৫ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২৩

সম্ভাবনা হারাচ্ছে অন্তহীন সংকটে

বাংলাদেশের আলুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে রাশিয়ায়। ইউরোপের বাজারে দেশি লেবু, ঢেঁড়স ও বেগুনের মতো অনেক সবজি রয়েছে পছন্দের তালিকায়। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও রয়েছে বাংলাদেশি সবজির চাহিদা। যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশেই আম বেশ জনপ্রিয়। তবে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে সবজি ও ফল রফতানির বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও অন্তহীন সমস্যা ও সংকটে সে সুযোগ কাজে লাগতে পারছে না বাংলাদেশ। ফলে বিদেশে প্রতিনিয়ত কমছে সবজি রফতানি।

গত অর্থবছরে মাত্র আট কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৬৬৪ কোটি টাকার সবজি রফতানি করে বাংলাদেশ। গত চার বছরের মধ্যে এটি সর্বনিম্ন। একই অর্থবছরে সবজি রফতানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ কোটি ডলার। এতে করে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩২ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। চার বছর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ খাতে রফতানি হয় প্রায় ২১ কোটি ডলার। এ সময়ে রফতানি কমেছে ৬১ শতাংশ।
সংশ্নিষ্টরা জানান, এ খাতে রফতানি কমার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তার মধ্যে উড়োজাহাজে স্থানের অভাব, মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া, ইউরোপের দেশগুলোর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ, অপর্যাপ্ত হিমাগার, সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব অন্যতম নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। স্থানীয় শাকসবজি রফতানিকারকরা বলেছেন, এসব সমস্যা নিরসন হলে ২০২১ সালের মধ্যে এ খাত থেকে ১০০ কোটি ডলার বা আট হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।

সংশ্নিষ্ট রফতানিকারক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বেশিরভাগ সবজি ও ফল ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে রফতানি হয়। মোট রফতানির ৭২ শতাংশ হয় মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে। আর মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় সৌদি আরবে। অবশিষ্ট ২৮ শতাংশ যায় ইউরোপের দেশগুলোতে। অন্যদিকে, তালিকায় ইউরোপের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাজ্য। ইথেনিক ও সুপার- বিশ্বে দুই ধরনের সবজির বাজার আছে। বিশ্বের যেসব দেশে বাংলাদেশিরা বসবাস করেন, তারাই এ শাকসবজির বড় ক্রেতা। এ বাজারকে বলা হয় ইথেনিক। বাংলাদেশের সবজির বাজার মূলত ইথেনিকভিত্তিক। আর বিদেশি ক্রেতাদের বাজারকে বলা হয় সুপার। তবে বাংলাদেশের পক্ষে পূর্ণাঙ্গ গুণগত মান ঠিক রেখে তা রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না।

সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, রফতানি বাড়াতে হলে মানসম্মত সবজি ও ফল উৎপাদন করতে হবে। কারণ, বিদেশিরা চান 'উত্তম কৃষির পরিচর্যা' বা গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও এ পদ্ধতি অনুসরণ করে বিশ্বমানের উপযোগী স্বাস্থ্যসম্মত শাকসবজি উৎপাদন করতে পারছে না। যে কারণে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের শাকসবজির অফুরন্ত সম্ভাবনা থাকার পরও তা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে সংশ্নিষ্ট রফতানিকারকরা বলেছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, কার্গো উড়োজাহাজ নেই। ফলে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে জায়গা কম থাকে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিমানের ঘন ঘন সময়সূচির পরিবর্তন, অবকাঠামো সমস্যা, অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে দেশি শাকসবজির খরচ বেড়ে গেছে। এতে করে ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (সঙ্গনিরোধ বিভাগ) উপপরিচালক আনোয়ার হোসেন খান সমকালকে বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শাকসবজিসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য উৎপাদনে যে ধরনের সক্ষমতা দরকার, আমাদের তা নেই। তার মতে, ইউরোপের ভোক্তারা স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুবই সচেতন। রোগবালাইমুক্ত খাদ্যপণ্য খেতে চান। মানসম্মত উপায়ে চাষ করে শাকসবজি রফতানি করতে পারলে এ খাতে আয় বর্তমানের চেয়ে পাঁচ গুণ বাড়ানো সম্ভব। এ জন্য উত্তম কৃষি পরিচর্যা অনুসরণ করতে হবে। রফতানিকারকদের সচেতনতার পাশাপাশি কৃষকদের সংগঠিত করার পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশ সবজি ও ফল রফতানিকারক সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, অতিরিক্ত বিমান ভাড়া, স্থানের অভাব, সময়সূচি পরিবর্তনসহ নানা কারণে সবজি রফতানি ব্যাহত হচ্ছে। সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে আকাশপথে প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ টন সবজি ও ফল যাচ্ছে। অথচ চাহিদা আছে ১২০ টনের। ফলে চাহিদার অর্ধেকের বেশি রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপযুক্ত পরিবেশে শাকসবজি চাষ না করার অভিযোগে গত তিন বছরে ৬০৫টি রফতানির চালান (এক চালানে দুই টন) বাতিল করে দিয়েছে ইউরোপ। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ১১৯টি, ২০১৫ সালে ১৪৭, ২০১৪ সালে ১৯৫ ও ২০১৩ সালে ১৪৪টি চালান রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ইউরোপের নিয়ম বেশ শক্ত। তারা চায়, বাংলাদেশ উন্নতমানের কৃষিপণ্য উৎপাদন করুক। এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ দেখতে চায় ইউরোপ। কিন্তু সবজি-ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সে ধরনের সক্ষমতা এখনও গড়ে ওঠেনি। যে কারণে এ খাতের রফতানি কমে গেছে।
রাশিয়ায় আলু রফতানি বন্ধ : ২০১৩ সাল থেকে আলু রফতানি শুরু করে রাশিয়া। তবে তা এখন বন্ধ রয়েছে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে যে আলু পাঠানো হয়, তাতে 'ব্রাউন রট' নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার জীবাণু পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ করেছে রাশিয়া। ফলে আলু দ্রুত পচে যায়। রুশ সরকার মনে করে, বাংলাদেশের জীবাণুযুক্ত আলু আমদানি করলে তা ছড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের রোগবালাই সৃষ্টি করবে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের আলুকে স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকায় রেখেছে দেশটি। যে কারণে ২০১৫ সালের মে থেকে আলু নেওয়া বন্ধ রেখেছে রাশিয়া। রফতানি আবার শুরু করতে জীবাণুমুক্ত আলু চাষ, ল্যাবরেটরি স্থাপনসহ বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে তারা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, এসব শর্ত পূরণ করতে পারলে রাশিয়ায় বছরে কমপক্ষে ১০ লাখ টন আলু রফতানি সম্ভব। তবে আশার কথা, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর আলু রফতানি হচ্ছে।

আমে মাছি-পোকা : যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও তা পূরণ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের আমে 'সালমোনেলা' নামে এক ধরনের মাছি-পোকা থাকে। যুক্তরাজ্য সরকার মনে করে, এটি এক ধরনের জীবাণু। বাংলাদেশ থেকে আম নিলে সে দেশে এই জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে জন্য বাংলাদেশ থেকে আম নিতে অনীহা দেখাচ্ছে যুক্তরাজ্য। একই অবস্থা বিরাজ করছে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। এর প্রভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আম রফতানি কমে গেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে আম রফতানি হয়েছে ৫৪ টন। কিন্তু এর আগের বছরে রফতানি হয় এক হাজার টন।
সবজি রফতানিকারকরা জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে সবজি-ফল আমদানিতে নিয়মকানুন কঠোর করেছে। যে কারণে রফতানি কমে গেছে। তবে তাদের মতে, ইউরোপ থেকে বাংলাদেশি পণ্যে পোকামাকড় বেশি থাকে বলে যে অভিযোগ করা হয়, তা পুরোপুরি সত্য নয়। পৃথিবীর সব দেশেই পোকামাকড় রয়েছে। তবে গ্রীষ্ফ্মপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশে পোকামাকড় তুলনামূলক বেশি থাকে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সবজি-ফল রফতানিকারক সমিতির উপদেষ্টা মো. মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে উত্তম কৃষি পরিচর্যা পদ্ধতি অনুসরণ করে বাংলাদেশে শাকসবজি চাষ হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও সবজি রফতানিকারক সমিতি সমন্বিতভাবে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। আশা করা যাচ্ছে, সমস্যাগুলো সমাধান করা যাবে এবং রফতানি বাড়বে।

মাত্রাতিরিক্ত বিমান ভাড়া : ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাংলাদেশ বিমানে অতিরিক্ত ভাড়া শাকসবজি, ফলমূল রফতানিতে অন্যতম বাধা। এ ছাড়া স্থান সংকুলানের কারণে সবজি নিতে চায় না বিমান। আবার ইউরোপের অনেক দেশে বিমানের কোনো রুট নেই। ফলে বিকল্প হিসেবে বিদেশি এয়ারলাইন্সে যেতে হয়। কিন্তু বিদেশি উড়োজাহাজে বিমানের তুলনায় ভাড়া অনেক বেশি। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, সবজি-ফল পচনশীল পণ্য। সব সময় সংরক্ষণে রাখতে হয়। তা না হলে সবজি টাটকা থাকে না। বিমানের প্রায়ই সময়সূচি পরিবর্তন হয়। কিন্তু সবজি রাখার মতো বিমানবন্দরে কোনো হিমাগার নেই। ফলে খোলা আকাশের নিচে সবজি রাখতে হয়। এতে করে তা দ্রুত পচে যায়।

সূত্র জানায়, বর্তমানে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে বিমানে পরিবহনের জন্য এক কেজি সবজি রফতানিতে ভাড়া দিতে হয় ৯০ থেকে ১১০ টাকা। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলোতে ১৩০ টাকা। কিন্তু বিদেশি উড়োজাহাজে প্রতি কেজিতে ভাড়া নেওয়া হয় গড়ে ১৬০ টাকা। অথচ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে প্রতি কেজি সবজি রফতানিতে খরচ পড়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। সবজি রফতানিকারক সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বিদেশি উড়োজাহাজগুলো আমাদের গলা কাটছে। এ ক্ষেত্রে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের তদারকি নেই।

রফতানির চিত্র : বাংলাদেশ থেকে যেসব সবজি ও ফল রফতানি হয় তার মধ্যে রয়েছে- শিম, পুঁইশাক, লাউশাক, কচুর লতি, গাজর, কচুশাক, ধনেপাতা, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া ও মুলা অন্যতম। উল্লেখযোগ্য ফলের মধ্যে রয়েছে কাঁঠাল, আনারস, তাল, কতবেল, লটকন, জাম ও সফেদা। তবে হতাশার বিষয় হলো বাংলাদেশ থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে সবজি ও ফল রফতানি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট রফতানি হয় প্রায় এক হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক হাজার ১৩৬ কোটি এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯৯২ কোটি টাকা।

 

http://samakal.com/economics/article/1712225