৭ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৬

পর্ষদকে জড়িয়ে দায় স্বীকার বাচ্চুর

দ্বিতীয় দফায় টানা সাত ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ * জালিয়াতির ঋণ প্রস্তাবে স্বাক্ষর প্রসঙ্গে বললেন ‘মিসগাইড’ হয়েছি * এভাবে ঋণ বিতরণ ভুল হয়েছে
বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি ও দুর্নীতির ঘটনায় পর্ষদকে জড়িয়ে নিজের দায় স্বীকার করেছেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু। বুধবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দ্বিতীয় দফা জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এ দায় স্বীকার করে বলেন, ‘আমি একা নই, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তেই ঋণ বিতরণ হয়েছে। পর্ষদ যেভাবে চেয়েছে আমি সেভাবে কাজ করেছি।’

এর আগে সোমবার তিনি তার বক্তব্যে ঋণ অনিয়মের দায় ব্যাংকের সাবেক এমডি, তিনজন ডিএমডি ও তিনজন শাখা ম্যানেজারের ওপর চাপিয়েছিলেন। দুদকের মহাপরিচালক মো. আসাদুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে তিনজন তদন্ত কর্মকর্তা সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত টানা সাত ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন বাচ্চুকে ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ‘নার্ভাস’ হয়ে পড়েন বাচ্চু। এমনকি অসুস্থবোধ করলে সঙ্গে সঙ্গে দুদকে নিয়োজিত চিকিৎসক ডা. জ্যোতির্ময় চৌধুরীকে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি বাচ্চুর শারীরিক অবস্থার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করেন। এ অবস্থায় দুপুরের খাবারের বিরতি দেয়া হয়। তাকে দুদক থেকে খাবার সরবরাহ করা হলেও তিনি তা খাননি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিকাল ৫টায় তিনি বিষণœ মনে দুদক ত্যাগ করেন। এ সময় সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করলেও তিনি এড়িয়ে যান। কোনো জবাব দেননি। এর আগে প্রথম দফায় জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি ছিলেন বেশ হাসিখুশি। ওইদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এখনও তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।’ ‘চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আপনার নেতৃত্বে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে’- এমন প্রশ্নে ওইদিন বাচ্চু বলেছেন, ‘তদন্ত চলছে, দেখা যাক কী হয়।’

দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, বুধবারের জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে তারা তদন্তের ভালো কিছু অগ্রগতি পেয়েছেন। প্রথম দফায় জিজ্ঞাসাবাদে বাচ্চু ঋণ অনিয়মের ঘটনা জানেন বলে স্বীকার করে এ অনিয়মের দায় চাপান এমডিসহ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ওপর। কিন্তু দ্বিতীয় দফা জিজ্ঞাসাবাদে পর্ষদের ওপর দায় চাপানোর মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে নিজের দায়ই স্বীকার করে নিলেন। কারণ তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হলেও একজন পর্ষদ সদস্যও বটে।

একজন তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আমরা তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করব। কারণ, ৫৬টি মামলায়ই তার দায় নিরূপণ করতে হবে।

দ্বিতীয় দফায় বাচ্চুকে দুদকের যে তিন কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তারা হলেন, উপপরিচালক সামসুল আলম, ঋত্বিক সাহা ও উপ-সহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদীন। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের সময় উপস্থিত ছিলেন পরিচালক জায়েদ হোসেন খান ও সৈয়দ ইকবাল হোসেন। ওই তিন কর্মকর্তার হাতে বেসিক ব্যাংকের মামলা রয়েছে ১৭টি। এর মধ্যে ৮ মামলায় বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করা হয়েছে। সোমবার ১২ জন কর্মকর্তা একত্রে বা যৌথভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও বুধবার ‘কেস টু কেস’র ভিত্তিতে একজন একজন করে তদন্ত কর্মকর্তার জেরার মুখে পড়েন বাচ্চু। পর্যায়ক্রমে অন্য তদন্ত কর্মকর্তারাও তাকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।

ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে নেতিবাচক মন্তব্যসহ ঋণ প্রস্তাব বোর্ডে উপস্থাপনের পরও সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ কিভাবে অনুমোদন হল, এতে আপনার ভূমিকা কি ছিল, বা আপনি এ অনিয়মের ঋণের দায় নেবেন কিনা’ তদন্ত কর্মকর্তাদের এমন প্রশ্নে বুধবার বাচ্চু বলেন, পর্ষদ সদস্যরা সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখেননি। এরপর ত্রুটিপূর্ণ ঋণপ্রস্তাব অনুমোদনের সময়ে বোর্ড সভার হাজিরা খাতায় ও সভার রেজুলেশনে বাচ্চুর স্বাক্ষর দেখিয়ে সেটি তার স্বাক্ষর কিনা জানতে চাওয়া হলে বাচ্চু সেটা তার স্বাক্ষর বলে স্বীকার করেন।

দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে বাচ্চু বলেন, আমিও একজন পর্ষদ সদস্য। তবে আমি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবেই বোর্ড সভায় উপস্থিত থাকতাম। বোর্ডে যেসব ঋণ প্রস্তাব আসত তা মূলত সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামের মাধ্যমেই উপস্থাপন করা হতো। তিনি আমাকে বলতেন সব ঠিক আছে। তাকে আমি বিশ্বাস করেছি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, ভুল হয়ে গেছে। ঋণে এতবড় অনিয়ম হয়েছে তখন আমি বুঝতে পারিনি।

ঋণ অনুমোদনে বাচ্চুর স্বাক্ষর দেখানোর পর তিনি তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেন, ‘আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছে। আমি মিসগাইড হয়েছি।’ এ সময় একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকার আপনাকে রক্ষক হিসেবে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান করেছিল। আপনি এখন বলছেন, ভুল হয়ে গেছে। আপনি মিসগাইড হয়েছেন। এতে করে কি আপনি মনে করেন নিজের অপরাধ লুকাতে পারবেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বাচ্চু একেবারে চুপ হয়ে যান। একজন কর্মকর্তা বাচ্চুকে প্রশ্ন করেন, আপনি নিজে বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাদের কাগজপত্র যাচাই না করে এমনকি অনেক ভুয়া ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকেও ঋণ পাইয়ে দিয়েছেন- এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বাচ্চু বলেন, আমি ঋণ আবেদনকারী সবাইকে চিনতাম না।

জানা গেছে, সোমবারের জিজ্ঞাসাবাদে বাচ্চু নিজের অনেক সম্পদের কথা স্বীকার করে বক্তব্য দিলেও বুধবার তাকে মামলার ঘটনার বাইরে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। এবার মামলায় আনীত অভিযোগের সূত্র ধরেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

আবদুল হাই বাচ্চুকে ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০১২ সালে তার নিয়োগ নবায়নও হয়। কিন্তু ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করার পর চাপের মুখে থাকা বাচ্চু পদত্যাগ করেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির ঘটনায় ৫৬টি মামলা করে দুদক। সবক’টি মামলায় ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামসহ ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তা ও শাখা ম্যানেজারসহ ১২৯ জনকে আসামি করা হলেও বাচ্চু কিংবা পর্ষদের কাউকে স্পর্শ করা হয়নি। এমনকি কাউকে তখন জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে দুদক। এমনকি বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। উচ্চ আদালত থেকে প্রশ্ন তোলা হয়, বোর্ড সদস্যরা কেন আসামির তালিকায় নেই। তাদের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ আসার পর দুদক থেকে সিদ্ধান্ত হয়, বাচ্চুসহ বোর্ড সদস্যদের আইনের আওতায় এনে তদন্ত করা হবে। সেই সিদ্ধান্তে অটল আছেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের তদন্ত কর্মকর্তারা সত্য উদ্ঘাটনের স্বার্থে তদন্ত করছেন। ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ কারা বের করেছে, সেই অর্থ কোথায় কোথায় গেছে তা বের করতে হবে। তদন্ত কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে তাদের তদন্ত শেষে যা বেরিয়ে আসবে সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এদিকে বাচ্চু এবার পর্ষদের ওপর দায় চাপিয়ে বক্তব্য দিলেও পর্ষদের একজন সদস্য দুদকের কাছে জবানবন্দি দিয়ে বলেছেন, সব কিছুর পেছনে বাচ্চু দায়ী। বেসিক ব্যাংকের সাবেক পর্ষদ সদস্য ও বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য একেএম কামরুল ইসলাম বলেন, ‘সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর স্বেচ্ছাচারিতা ও হস্তক্ষেপের কারণে অর্থ লোপাট ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। তার প্রভাবে পর্ষদ সদস্যদের বোর্ড সভার কাজ ত্বরিতগতিতে শেষ হতো। সভায় বাচ্চু ঋণ সংক্রান্ত এজেন্ডা আলোচনার সুযোগ না দিয়ে এককভাবে অনুমোদন করতেন। তিনি বোর্ড সভার কার্যবিবরণী তৈরিতে কোনো ধরনের গুরুত্ব দিতেন না। বরং নিজের ইচ্ছেমতো অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন।’

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ওই পর্ষদ সদস্যের জবানবন্দিকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। তিনি আমাদের তদন্তের অনেক পথ খুলে দিয়েছেন। তার বক্তব্যকে আমরা সত্য হিসেবে গ্রহণ করে বাচ্চুর কাছ থেকে অনিয়মের বিষয়ে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করছি।

২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণের অভিযোগ ওঠার পর তদন্তে নামে দুদক।

ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া, জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণদানসহ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধান শেষে এ অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ১২৯ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। আসামিদের মধ্যে ২৬ জন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বাকিরা ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক জরিপ প্রতিষ্ঠানে যুক্ত। ৫৬ মামলায় দুই হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৪ হাজার ৩৪১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। মামলায় বলা হয়, এসব ঋণ প্রস্তাবের সবগুলোই ছিল ত্রুটিপূর্ণ।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/12/07/177458