৬ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৮:৪৪

আন্তর্জাতিক নিয়ম না মেনে ওজনসীমা নির্ধারণ

শিল্পের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র

ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া : দেশের স্বার্থবিরোধী ওজনসীমা নির্ধারণকারীরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায় * বিআরটিএর অযৌক্তিক সার্কুলার স্থগিত করতে চিঠি দিচ্ছে পোর্ট ইউজারস ফোরাম * দাবি না মানলে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা
কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) তথা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। পরিবহন ও ব্যবসায়ী নেতাদের মতামত উপেক্ষা করে পণ্যবাহী গাড়ির ওজনসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত সার্কুলারে বলা হয়েছে, ৪০ টনের বেশি ওজনের পণ্যবাহী গাড়ি চলতে পারবে না। সার্কুলারে প্রায় সব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সক্ষমতার চেয়ে ওজনসীমা কম নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সার্কুলারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশের ব্যবসায়ী ও পরিবহন সেক্টরের নেতারা।

ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীদের কয়েকজন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, আন্তর্জাতিক শিপিং নিয়মানুযায়ী একটি ৪০ ফুটের কনটেইনারে ৩০ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করা যায়। সে ক্ষেত্রে গাড়িসহ ওই কনটেইনারের ওজন দাঁড়ায় ৪৯ টনে। একইভাবে ২০ ফুটের পণ্যবাহী ১০ চাকার গাড়িতে ৩৫ টন পণ্য পরিবহন করার কথা। কিন্তু এসব নিয়ম না মেনে ৪০ ফুটের কনটেইনারবাহী গাড়িতে ৪০ টন ও ২০ ফুটের কনটেইনারবাহী গাড়িতে ৩০ টন ওজনসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। যা শিল্প খাতের জন্য গভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন তারা। তারা বলছেন, দেশি-বিদেশি একটি চক্র এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশ দেখতে চায় না। এ জন্য সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা চক্রটি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারকে বিপাকে ফেলার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। তা না হলে দেশের স্বার্থবিরোধী এমন সার্কুলার জারি হওয়ার কথা নয়।

এদিকে এ সার্কুলারকে ভর করে দুর্নীতিও জেঁকে বসেছে। পণ্যবাহী গাড়ির ওজন পরিমাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বাড়তি টাকা দিলে আবার সব জায়েজ। সার্কুলারের নির্দেশনার বাইরে প্রতি টনের জন্য প্রকাশ্যে নেয়া হচ্ছে স্লিপ ছাড়া ৫ হাজার টাকা জরিমানা। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই। এ অবস্থায় দ্রুত এ সংকট নিরসনের দাবিতে ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামে বৈঠক করেছে পোর্ট ইউজারস ফোরাম। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, অবিলম্বে শিল্পের বিকাশবিরোধী এ সার্কুলার অন্তত তিন মাসের জন্য স্থগিত করতে হবে। এ জন্য শিগগির সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে চিঠি দেয়া হবে। নেতারা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, দাবি না মানলে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, এ সার্কুলারের ফলে পণ্য পরিবহনে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে পরিবহন ব্যয়। সময়মতো কাঁচামাল আনতে না পারায় হুমকির মুখে পড়ছে শিল্পকারখানা। এ ছাড়া কনটেইনার-জট তো লেগেই আছে। যার প্রভাব পড়ছে সরাসরি ভোক্তাদের ওপর। বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের দামও। এর পেছনে দেশকে অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে- এমনটি অনুমান করে ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, এক শ্রেণীর আমলা সড়ক রক্ষার দোহাই দিয়ে সরকারকে ভুল বুঝিয়ে এ ওজনসীমা নির্ধারণ করেছে। এর ফলে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে শিল্পকারখানা বিকাশের জন্য সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ কাজে আসছে না।
পরিবহন নেতারা বলেন, ওজনসীমা নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরেই নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর এ ধরনের ভূমিকার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম থেকে কয়েক দফায় পণ্য পরিবহন ধর্মঘট পালিত হয়। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উদ্যোগে সচিবের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ওজনসীমা নিয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা বেশ কিছু যৌক্তিক প্রস্তাবনা দেন। ওই বৈঠকে বাস্তবতার নিরিখে এসব প্রস্তাবনা মেনে নেয়ার আশ্বাসও দেয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি গণমাধ্যমে বিআরটিএর জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে ওই আশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেনি।

প্রসঙ্গত, বিআরটিএর সার্কুলারে ছয় চাকা (২ এক্সেল) বিশিষ্ট মোটরযানে ২২ টন, ১০ চাকা (তিন এক্সেল) বিশিষ্ট গাড়িতে ৩০ টন এবং ১৪ টাকা বিশিষ্ট (২+২= ৪এক্সেল) প্রাইমমুভারে (৪০ ফুট কনটেইনার) সর্বোচ্চ ৪০ জন ওজনসীমা উল্লেখ করা হয়েছে। পহেলা ডিসেম্বর থেকে ওই ওজনসীমার বেশি পণ্য পরিবহন করলে তা উৎসস্থলে ফেরত পাঠিয়ে দেয়াসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। হয়রানি আর আর্থিক ক্ষতির শেষ নেই।

বিআরটিএ’র এ সার্কুলারের বিষয়ে শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহছানুল হক চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক শিপিং রুল অনুযায়ী ৪০ ফুটের কনটেইনারে ৩০ টন পণ্য পরিবহন করা যায়। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও ৩০ টন পণ্য আমদানি ও রফতানি করতে দিচ্ছে। ওই কনটেইনার ও গাড়ির ওজন মিলিয়ে তা দাঁড়ায় ৪৯ টনে। তাহলে কোন নিয়ম মেনে প্রাইম মুভারের সর্বোচ্চ ওজনসীমা ৪০ টন করা হল? তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে পোর্ট ইউজারস ফোরামের সভাপতি ও চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলমের সভাপতিত্বে ব্যবসায়ীরা বৈঠক করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিআরটিএ’র সার্কুলার কমপক্ষে তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখার দাবিতে শিগগির সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে চিঠি দেয়া হবে।

পরিবহন নেতারা বলেন, আমদানিকারক যেভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার নিয়ে আসেন, সেভাবে তা পরিবহন করতে হয়। কেননা আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে তা লক করা থাকে। কিন্তু এখন সরকার যা বলছে, তাতে করে এসব কনটেইনার থেকে পণ্যসামগ্রী কমাতে গেলে বিড়ম্বনার আর শেষ থাকবে না। দেখা যাবে নামিয়ে ফেলা পণ্য চুরি হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এ রকম ঘটনা বহু ঘটেছে। তাই মানসম্মত সড়ক নির্মাণ না করে এভাবে পণ্য পরিবহনে বাধা দেয়া পুরোপুরি অযৌক্তিক।
বাংলাদেশ প্রাইমমুভার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক যুগান্তরকে বলেন, এটা এক ধরনের ষড়যন্ত্র। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী কনটেইনারের নির্দিষ্ট ওজন আছে। কনটেইনারসহ গাড়ির ওজন দাঁড়ায় ৪৯ টন। কিন্তু আমাদের ৪০ টন পরিবহনের মধ্যে আটকে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ২০ ফুট কনটেইনারসহ গাড়ির ওজন দাঁড়ায় ৩৫-৩৭ টন। কিন্তু সেখানে বলা হচ্ছে ৩০ টনের বেশি পরিবহন করা যাবে না। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকরা এ ধরনের শত শত কনটেইনার বন্দর থেকে বের করতে পারছে না। ফলে কাঁচামালের অভাবে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

বাংলাদেশ কাভার্ডভ্যান ট্রাক পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম লিটন যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মালিকরা যে দাবি দিয়েছিলেন তা না মেনে সরকার একতরফাভাবে ওজনসীমা নির্ধারণ করেছে।
এদিকে সূত্র জানায়, ওজনসীমা নির্ধারণের বিরুদ্ধে সম্প্রতি চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি বৈঠক করে। বৈঠকে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, তাদের যৌক্তিক দাবি অনুযায়ী সংকটের সমাধান করা না হলে অর্থনীতিতে এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/12/06/177199