৫ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৬

বেশি লাভের জন্য ব্যাংক ছেড়ে গ্রাহকরা ছুটছেন সঞ্চয়পত্রে

দেশে বিনিয়োগ নেই অথচ অলস টাকার পাহাড়ে বরফ গলছেনা। ব্যাংকে টাকা রেখে আমানতকারিদের লোকসান গুণতে হচ্ছে। ব্যাংক খাতে অস্থিরতা ও আমানতের সুদ হার কমে যাওয়ায় আমানতকারীরা ছুটছেন সঞ্চয়পত্রের দিকে। চলতি অর্থবছরে অক্টোবরে আবার বেড়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৪ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। যা সেপ্টেম্বরে ছিল তিন হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণে জাতীয় ব্যয় বাড়ছে। তা না হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে।

ব্যাংকে আমানত অস্বাভাবিক হারে কমছে। মূলত সুদের হার কমায় আমানতকারীরা এখন আর ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহী হচ্ছেন না। আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও কমানো হচ্ছে বলে বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। অর্থনীতিবিদদের মতে, সঞ্চয়ের বিনিময়ে প্রাপ্ত সুদ মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি হতে হয়। অন্যথায় টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমায় সঞ্চয়কারীকে লোকসান গুণতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদ ৫ দশমিক ১ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকে রাখা টাকার ক্রয়ক্ষমতা যতটুকু কমছে সে পরিমাণ সুদও পাচ্ছেন না আমানতকারী। এতে লোকসান হচ্ছে আমানতকারিদের।
জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগযোগ্য বিপুল পরিমাণ অলস অর্থের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে তা গত নবেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ওপর তৈরি করা। এর আগের বছর একই সময়ে অর্থাৎ ২০১৫ সালের নবেম্বরে ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগযোগ্য তারল্যের পরিমাণ ছিল প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকে অলস টাকার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ, আর বাস্তবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। দেশের বিনিয়োগের অসংখ্য ক্ষেত্র থাকলেও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের অভাবে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন না।
একই কারণে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়ের প্রবণতা বাড়ছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে ব্যাংকে জমা থাকা অলস টাকার পরিমাণ যেমন কমে যাবে তেমন বৃদ্ধি পাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। জাতীয় উৎপাদনেও আশাজাগানিয়া সাফল্য অর্জিত হবে। উৎপাদনবান্ধব পরিবেশের জন্য বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ ইন্ধনশক্তির জোগান নিশ্চিত করা দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ব্যাংকের সামগ্রিক আমানতের প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশে নেমেছে। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিলো ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমানতের সুদ হারের চেয়েও মুদ্রাস্ফীতি বেশি হওয়া ও ব্যাংক খাতে অস্থিরতা দেখা দেয়ার কারণে সঞ্চয়পত্রের দিকে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।

ব্যাংকে বর্তমানে আমানতে সুদের হার পাঁচ থেকে ছয় শতাংশের মধ্যে। আবার ম্দ্রুাস্ফীতি ৬ শতাংশের উপরে। তবে বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের সুদ হার প্রায় ১১ থেকে ১২ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র কিনতে এসেছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, ব্যাংকে আমানত রাখার চেয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা অনেক নিরাপদ ও লাভজনক। তাছাড়া ব্যাংকগুলোতে যে হারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে আমানত রাখলে তা ঠিক সময়ে ফেরত পাওয়া যাবে কিনা তা এখন ভাবনার বিষয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, আগস্টে ৩ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা আর জুলাইয়ে ৫ হাজার ৫৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার নিট ঋণ ১৭ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা নিলেও মোট বিনিয়োগ হয়েছে ২৬ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্য থেকে আগের বিনিয়োগ করা সঞ্চয় স্কিমগুলোর মূল ও মুনাফা বাবদ ৯ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা পরিশোধের পর নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল ও মুনাফা পরিশোধের পর যে পরিমাণ অর্থ অবশিষ্ট থাকে, সেটাই নিট ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা, যা অর্থবছরের পুরো সময়ের লক্ষ্যমাত্রার ৫৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ সময় সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে এ খাত থেকে ঋণ নেয়ার কথা ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
তবে চলতি অর্থ বছরের প্রথম চার মাসে নেয়া এই ঋণ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। ওই সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছিল ১৫ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৭৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত চার মাসে পরিবার সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে ৬ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা, যা বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এছাড়া তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র থেকে ৪ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা। আর পেনশনার সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হয় এক হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক খাতে কিছুটা অস্থিরতা চলছে। তাছাড়া আমানতের সুদ হার ৫ থেকে ৬ শতাংশ। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশেরও বেশি। আমানত রাখলে মুনাফা না হয়ে বরং মূলধন কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই তারা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে।
মূলত আমানতের সুদ হার কম হওয়ায় মানুষজন সঞ্চয়পত্রকেই নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করে। বর্তমানে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ, পেনশন সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ সুদ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া তিন বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ আর ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
এদিকে সুদ কমছে সঞ্চয়পত্রেরও একজন ব্যাংকার হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, সরকারি ব্যাংকে কেউ এক লাখ টাকা তিন মাস মেয়াদে এফডিআর করলে উৎস কর ও আবগারী শুল্ক কেটে নেয়ার পর গ্রাহক ফেরত পাবে ৯৯ হাজার ৯৫৬ টাকা।
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেন, ব্যাংকে যারা টাকা রাখেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নিরাপত্তার জন্য রাখেন। যারা সঞ্চয় থেকে সুদ পাওয়ার উদ্দেশ্যে রাখেন তাদের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে।

ড. জায়েদ বখত বলেন, আমাদের সঞ্চয়ের খাত খুব সীমিত ব্যাংকের আমানত রাখা, সঞ্চয়পত্র কেনা এবং পুঁজিবাজারে খাটানো। সুতরাং যারা খুব বেশি ঝুঁকি নিতে পারবে না, তাদেরকে সঞ্চয়পত্র কিংবা ব্যাংকেই টাকা রাখতে হবে। তবে মূল্যস্ফীতির হার সুদের হারের চেয়ে বেশি হওয়ায় এমনিতেই মানুষ ব্যাংক আমানতের ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে কোনো মুনাফাই করতে পারছে না। কারণ এই মুহূর্তে সঞ্চয়ের কারণে বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে না। বরং ভোগ ব্যয় বাড়লে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
জানা গেছে, বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে। যেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতের সুদ ৫ দশমিক ১ শতাংশ। সাধারণত সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের আমানতের সুদের মধ্যে দুই থেকে এক শতাংশ পার্থক্য থাকতে হয়। সেখানে বাংলাদেশে পার্থক্য অনেক বেশি। এতে সরকারের বাজেট ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে ব্যাংকের আমানতের সুদ কমলেও ব্যাংকের ঋণের সুদ ততোটা কমেনি। ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে মন্দ ঋণ বেশি হওয়ায় তাদেরকে অনেক বেশি সঞ্চিতি রাখতে হয়। আর সেটি রাখতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর মুনাফা যেন না কমে সেজন্য তারা ঋণের সুদ কমাচ্ছে না।

এদিকে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ায় সরকারের ব্যয় বাড়ছে। বিশেষত, সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে বেশি ঋণ নেয় বলে এ ঋণের সুদ মেটাতে গিয়ে সরকারকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ায় বাজেটে সরকারের সুদ বাবদ ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। অথচ সরকার চাইলে এর চেয়ে কম সুদে ব্যাংক থেকেও টাকা নিতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারের বাজেট ব্যয় কমে যাবে।
জানা গেছে, ব্যাংকে আমানতের সুদ হার কম হওয়াতে বিকল্প হিসেবে সঞ্চয়পত্র কিংবা পোষ্ট অফিসে টাকা রাখছেন। তার পরেও ব্যাংকগুলোতে পাহাড় সম টাকা পড়ে রয়েছে। ব্যাংকগুলো চাইলেও বিনিয়োগ করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলো সুদ হার কমালেও বিনিয়োগ বাড়ছে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে ব্যাংক আমানত রাখলে লাভ তো পায় ই না উল্টো লোকসান হচ্ছে। আর এ কারনেই ব্যাংকে আমানত না রেখে সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুকছে গ্রাহকরা।

ব্যাংকগুলো বলছে আমাদের কোন তারল্য সংকট নেই। তাহলে কেন আমরা সুচ্চ সুদ হারে আমানত নিব। টাকা বিনিয়োগ করতে না পারলে আমানত নিয়ে কি হবে। আর গ্রাহককে বছর শেষে কিভাবে লাভ দিব। সব মিলিয়ে ব্যাংক ব্যবসায চলছে এক অস্তিরতা। এ অস্তিরতা কাটাতে চাইলে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর বিনিয়োগ বাড়লেই আমানতের সুদ হার বাড়ছে। অলস টাকার পাহাড়ে বরফ গললে বিনিয়োগ বাড়বে। দেশে নতুন করে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

ব্যাংকে সুদ হার সবচেয়ে কম হওয়ার কারণে মানুষ বিলাস পণ্যে তাদের অর্থ ব্যয় করছে। এতে করে দেশে উৎপাদন কম হচ্ছে। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের রফতানি খাতে। দেশে নতুন করে বড় ধরনের কোন বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে বাজার চলে যাচ্ছে বহুজাতিক বিদেশী কোম্পানিগুলোর হাতে। এতে করে দেশিয় কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে চাই যে কোন মূল্যে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তা না হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। এ নিয়ে সরকারকে একই চিন্তা করতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/310072