৭ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৬

সাবেক রাষ্ট্রদূত জামানের খোঁজ মেলেনি, নানা রহস্য

সোমবার সন্ধ্যায় মেয়েকে আনতে বিমানবন্দরের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। এর কিছুক্ষণ পরই তার ধানমন্ডির বাসায় যান তিন ব্যক্তি। বাসায় ঢুকেই তারা তার ব্যবহৃত ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ক্যামেরা ও একটি মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। এ সময় বাসায় ছিলেন দুই গৃহকর্মী। বাসার ল্যান্ড ফোনে মারুফ জামানের ফোন পেয়েই তারা ওই তিন ব্যক্তিকে বাসায় প্রবেশ করতে দেন। এদিকে বেলজিয়াম থেকে হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর বাবার অপেক্ষায় ছিলেন মেয়ে সামিহা জামান।

কিন্তু তিনি দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে এবং বাবার মোবাইলে ফোন দিয়ে বন্ধ পাওয়ায় উবারে করে বাসায় ফেরেন। বাসায় এসে এম মারুফ জামানকে না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন পরিবারের সদস্যরা। রাতভর অপেক্ষার পর মারুফ জামানের কোন খোঁজ না পেয়ে মঙ্গলবার দুপুরে ধানমন্ডি থানায় একটি নিখোঁজ ডায়রি করেন তার মেয়ে সামিহা জামান। মারুফ জামান কাতার ও ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত। এর আগে তিনি যুক্তরাজ্যের বাংলদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরের (৬ষ্ঠ শর্ট কোর্স) ক্যাপ্টেন হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। এদিকে মারুফ জামানের নিখোঁজের পর তার ব্যবহৃত গাড়িটি বসুন্ধরা তিনশ’ ফুট রাস্তার পাশ থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে খিলক্ষেত থানা পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, নিখোঁজ হওয়ার দিনে মারুফ জামানের মোবাইল ট্র্যাকিং করে দেখা গেছে তার সর্বশেষ অবস্থান বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী স্থান কাওলায়। ধানমন্ডি থানার ওসি আবদুল লতিফ জানান, সাবেক এই রাষ্ট্রদূতকে খুঁজে পেতে সারা দেশে বেতার বার্তা পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে অজ্ঞাত নম্বর থেকে ল্যান্ডফোনে মারুফ জামানের ফোন, সুঠামদেহী তিন ব্যক্তির বাসায় প্রবেশ করে মালামাল নিয়ে যাওয়া এবং গাড়ি উদ্ধারের ঘটনায় রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।

মারুফ জামান তার পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ধানমন্ডির ৯/এ নম্বর রোডের ৮৯ নং নম্বর বাড়িতে ছোট মেয়েকে নিয়ে বাস করতেন। ওই বাড়িটির অপর দুই ফ্ল্যাটে তার বড় বোন শাহরিনা কামাল এবং ছোটভাই রিফাত জামান তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করেন। এদিকে নিখোঁজের পর গতকাল বিস্তারিত জানিয়ে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে শাহরিনা কামাল ও রিফাত জামান। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা উল্লেখ করেন, তাদের ভাই গত ৪ঠা ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তার ছোট মেয়ে সামিহা জামানকে হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসার জন্য নিজেই গাড়ি চালিয়ে ধানমন্ডির বাসা থেকে বের হন। তার কিছুক্ষণ পর ৭ টা ৪৫ মিনিটের দিকে তার বাসার ল্যান্ড ফোনে অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন করে গৃহপরিচারিকাকে জানান, কেউ তার বাসার কম্পিউটার নিতে আসবে। তার কিছুক্ষণ পর রাত ৮টা ৫ মিনিটের দিকে তিনজন সুঠামদেহী ব্যক্তি বাসায় এসে তার ল্যাপটপ, বাসার কম্পিউটারের সিপিইউ, ক্যামেরা ও একটি স্মার্টফোন নিয়ে যায়। এ সময় তারা ঘরে তল্লাশি চালায়। এরপর থেকে জামানের ফোন বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, এ বিষয়ে মঙ্গলবার দুপুরে ধানমন্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করা হয়। ডায়রি নং- ২১৩। সন্ধ্যায় গাড়িটি উদ্ধার করা গেলেও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় এম মারুফ জামানের দুই মেয়ে ও পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন। তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। মারুফ জামানের বড় মেয়ে বেলজিয়ামে পড়াশুনা করেন। প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে তারা নিখোঁজ মারুফ জামানকে উদ্ধার করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি ও সহযোগিতা কামনা করেছেন।

এদিকে গতকাল সরজমিন নিখোঁজ মারুফ জামানের ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বাড়িটির তৃতীয় তলার ২/এ নম্বর ফ্ল্যাটে বাস করেন। মারুফ জামানের বাসায় কথা হয়, তার মেয়ে সামিহা জামান, গৃহকর্মী লাকি আক্তার ও বাড়ির দারোয়ান মফিজুল ইসলামের সঙ্গে। সামিহা জামান বলেন, তিনি গত ৪ঠা ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে বেলজিয়াম থেকে দেশে ফেরেন। বিমানবন্দরে গিয়ে তার বাবা তাকে নিয়ে আসার কথা। তিনি রওনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু অনেক্ষণ বিমানবন্দরে অপেক্ষা করে এবং বাবাকে ফোন দিয়ে না পেয়ে চাচা রিফাতকে ফোন দেন তিনি। তখন চাচা তাকে উবারে করে বাসায় ফিরতে বলেন। বাসায় এসেও বাবাকে না পেয়ে এবং দারোয়ানের কাছে বের হওয়ার কথা শুনে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পরে রাতভর কোনো সন্ধান না পেয়ে পরদিন মঙ্গলবার থানায় নিখোঁজ জিডি করেন। সামিহা বলেন, গত এক বছরের মধ্যে তার দাদা-দাদি ও মা মারা যাওয়ার পর নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নেন। খুব চুপচাপ থাকতেন। তেমন কারো সঙ্গে মিশতেন না। মাঝে-মধ্যে গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের লংলাতে যেতেন। সেখানে নিজেদের সম্পত্তি দেখাশুনা করতেন। মারুফ জামানের মেয়ে আরো বলেন, কারো সঙ্গে বিবাদ ও আর্থিক লেনদেনও ছিলো না তার বাবার। ফলে কে তাকে অপহরণ করতে পারে সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই করতে পারছেন না। এছাড়া কখনো এমন কোনো বিষয় তাদের সঙ্গে শেয়ারও করেননি। সামিহা জামান বলেন, তার বাবা বেশির ভাগ সময়ই বাসায় অবস্থান করতেন। বিভিন্ন নিউজ পড়তেন। সমসাময়িক নিউজগুলো গুরুত্ব দিয়ে পড়তেন। তিনি বলেন, তাকে আনতে বাসা থেকে বের হওয়া, বাসায় অন্য নম্বর থেকে ফোন করা, তিন ব্যক্তি বাসায় প্রবেশ এবং পরবর্তীতে নিখোঁজ হওয়া সবমিলিয়ে তাদের কাছে এক রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, যেভাবেই হোক আর যারাই তাকে অপহরণ করুক তাদের প্রত্যাশা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে খুঁজে বের করবেন। যে কোনো মূল্যে তিনি তার বাবাকে ফেরত চান। বাসায় নিয়োজিত দু’জন গৃহকর্মীর একজন লাকি আক্তার জানান, যে তিন ব্যক্তি বাসায় এসেছিলো তারা দেখতে বেশ ফর্সা। ৬ ফুটের মতো উচ্চতা। পরনে কালো শার্ট ও জিন্স প্যান্ট পরা ছিলো। তিনি বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মারুফ জামান বের হয়ে যান। এরপর সাড়ে ৭টার দিকে বাসায় দু’টি অজ্ঞাত নম্বর (একটি ০০০১২৩৪৫৬, অপরটি পি) থেকে ল্যান্ড ফোনে কল আসে। অপর প্রান্ত থেকে স্যার নিজেই বলেন, বাসায় লোক গিয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে যাবে। এর আধাঘণ্টা পর তারা বাসায় আসে। এসে কম্পিউটারে সিপিইউ, ল্যাপটপ, ক্যামেরা ও একটি স্মার্ট ফোন নিয়ে যায়। এছাড়া বাসার আর কোনো কিছুই তারা নেয়নি। এই গৃহকর্মী বলেন, যারা এসেছিলো তাদের বয়স ৩০-৩২ বছরের মতো হবে। দেখতে ছিমছাম এই তিনজন ১০-১২ মিনিট বাসায় অবস্থান করে। এই বাসায় তিনি ৮ বছর ধরে কাজ করছেন বলেও জানান লাকি আক্তার। বাসার দারোয়ান মফিজুল ইসলাম বলেন, স্যার আনুমানিক সাড়ে ৬টার দিকে নিজেই গাড়ি চালিয়ে বের হয়ে যান। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনজন আসেন। বলেন, মারুফ জামানের বাসায় যাবেন। পরে তিনি ওপরে ইন্টারকমে ফোন দিলে গৃহকর্মী তাদের যাওয়ার কথা বলে। মফিজুল ইসলাম বলেন, তারা ভেতরে যাওয়ার সময় ক্যামেরার সামনে মাথা নিচু করে যায়। বাইরে তাদের কোন গাড়ি ছিলো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা পায়ে হেঁটে এসেছিলো। তাদের সঙ্গে কোনো গাড়ি দেখেননি। ধানমন্ডি থানার ওসি জানান, তারা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেছেন। কিন্তু বাসায় প্রবেশ করার সময় তাদের মাথায় হ্যাট পরা ছিলো। ক্যামেরার সামনে তারা মাথা নিচু করে। ফলে তাদের কাউকেই চেনা যায়নি। তিনি বলেন, নিখোঁজ মারুফ জামানের ফোন নম্বর ট্র্যাকিং করে দেখা গেছে, ওইদিন ৭টার পর তার অবস্থান ছিলো কাওলা এলাকায়। তাকে খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। সারা দেশে বেতার বার্তা পাঠানো হয়েছে।
গাড়ি উদ্ধার: এদিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে মারুফ জামানের গাড়িটি খিলক্ষেত থানাধীন বসুন্ধরার তিনশ’ ফিট রাস্তার পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। খিলক্ষেত থানা সূত্রে জানা গেছে, সন্ধ্যায় ৩০০ ফিট রাস্তায় খিলক্ষেত থানার এসআই এমএ জাহেদ টহল দিচ্ছিলেন। গাড়িটি দেখে তার কাছে গিয়ে তিনি মালিকের খোঁজ করেন। কাউকে না পেয়ে থানায় ডিউটি অফিসারকে ফোন করে কন্ট্রোল রুমে জানান। পরে নিশ্চিত হন গাড়িটি নিখোঁজ সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানের। খিলক্ষেত থানার এসআই জাহেদ বলেন, গাড়িটি অক্ষত অবস্থায় রাস্তার পাশে পার্কিং করা ছিল। কোনো দুর্ঘটনা বা অন্য কিছু হয়নি। লক্ড অবস্থায় ছিল। লোকজনের উপস্থিতিতে গাড়িটি খুলে ভেতরে শুধু গাড়ির কাগজপত্র পাওয়া গেছে। পরে সেসব জব্দ তালিকা করে খিলক্ষেত থানায় নেয়া হয়।
তদন্তে ডিবি: সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান নিখোঁজের ঘটনা থানা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ তদন্ত করছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড টান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। গতকাল ডিএমপি’র মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা জানান। তিনি বলেন, আমরা ঘটনাটি শুনেছি। থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি।

এদিকে মারুফ জামানের নিখোঁজ হওয়ার বিষয় নিয়ে নানা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। অক্ষত অবস্থায় গাড়িটি পাওয়া গেছে মানে তিনি কোনো দুর্ঘটনায় পড়েননি। অথবা গাড়ি চোর বা ছিনতাই চক্রের হাতেও পড়েননি। তাহলে তারা গাড়িটি রাস্তার ধারে ফেলে রাখতো না। এর নেপথ্যে অন্য কোনও কারণ রয়েছে। এছাড়া বাসায় প্রবেশ করা তিন ব্যক্তি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের বর্ণনা ও ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
উল্লেখ্য, মারুফ জামান ২০০৮ সালের ৬ই ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভিয়েতনামে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি কাতারে রাষ্ট্রদূত, যুক্তরাজ্যে কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তিনি অবসরে যান।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=95130