিট লাইনের আওতায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া বন্দর এলাকায় আবাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণের কাজ পাচ্ছে চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন লিমিটেড। আর ঢাকা থেকে পায়রা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ পাচ্ছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ডিপি-রেল। পিপিপিতে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে এ রেলপথ নির্মাণ করা হবে। রেল মন্ত্রণালায় সূত্রে জানা যায়, ঢাকা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে পাওয়া আগ্রহ প্রস্তাব (ইওআই) যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বিশদ সমীক্ষা করতে হবে।

 

http://samakal.com/economics/article/1712422