৮ ডিসেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:২৯

ফের অস্থির চালের বাজার

এইচ এম আকতার: নতুন ধান উঠলেও স্বস্তি নেই চালের বাজারে। দাম কমার পরিবর্তে উল্টো বেড়েছে। প্রায় সব রকমের চাল কেজিতে বেড়েছে ১ থেকে ২ টাকা। চালকল মালিকদের দাবি, ধানের দাম বেশি হওয়ায় চালের দাম কমছে না। মওসুমে চালের দাম কমার প্রত্যাশ এখন সুদূর পরাহত। ধান উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও কি কারণে দাম কমছে না তার কোন সদোত্তর নেই। ক্রেতা-বিক্রেতা দায়ী করছে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাকে। চালের বাজার আগের অবস্থায় ফিরবে কি না কেউ তা বলতে পারছে না।

চালের বাজার নিয়ে দিশেহারা ক্রেতারা। সারা দেশে নতুন ধান বাজারে আসতে শুরু করলেও এখনও ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজার। নতুন ধান বাজারে উঠলে কমবে চালের দাম এমনটাই্ আশা ছিল সবার। কিন্তু অধরাই থেকে গেছে সে আশা। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কোন কাজেই আসছে না। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন চালের দাম কমার পরিবর্তে বরং কেজিতে বেড়েছে ২টাকা করে।

অবশ্য মিল মালিকরা বলছেন, খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়লেও মোকামগুলোতে অপরিবর্তিত রয়েছে চালের দাম। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটরিংয়ের কথা বলছেন, তারা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, বাজার নিয়ন্ত্রনে নিয়মিত মনিটরিং হচ্ছে। চালের দাম কমে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা ক্রেতাদের। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও চালের বাজারে মূল্য বৃদ্ধি রোধ করা যাচ্ছে না। চালের বর্তমান মূল্যও অস্বাভাবিক মনে করা হচ্ছে। সরকারের নিরাপত্তা মজুদ সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছতে আরও সময় লাগবে। সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানির তোড়জোড় এখনও চলছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ছাড় দেয়ায় বেসরকারি পর্যায়েও আমদানি বেড়েছে। তারপরও শঙ্কা কাটছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম অস্থিতিশীল। এ অবস্থায় সবার দৃষ্টি এখন আমন ফসলের দিকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর দাবি করছে, চলতি বছর আমনের ফলন গত বছরকেও ছাড়িয়ে যাবে। বন্যায় আমনের কিছুটা ক্ষতি হলেও বন্যা-পরবর্তী পলি মাটির উর্বরতায় সে ক্ষতি কেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। তাহলে প্রশ্ন হলো এত ধান চাল গেলো কোথায়।

কৃষকের মতে, আমন ফসল উঠলেও চালের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমন যখন কাটার সময় হয়েছে, ঠিক তখনই চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এ বছর আমনের রেকর্ড পরিমাণ ফলন হতে পারে। কৃষি বিভাগের আশা, চলতি বছর প্রায় দেড় কোটি টন ধান উৎপাদন হয়েছে। এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে এক মাসে সরকারি- বেসরকারি মিলিয়ে ১২ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে।
এছাড়াও এক মাসের মধ্যে বিদেশ থেকে ২৫ লাখ টন চাল আসবে, কিন্তু বাজারে তার কোন ইতিবাচক প্রভাব নেই। তবে কৃষক বলছেন, আমদানি করা পর্যাপ্ত চাল বাজারে আসলেই চালের দাম কমবে। কম দামে ধান বিক্রির কোন সুযোগ নেই।

জানা গেছে, ৩ মাস অপেক্ষার পর বহু প্রত্যাশিত আমন ফসল ঘরে আসলো। কিন্তু সে আশায় এভার গুড়ে বালি। চালের দাম তো কমেনি বরং উল্টো বেড়েছে। চলতি বছর ধান উৎপাদনে বাম্পার ফলনের সুনির্দিষ্ট কয়েক কারণ রয়েছে। এগুলো হল- এ বছর পরিকল্পিতভাবেই হাইব্রিডের চাষ বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, এ বছর সারের সরবরাহ ভালো এবং দাম নিয়ন্ত্রণে ছিল। তৃতীয়ত, সেচের জন্য ডিজেলে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো এত ধান চাল গেলো কোথায়। দেশে কত চালের চাহিদা রয়েছে। বাজারে এখনও চালের সরবরাহ কম বলে মনে করছেন চালের আড়ৎদাররা।
জানা গেছে,দেশের বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণ ও অভিযান পরিচালনার চাপে চালের দাম এক ধাপ কমিয়ে থেমে গেছেন দেশীয় মিল মালিকেরা। বিক্রেতারা জানান, ২০ সেপ্টেম্বরের দিকে মিল মালিকেরা প্রথম ধাপে চালের দাম বস্তায় দেড়শ টাকার মতো কমিয়েছিলেন। পরের সপ্তাহে কমেছে আরো ২৫ টাকা। এরপর চালের দাম আর কমেনি।
সরকার এখনও বাজার নিয়ন্ত্রের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনভাবেই তারা সফল হতে পারছে না। তাদের ধারণা ছিল আমন ধান বাজারে আসলেই দাম কমে যাবে। সরকার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার অর্জিত হয়েছে। তার পর কেন চালের দাম কমছে না তা কেউ বলতে পারছে না। তবে চালের দাম যে আর কমার কোন সম্ভবনা নেই তা আর বুঝতে অসবিধা হচ্ছে না।
কৃষক বলছে এক মণ ধান উৎপাদনে তাদের খরচ হয় ৯শ থেকে এক হাজার টাকা। এর নিচে ধান বিক্রি করলে তাদের লোকসান গুণতে হবে। কিন্তু তারা কোনভাবেই আর লোকসান গুণতে রাজি নয়। সরকারের ধারনা ছিল ধানের দাম আগের মত ৭’শ টাকা হতে পারে। আর মিল মালিকরা বলছেন এবার এক হাজার টাকায় এক মণ ধান পাওয়া যাবে না।
তাহলে কিভাবে চালের দাম কমবে? ধান কিনা থেকে শুরু করে ক্রেতার রান্না ঘর পর্যন্ত আসতে খরচ পড়ে ৪৮-৪৯ টাকা। মিল গেটে তা বিক্রি হয়ে থাকে ৫২ টাকায়। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা তা কিনে থাকেন ৫৫-৫৬ টাকা। আর খুচরা বিক্রি হয়ে থাকে ৬০-৬২ টাকায়। এর নীচে কোনভাবেই চালের দাম আসবে না। সরকার যদি বাজার নিয়ন্ত্রন করতে চায় তাহলে অবশ্যই বতুর্কি দিতে হবে।

খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দিন রাজধানীতে ১০৯টি ট্রাকে চাল বিক্রি করা হলেও মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিক্রি করা ট্রাকের সংখ্যা কমে এসেছে ৩০ এর কোটায়। দিন দিনই কমছে চাল বিক্রির পরিমাণ। গত এক সপ্তাহে সারা দেশে মোট চাল বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৪শ ৪৫ টন।
আগাম বন্যা, হাওরে ফসলহানি এবং সরকারের মজুদ কমে যাওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ২০ জুন চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপরও বাজার স্বাভাবিক না হওয়ায় ঠিক একমাস পরই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাকিতে চাল আমদানির সুযোগ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেও কাজের কাজ কিছু না হলে আগস্ট মাসে ১০ শতাংশ শুল্ক নামিয়ে আনা হয় ২ শতাংশে।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, জুন এবং জুলাই এই দুই মাসেই সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয় ১৩৫ কোটি টাকা। দ্বিতীয় দফায় শুল্ক ছাড়েরর ফলে সাময়িক হিসাবে আরো ৬৫ কোটি টাকা রাজস্ব হারায় সরকার। সবমিলে রাজস্ব ক্ষতি প্রায় ২শ কোটি টাকা। কিন্তু বিপরীতে বাজার দাম তো কমেইনি বরং দফায় দফায় তা বেড়েছে।
সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে চাল আমদানিতে এই সুবিধা দেয়া হলেও বাস্তবে এর সুফল গিয়েছে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের পকেটে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি পর্যায়ে চালের শুল্ক প্রত্যাহারের ফলে পণ্যটির দাম কমেছে সামান্য। সরকারের পক্ষ থেকে খোলাবাজারে চাল বিক্রি হলেও দাম তুলনামূলক বেশি।
এদিকে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণের পরও চালের দাম কমছে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এটিই যেন চালের স্তিতি অবস্থা। চালের দাম নিয়ে সরকার আর কোন কথা বলছে না। মনে হচ্ছে বাজার সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রনে রয়েছে।

এ বিষয়ে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করছেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম কিছুটা কমলেও সমন্বয়ের অভাবে খুচরা ব্যবসায়ীরা চালের দাম কমাননি।
এদিকে বুধবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, এলাকা ভেদে খুচরা বাজারে এখনো মিনিকেট চালের ৫২ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৪০০ টাকায়। আর পাইকারিতে এই চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯০০ টাকায়।

ফলে মিনিকেটের খুচরা মূল্য দাঁড়াচ্ছে ৬০ থেকে ৬৮ টাকা, আর পাইকারি মূল্য ৫৮ টাকা। আগে এই মিনিকেট বিক্রি হচ্ছিল প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫২ টাকায়।
বাজারের সর্বশেষ পরিস্থিতি যাচাই করে দেখা যায়, মিনিকেটর মতোই বিআর আটাশ ও পাইজাম বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। খুচরায় বিআর আটাশ ৫২ কেজির বস্তা ২ হাজার ৬০০ টাকা, আর পাইজাম ২ হাজার ৫০০ টাকা করে।
কাওরান বাজারের সিটি জেনারেল স্টোরের বিক্রয়কর্মী রাসেল জানান, খুচরায় মিনিকেট কেজি প্রতি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, নাজিরশাইল ৬৬ থেকে ৬৮ টাকা, ভারতীয় আটাশ চাল ৪৭ টাকা, দেশি আটাশ চাল ৫৪ টাকা এবং ভারতীয় মোটা চাল (স্বর্ণা) ৫৪ টাকায় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে।

তিনি বলেন,আমাদের প্রত্যাশা ছিল আমন ধান উঠলে চালের দাম কমবে। কিন্তু চালের দাম কমেনি উল্টো বাড়ছে। কিন্তু কি কারনে চালের দাম বেড়েছে তা আমাদের বুঝে আসে না। আমরা বেশি দামে চাল কিনে বেশি দামেই বিক্রি করতে হয়। দাম কমানো কিংবা বাড়ানোতে আমাদের কোন হাত নেই। যারা আমাদের দায়ী করেন তারা না জেনেই করেন।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের চালের আড়তে মেসার্স লক্ষ্মী ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক হারুন অর রশিদ বলেন, আমদানি পর্যায় ও মিলগেট কিংবা পাইকারি পর্যায়ে দাম কমলেও এর প্রভাব খুচরা বাজারে সেভাবে পড়বে না এবং পড়ার তেমন সম্ভাবনাও নেই। কারণ বড় কয়েকটি ছাড়া রাজধানীর বেশিরভাগ কাঁচাবাজার বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠেছে। আর বাজারের চেয়ে অলিগলিতে দোকানের সংখ্যা আরো বেশি। যা মনিটরিং করার লোক নেই। মনিটরিং না থাকলে কোনোভাবেই দাম কমানো বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। এ ছাড়া ভোক্তারাও খুব একটা দরদাম করেন না। বিক্রেতা যে দাম চাচ্ছেন, সেই দামেই নিচ্ছেন ক্রেতারা। তাই দাম কমার সুফল কখনোই সঠিকভাবে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাবে না বলেও জানান তিনি।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম না কমার জন্য সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। তারা বলছেন পাইকারিতে চালের দাম কমলেও খুচরায় তেমন কমেনি। কারন হিসেবে তারা বলেন,বাজারে সরকারের কোন মনিটরিং টিম নেই। আর এ কারনেই পাইকারিতে দাম কমলেও খুচরায় দাম কমেনি। এর সুফল পাচ্ছে না সাধারন ক্রেতারা। শুধু তাই নয় এবার সারা দেশে বাম্পার ফলন হয়েছে আমনে। কিন্তু দাম না কমে উল্টো বাড়ছে। জনগন এখনও প্রত্যাশায় বুক বেধে আছে মনিটরিং বাড়লে হয়তো চালের দাম কমবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/310415