৬ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৮:৪৩

বিদেশী আগ্রাসনে দেশের পোল্ট্রি শিল্প

* ৭টি বিদেশী কোম্পানিকে পোল্ট্রি শিল্পের অনুমতি
* বন্ধ হচ্ছে দেশের ছোট ছোট খামার
এইচ এম আকতার: বিদেশী আগ্রাসনের শিকার দেশের পোল্ট্রি শিল্প। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট খামার। মুরগির খাদ্যের দাম বাড়ায় পুঁজি হারিয়ে ব্যবসা বন্ধ করছেন খামারীরা। তাদের দাবি, কর ও আবগারি শুল্ক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনায় বেড়েছে দাম। সরকার যদি নীতিমালা করতে না পারে তাহলে শতভাগ বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে দেশের পোল্ট্রি শিল্প।

বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের ব্যবসায় নিয়োজিত বিদেশী কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্যে বিপাকে পড়েছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প। বর্তমানে ৭টি বিদেশী কোম্পানি সরকারের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের ব্যবসা করছে। কিন্তু এই সাতটি বিদেশী কোম্পানি বাংলাদেশে কি পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারবে কিংবা কি পরিমাণ লভ্যাংশ নিয়ে যেতে পারবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। ফলে বিদেশী কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাজার দখলের কারণে দেশীয় কোম্পানিগুলো বাজার হারাচ্ছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) বলছে, বাংলাদেশের পোল্ট্রি ব্যবসার ৪০ শতাংশ ইতোমধ্যে বিদেশী ৭টি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বিদেশী সাতটি কোম্পানি হলো ভিএইচ গ্রুপ, গোদরেজ, সেগুনা, টাটা, অমৃত গ্রুপ, সিপি এবং নিউ হোপ। কোম্পানিগুলোর কেউ বাচ্চা উৎপাদন, ডিম উৎপাদন কিংবা মুরগি উৎপাদনের অনুমতি নিয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিদেশী কোম্পানিগুলো বর্তমানে সবকিছুই করছে। ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো বাজার হারাচ্ছে। এছাড়া বিদেশী কোম্পানিগুলো সর্বোচ্চ কি পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে পারবে, মোট লভ্যাংশের কত শতাংশ নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারবে এবং কত শতাংশ এদেশে খরচ কিংবা বিনিয়োগ করতে পারবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই।

দীর্ঘদিন ধরে পোল্ট্রি নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছে খাত সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু নানা অজুহাতে সে নীতিমালা আলোর মুখ দেখেনি। কবে নাগাত নীতিমালা হবে তা কেউ বলছে পারছে না। এ সুযোগে বিদেশী কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা লোপাট করছে। আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে ছোট খামারিরা।
জানা যায়, বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে পোল্ট্রি খামার শুরু হয় ১৯৬৬ সালের দিকে। বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা প্রথম পোল্ট্রি খামার ‘এগ এন্ড হেনস লি’ কিনে নেয় থাইল্যান্ডের সিপি কোম্পানি। বর্তমানে চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিরাজগঞ্জসহ দেশের ১৮টিরও অধিক স্থানে নিজস্ব খামার, হ্যাচারি ও ফিডমিল স্থাপন করেছে সিপি। সুগুনা কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলার রাজ পোল্ট্রি, গোল্ডেন চিকসসহ ১০টিরও অধিক খামারে। কোম্পানিটি ইতোমধ্যে ১৫টিরও বেশি দেশীয় কোম্পানি লিজ নিয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য বিদেশী কোম্পানিগুলোও তাদের ব্যবসা বড় করতে কাজ করে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাবু বলেন, সরকার বিদেশী কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু ব্যবসা করার কোনো নীতিমালা নেই। পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ৬০ লাখ মানুষ জড়িত। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা নিজেদের মতো করে বাচ্চা উৎপাদন করছে, ডিম বিক্রি করছে আবার মুরগিও বিক্রি করছে।

যদিও নিম্নমুখী ডিমের বাজার। আর স্থিতিশীল আছে মুরগির মাংসের দামও। কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ছোট ছোট উদ্যোক্তা নির্ভর খাতটিতে কম সুদে বিদেশী বিনিয়োগ আসায় টিকতে পারছে না ক্ষুদ্র খামারীরা। তাই সরকারের উচিত বিদেশী খামারীদের সাথে অসম প্রতিযোগিতা দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়া। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের হিসাব বলছে, পাঁচ বছর আগেও ডিম ও মুরগীর চাহিদার বড়ো একটা অংশ আসতো ছোট ছোট খামার থেকে।
কিন্তু বিদেশী বিনিয়োগ আসায় বন্ধ হয়েছে অসংখ্য খামার। দেশীয় খামারীরা ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করলেও বিদেশী কোম্পানিগুলো তা করছে মাত্র ২/৩ শতাংশ সুদে। আর এই কৃষি অর্থনীতিবিদের মতে, খাতটিতে দেশীয় যে বিনিয়োগ আছে তা রক্ষায় কৌশলী হতে হবে সরকারকে। ছোট খামারিদের অভিযোগ,সাময়িক দুই/তিন বছর লোকসান দেয়াও বিদেশী কোম্পানিগুলোর ব্যবসার কৌশল। এই দুই/তিন বছরে ছোট সব খামার বন্ধ হয়ে গেলে ডিম আর মুরগীর দাম বাড়িয়ে দিয়ে লোকসান উঠিয়ে নিবে। তখন আর তাদের নিয়ন্ত্রনে আমাদের কিছু করার থাকবে না।

প্রতিবেশি দেশ ভারতও তাদের পোল্ট্রি শিল্পে নগদ প্রনোদণা দিয়ে থাকেন। অথচ বাংলাদেশ প্রনোদণা তো দেয়নি উল্টো খাদ্য এবং কাঁচা মালে শুল্ক বসানো হয়েছে। এতে করে দেশিয় ও আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না বাংলাদেশ।
কর ও আবগারি শুল্কের কারণে বেড়েছে মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যেও দাম। বিপরীতে কমেছে ডিমের দাম। স্থিতিশীল আছে মুরগির গোশতের বাজার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ছোট ছোট ভোক্তা নির্ভর ঘাটতিতে কম সুদে বিদেশী বিনিয়োগ আসায় টিকতে পারছে না ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তাই সরকারের উচিত বিদেশী খামারিদের সাথে অসম প্রতিযোগিতা দূর করতে পদক্ষেপ নেয়া।
ধামরাইয়ের খান পোল্ট্রিফার্ম, ২০০১ সালে ৫০০০ মুরগি নিয়ে মুরগির খামার গড়ে তুলেন গোলাম মর্তোজা। তবে এখন খালি পড়ে আছে এই খামার।
গোলাম মর্তোজা বলেন, মুরগির খাবারের দাম বেশি এবং মুরগির বাচ্চার দামও বেশি তাই কয়েক মাস ধরে এই খামার খালি। বর্তমানে বাচ্চার দাম কমলেও তেমনটা কমেনি। সার্বিকভাবে এর আগে অনেক লোকসান হয়েছে বলে বর্তমানে পুঁজি কম।

তার মতো অবস্থা অনেক ছোট ছোট খামারির । তারা বলছে, বাজেটে দরকারি কাঁচামাল আমদানিতে কর ও শুল্ক আরোপের কারণে বেড়েছে মুরগির খাদ্যের দাম। ফলে পুঁজি হারিয়ে তারা বাধ্য হচ্ছে খামার বন্ধ করে দিতে। এক খামারী বলেন, বর্তমান ১ হাজার মুরগি আছে আর ২ হাজার মুরগির খাচি খালি পড়ে আছে।
জানা গেছে, প্রতিটি ডিম উৎপাদনে বর্তমানে ব্যয় হয় ৬ টাকা। আর পাইকারি বাজারে একটি ডিমের দাম ৫ থেকে সাড়ে ৫ টাকা। এতে করে প্রতিটি ডিমে লোকসান গুনতে হচ্ছে ১ টাকার মত। এর অন্যতম কারণ হলো খাদ্যের দাম বৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরে পোল্ট্রি খাদ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। একইভাবে এখাত সংশ্লিষ্ট কাচামালের ওপর শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে করে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে দেশের প্রান্তিক খামারিরা। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে অনেকেই খামার বন্ধ করতে বাদ্য হয়েছে। অনেকগুলো আবার বড় খামারির কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের পোল্ট্রি খাতে শতভাগ বিদেশীদের হাতে চলে যাবে।

একই অবস্থা পোল্ট্রি শিল্পের ব্রয়লার খাতে। এখানে প্রতি দিন খামারিদের লোকসান গুণতে হচ্ছে। উচ্চহারে সুদ নিয়ে ব্যবসা করতে গিয়ে অনেকেই আর ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছে না। অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিলেও ঋণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। একারণে ব্যাংকের ভয়ে কেউ কেউ কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
অবস্থা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘদিন ধরে নীতিমালা দাবি করে আসলেও তা হয়নি। ২০১৬ সালে নীতিমালা চূড়ান্ত করলেও সংস্কারের নামে তা আটকে দেয়া হয়েছে। এ নীতিমালা আর হবে কি না তা কেউ বলতে পারছে না। আর হলেও কবে হবে সে বিষয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। এভাবে ঝুকিতে চলছে দেশের পোল্ট্রি শিল্প।
বাংলাদেশ পোল্ট্রিশিল্প পরিষদের দাবি, ৫ বছর আগেও ডিম ও মুরগি বড় অংশ আসত ছোট ছোট খামার থেকে। কিন্তু বিদেশী বিনিয়োগ আসায় বন্ধ হয়েছে অসংখ্য খামার। দেশীয় খামারিরা ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করলেও বিদেশী কোম্পানি গুলো তা করছে ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি মশিউর বলেন, অবশ্যই বিদেশীরা বিনিয়োগ নিয়ে আসবে কিন্তু মুরগি পালনের জন্য নয়, যেটা আমরা পারি না সেটা নিয়ে। তাই আমি মনে করি সরকারের এটি একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত।

কৃষি অর্থনীবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘাটতিতে দেশীয় যে বিনিয়োগ আছে তা রক্ষায় কৌশলী হতে হবে সরকারকে। এই প্রতিরক্ষণের জন্য তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিতে হবে এবং তাদেরকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে হবে এবং সম্ভব হলে ঋণের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে হবে। এছাড়া খাদ্যের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়া উচিত। অন্যথায় এটা সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে এবং টিকে থাকতে পারবে না।
রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের কারণে দেশে ঢুকছে বিদেশী পোল্ট্রিশিল্প। অথচ বিদেশীদের আগ্রাসনের কারণে এভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক খামারগুলো। এসব খামারের খামারীদের দাবি রাষ্ট্র যদি এই নীতিগত সিদ্ধান্ত না বদলায় পথে বসবেন দেশীয় উদ্যোক্তারা।

 

http://www.dailysangram.com/post/310171