৬ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:০৯

শেয়ারবাজারে কারসাজি

পুরনো খেলোয়াড়রা এখনও সক্রিয়

শুধু জরিমানা নয়, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ অর্থনীতিবিদদের * আইনের তোয়াক্কা করে না কেউ
শেয়ারবাজার কারসাজিতে সক্রিয় পুরনো খেলোয়াড়রা কোনো কিছুই পরোয়া করছেন না। জরিমানা করেও তাদের থামানো যাচ্ছে না। সম্প্রতি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের শেয়ার মূল্যে কারসাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ায় চিহ্নিত তিন বিনিয়োগকারীকে ১০ লাখ টাকা করে ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। শেয়ারবাজার কারসাজিতে জড়িতদের অন্যতম হলেন ইয়াকুব আলী খোন্দকার, আবু সাদত মো. সায়েম ও সিরাজুদ্দৌলা। বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি করায় তারা শেয়ারবাজারের মাফিয়া হিসেবে পরিচিত। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তাদের জরিমানা করলেও তারা কোনো তোয়াক্কা করছেন না।

জানা গেছে, কারসাজির জন্য প্রায় সময় মাফিয়ারা ছোট কোম্পানিকে বেছে নেন। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস থেকে মাত্র কয়েকজন বিনিয়োগকারী ওই কোম্পানির অধিকাংশ শেয়ার কিনে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। এরপর বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে নিজেদের হাতে থাকা শেয়ার বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা নিয়ে চলে যান মাফিয়ারা।
২০১৬ সালেও এই তিন মাফিয়াকে সতর্ক করে চিঠি দেয় বিএসইসি। ২০১০ সালে মারিকো বাংলাদেশের শেয়ারে কারসাজির অভিযোগে ইয়াকুব আলী খোন্দকারকে এক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। শেয়ারবাজারে একক কোনো বিনিয়োগকারীর এটিই সর্বোচ্চ জরিমানা। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের রিপোর্টেও তাদের কারসাজির প্রতিবেদন তুলে ধরে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু থেমে নেই তাদের কারসাজি। জরিমানা ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিএসইসি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু জরিমানা নয়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তবে শাস্তির বিষয়টি সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপার। তার মতে, বারবার তারা একই অপরাধ করছেন। ফলে জরিমানা তাদের চূড়ান্ত শাস্তি নয়। সিকিউরিটিজ আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। তবে তার মতে, মামলা করলে আরেক অসুবিধা হল উচ্চ আদালত থেকে স্থগিত আদেশ নিয়ে বিষয়টি তারা বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখেন। এসব ব্যাপারে কথা বলতে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের পাওয়া যায়নি। তবে ঘনিষ্ঠজনরা জানান. বর্তমানে তিনজনই দেশের বাইরে রয়েছেন।
২০১১ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে কারসাজির বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়। ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, অমনিবাস অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শীর্ষ ৩০ জন বিনিয়োগকারী ২০০৯ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে ৭৪০ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন করেছেন। এর মধ্যে ইয়াকুব, সায়েম, সিরাজুদ্দৌলা, গোলাম মোস্তফা ও আরিফুর রহমান অমনিবাস অ্যাকাউন্টের আড়ালে পরিচয় গোপন করে একাধিক অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার লেনদেন করেছেন। তারা যেসব প্রতিষ্ঠানে শেয়ার লেনদেন করেছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- এবি ব্যাংক, উত্তরা ফাইন্যান্স, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক। ব্যক্তি বিনিয়োগকারী হিসেবে ২০০৯ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে ইয়াকুব ১০৪ কোটি টাকা লেনদেন করেন। এ সময় সিরাজুদ্দৌলা ১১৯ কোটি এবং সায়েম ৩০ কোটি টাকা লেনদেন করেন। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্টের তিনটি কোড নম্বরের মাধ্যমে ইয়াকুব ও তার স্ত্রী সারা খোন্দকারের অ্যাকাউন্টে ১৬ কোটি টাকা জমা হয়। এরপর মুনাফাসহ মার্জিন অ্যাকাউন্টে ৮৪৮ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয় এবং ৮৮০ কোটি টাকা বিক্রি হয়। এ সময় অ্যাকাউন্ট থেকে ২৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা তুলে নেন তারা। এ ছাড়া ২০০৯ ও ২০১০ সালে নিজ অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ৭০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন করেছেন ইয়াকুব।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার রিপোর্টে বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো অধিকতর তদন্ত করে বিএসইসিকে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ ছিল।’ তিনি বলেন, জরিমানা মন্দের ভালো। কারণ কিছু না করার চেয়ে জরিমানা করলে হয়তো তাদের কিছুটা সতর্কবার্তা দেয়া হয়। তবে তিনি বলেন, শাস্তি দেয়াটা বিএসইসির ব্যাপার।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কমিশন যেটা ভালো মনে করে তখন সেটা করে। এবারও জরিমানাকে উপযুক্ত শাস্তি মনে করেছে কমিশন। পরবর্তী বিএসইসি মনে করলে অন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে। সেটি ভবিষ্যতের ওপর নির্ভর করছে।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/12/06/177207