৮ ডিসেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৩০

দুস্থদের গৃহনির্মাণ প্রকল্প

১৭৬টি এনজিও ঋণখেলাপি

সরকারের গৃহায়ন তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না ১৭৬ এনজিও। দেশের ৪৫টি জেলায় ১৭৬টি বেসরকারি সেবা সংস্থা (এনজিও) এরই মধ্যে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। বছরের পর বছর এসব প্রতিষ্ঠান ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি। এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান উধাও হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে পাচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

খেলাপিদের মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই আছে ৩৭টি প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলো বিভিন্ন জেলায়। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এনজিওবিষয়ক ব্যুরো সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠান কোন খাতে কত টাকা খরচ করছে, সে ব্যাপারে নজরদারি বাড়াতে হবে। অন্যথায় বেসরকারি সেবা সংস্থাগুলোর অনিয়ম রোধ করা যাবে না।
দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বসতঘর বানানোর জন্য এনজিওগুলো ঋণ বিতরণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুস্থদের মাঝে বিতরণের জন্য ঋণ হিসেবে বেসরকারি সেবা সংস্থাগুলোকে এ টাকা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও অনেক এনজিও তা পরিশোধ করছে না। ফলে তারা খেলাপি হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন পর্যায় থেকে অনুমোদন দেয়ায় এনজিওগুলোর ওপর কারও একক কর্তৃত্ব নেই। তারা কোথায় কী করছে তা যথাযথভাবে মনিটর করা হচ্ছে না। এ সুযোগে অনেকেই অনুমোদন ছাড়াও নানা ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা এ খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঋণ বিতরণের আগে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনীয় তথ্য যাচাই করা উচিত। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ‘আমাদের দেশে এ কাজ করা হয় না।’ তিনি বলেন, কোনো তদবিরের কারণে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিলে তা আদায় করা সম্ভব নয়। ফলে ভালো উদ্দেশ্যে কর্মসূচি চালু হলেও শেষ পর্যন্ত এর সুফল আসে না। তিনি বলেন, টাকা আদায়ের জন্য মামলা করা যায়। কিন্তু তাতে খুব বেশি সুফল পাওয়া যায় না। কারণ এরা বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখে।
এনজিও ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, ১৭৬টি প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঢাকাতে ৩৭টি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। খেলাপি সংস্থাগুলোর মধ্যে ৮ বছরেও কিস্তি পরিশোধ করেনি ঝালকাঠির হিলফুল ফুযুল সমাজ কল্যাণ সংস্থা। বর্তমানে সংস্থাটির কাছে ব্যাংকের পাওনা ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কাজেই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। এছাড়া ১১ বছরেও কোনো কিস্তি পরিশোধ করেনি ঝিনাইদহের গণজাগরণ সমাজ কল্যাণ সংস্থা। ৬ বছরেও কিস্তি পরিশোধ করেনি ঢাকার ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মো. মাসুদুল আলম মুজিব যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আমাদের ডেকেছিলেন। আমরা সেখানে ঋণ পরিশোধের কথা বলে এসেছি। সেই অনুসারে চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, কিছু ঋণ পরিশোধ করা হবে। বাকিটা পুনঃতফসিলের জন্য আবেদন করেছি। ৮ বছরেও কিস্তি পরিশোধ করেনি সাভারের রিসার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ফর দ্য পিপল। সাড়ে ৬ বছরেও কোনো কিস্তি পরিশোধ করেনি হবিগঞ্জের ইন্ডিভার।

সূত্র জানায়, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বসতঘর বানানোর জন্য ১৯৯৭ সালে তহবিল গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে স্টিয়ারিং কমিটি এ তহবিলের তদারকি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন এনজিওকে ঋণ বিতরণের জন্য টাকা দেয়া হয়। শুরুতে তহবিলের আকার ছিল ৫০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত সরকার এ খাতে ৩শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে ১৬২ কোটি টাকা ছাড় করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এনজিওগুলো ২ শতাংশ সুদে তহবিল পায়। গ্রাহক পর্যায়ে তারা ৬ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়। ২২০ থেকে ৩০০ বর্গফুটের একটি ঘর বানানোর জন্য একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ ৭০ হাজার টাকা ঋণ দেয়া হয়। ১০ বছর মেয়াদে ঋণ পরিশোধ করার কথা। এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ঋণ নিয়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান উধাও হয়ে গেছে। ১০ বছরে ১ টাকাও পরিশোধ করেনি। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠান মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) মাধ্যমে লাইসেন্স নিয়ে কাজ করছিল।

এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই তহবিল থেকে বেসরকারি সেবা সংস্থাগুলোকে ১৮৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে সারা দেশে ৬৪ হাজার ১৬৯টি গৃহনির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৫১৪টি এনজিও এই তহবিলের ঋণ বিতরণ করে আসছে। এছাড়া আরও ১০২টি এনজিও তহবিলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

জানতে চাইলে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. শাহাদাৎ হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, শুধু বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে এনজিরও নজরদারি করছি। ঋণখেলাপি এসব এনজিও এমআরএ থেকে লাইসেন্স নিয়েছে। খেলাপি ৪৩টি প্রতিষ্ঠান এনজিও ব্যুরোর তালিকাভুক্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিষয়টি এমআরএ নজরদারি করছে। তবে খেলাপিদের তালিকা আমাদের কাছে পাঠানো হয়।

অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ এমআরএর হিসেবে ৬৯২টি প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু সূত্র বলছে, অনুমোদন ছাড়াও ৩০ হাজারের বেশি এনজিও ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করছে, যা একেবারেই অবৈধ। এমআরএ সূত্র জানায়, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সীমাহীন অভিযোগ রয়েছে। তবে মোটা দাগে অভিযোগ ৫টি। এগুলো হল- গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ, উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ, বিতরণ করা ঋণে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেয়া, চাকরির প্রলোভন দিয়ে জামানত হিসেবে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া এবং অনুমোদন ছাড়া ঋণ বিতরণ।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/12/08/177707