৭ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৪

ভুল পথে মেধার বিচিত্র অভিযাত্রা

‘নকলবাজিতেই সব বন্দী’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। ২৭ নভেম্বর তারিখে মুদ্রিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে নাগরিক জীবনযাত্রার সবকিছুই নকলবাজিতে বন্দী হয়ে পড়েছে। নকলবাজির এ সাম্রাজ্যে সবই আছে, শুধু আসলটাই উধাও। বাজারে এমন কিছু নেই যা নকল হয় না। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে সার, কসমেটিকস, পানীয়, ইলেক্ট্রনিক, অটো মোবাইল পার্টস, পাইপ, প্লাস্টিক পণ্য, সিমেন্ট সবকিছুরই নকল আছে। আছে ভুয়া ডাক্তার, ভুয়া পুলিশও। নকল ভেজাল মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যসামগ্রীতে ছেয়ে গেছে দেশ। অবলীলায় এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে চোখের সামনেই।

নকলবাজির এমন দৌরাত্ম্যে প্রশ্ন জাগে, এ থেকে কি মানুষের রক্ষা নেই? আমরা জানি, পণ্য ভেরিফিকেশনের জন্য হলোগ্রাম, স্টিকার, স্ক্যানার, আরএফআইডি ট্যাগ, বারকোড ইত্যাদি সিস্টেম চালু আছে। কিন্তু এসব হলোগ্রাম বা স্টিকারগুলো যদি নকল হয়ে যায় তখন গ্রাহক আসল-নকল আলাদা করবেন কীভাবে? তাই চকচকে মোড়কের পণ্য আসল পণ্য কিনা তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। বরং নকল পণ্যের মোড়ক বা প্যাকেটই নাকি এখন অধিক উন্নত। কারণ নকলবাজদের লক্ষ্য তো এখন পণ্য নয় বরং মোড়ক। এমন পরিস্থিতি সরকারের জন্য বিব্রতকর। আমরা জানি, মানসম্পন্ন পণ্য পাওয়া নাগরিকদের অধিকার। কিন্তু এই অধিকার নিশ্চিত করবে কে? সরকার ও প্রশাসনের ওপরই তো এই দায় বর্তায়। এ নিয়ে রাজনীতি হতে পারে, ব্লেমগেমও হতে পারে কিন্তু এতে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবে না।

পরিস্থিতির উন্নয়নে বিধিসম্মত পদক্ষেপ তো নিতেই হবে। আইনের শাসন থাকলে তো আইনকে গুরুত্ব দিতেই হবে। তবে আর একটি মুখ্য বিষয় বোধ হয় এখন গৌণ হতে চলেছে। আর তা হলো নৈতিক মূল্যবোধ, যার উৎস ধর্ম। এ ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতার কারণে নকলের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। নিত্যনতুন কৌশলে ও চাতুর্যে বিধি ও ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। মানুষের মেধা এখন ভুল পথে ব্যবহার হচ্ছে বেশি। এখানেই আমাদের সংকট, সভ্যতারও সংকট।

শুধু নকলবাজিতেই নয়, মেধার অপব্যবহার হচ্ছে নানা প্রকল্পেও। সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে এস্কেলেটর (চলন্ত সিঁড়ি) স্থাপনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। এ প্রকল্পের আওতায় এক হাজার একশ’ ষোল কোটি টাকার বিশাল ব্যয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৬৩টি স্কুলে এই এস্কেলেটর স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর। প্রতি জোড়া এস্কেলেটরের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের এমন প্রস্তাবে বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে সচেতন মহলে। দেশের শিক্ষার মান, শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা ও সক্ষমতা নিয়ে যখন নানা প্রশ্ন রয়েছে, তখন অবকাঠামো উন্নয়নের নামে ‘এস্কেলেটর’ নামক বিলাসী প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনও। এ ছাড়া এ ধরনের অদ্ভুত প্রস্তাবকে বিশাল আকারের লুটপাটের পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যেখানে দেশের বেশিরভাগ সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের অবকাঠামো খুবই দুর্বল, রয়েছে ভবন ও ক্লাসরুমের সংকট, বৈদ্যুতিক পাখা ও বাতির সংকট, টয়লেটগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী, লাইব্রেরি-ল্যাব ও কম্পিউটার কক্ষ নেই বললেই চলে; সেখানে এস্কেলেটরের মতো ব্যয়বহুল যান্ত্রিক সিঁড়ি স্থাপন শুধু গরিবের ঘোড়া রোগই নয়, বিপজ্জনকও বটে। সরকারি স্কুল ভবনগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত নিয়মনীতি ও উপকরণ ব্যবহারের বিষয়টি যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এস্কেলেটরের ভার ওইসব ভবনের ছাদ ও মেঝে বহন করতে গিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সহজলভ্যতা ও নিয়মিত মেইনটেইন্যান্সের প্রশিক্ষিত লোকবল নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আর যাদের জন্য এই এস্কেলেটর স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে, গ্রামগঞ্জের সে কোমলমতি শিশু-কিশোররা এগুলো ব্যবহারের সুফল পাবে তো? নাকি এ যন্ত্র ব্যবহার করতে গিয়ে পা আটকে কিংবা হঠাৎ চলন্ত অবস্থায় বৈদ্যুতিক কারণে বন্ধ হয়ে গেলে আহত হওয়ার দুর্ভোগে পড়বে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশসহ অধিকাংশ উন্নত দেশেই স্কুল পর্যায়ে এস্কেলেটরের ব্যবহার নেই। আর দেশের অধিকাংশ স্কুলই দোতলার বেশি নয়। এমন বাস্তবতায় দোতলায় উঠানামার জন্য এস্কেলেটরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এস্কেলেটর প্রসঙ্গে বলেন, এ ধরনের প্রকল্প-প্রস্তাবনা হাস্যকর মনে হচ্ছে। আমাদের মতো দেশে যেখানে এখনো শিক্ষা সুবিধায় সংকট রয়েছে সেখানে এ ধরনের একটা প্রকল্প অযৌক্তিক। তিনি বলেন, বিমানবন্দর, শপিংমলসহ যেখানে লোক সমাগম অনেক বেশি থাকে সেখানে এস্কেলেটর ব্যবহৃত হয়। বিদ্যালয়ে এ প্রকল্প মানে অর্থের অপচয়। এস্কেলেটর দিয়ে না হবে শিক্ষা, না হবে স্বাস্থ্য। ফলে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে এস্কেলেটর স্থাপনের এই প্রস্তাব? অভিযোগ উঠেছে, বিশাল লুটপাটের জন্যই ওই প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা আশা করবো সরকার বিষয়টি খতিয়ে দেখে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এ ধরনের অপচয়মূলক ও হাস্যকর প্রস্তাব করার সাহস না পায়।

http://www.dailysangram.com/post/310322