৫ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৫

রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সন্ধানে

দেশে এখন রাজনীতি নেই। তার পরিবর্তে আছে প্রতিহিংসা, অস্ত্রবাজি এবং গলাবাজি। অনেকের মত, দুর্ভাগ্যবশত: যারা ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী তার অনুঘটক হিসেবে তারা কাজ করছে। আমি রাজনীতিবিদ নই, কিন্তু রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করি। ইদানীং কলমের আগায় রাজনীতি আনতে বড় ভয় লাগে। কে জানে কার আঁতে ঘা লাগবে, তারা রেগে মেগে বাসার সামনে এসে ককটেল ফোটাবে, অথবা অন্যকিছু করে বসবে। এ প্রেক্ষিতে ইদানীং রাজনীতি নিয়ে লেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। গুতুনীর ভয়ে দুঃস্বপ্নের মধ্যে থেকে কি লাভ? কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে মানুষ অভ্যাসের দাস, আমিও যেহেতু মানুষ তাই মাঝে-মধ্যে কিছু না লিখলে হাত নিসপিস করে, মগজ নিস্তেজ হয়ে যায়।

সম্প্রতি বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছেন। শুনানির জন্য নির্ধারিত দু’টি মামলায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে এই পরোয়ানা জারি করা হয়। হাজিরার দিন বামপন্থী কয়েকটি দল দেশব্যাপী হরতাল ডেকেছিল। ইতোপূর্বে হরতালের দিন যানবাহন সংকটকে সামনে রেখে বিচারাধীন মামলাসমূহে আসামীদের হাজিরা মওকুফ করে দেয়ার নজির ছিল। এ প্রেক্ষিতে বেগম জিয়ার আইনজীবীরা মনে করেছিলেন যে, তার মত একজন ভিআইপি আসামীর হাজিরাও এই হরতালের দিনে মওকুফ করে দেয়া হবে এবং তারা তাকে আদালতে হাজির হতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আদালত গরহাজির থাকার ব্যাপারে তার ব্যাখ্যা গ্রহণ করেননি। বেগম জিয়া একজন সম্মানিতা নাগরিক। তিনি বাংলাদেশের তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং ২০ দলীয় জোটের প্রধান, সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং স্বাধীনতার ঘোষক জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। যে দু’টি মামলায় তিনি আসামী, এই মামলাগুলো হয়েছিল সেনাশাসিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে। এ ধরনের মামলা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অসংখ্য নেতানেত্রীর বিরুদ্ধেও ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও এ ধরনের ১৪টি মামলা ছিল। অনেক নেতাকে জানি যারা স্ত্রী-পুত্র, কন্যা জামাতাসহ দুর্নীতির দায়ে তিন থেকে ৩১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। অনেকে পলাতক ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মামলা ও মামলার শাস্তির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটে। এই মামলা এবং মামলার শাস্তিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে আখ্যায়িত করা হয়। যারা ক্ষমতায় আসলেন তারা বেছে বেছে তাদের দলের নেতাকর্মীদের মামলাগুলো তুলে নেয়ার জন্য কমিটি করলেন এবং তুলেন নিলেন। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারোর মামলাই তোলা হলো না। শুধু তাই নয়, তারা মামলা তুলেই ক্ষ্যান্ত হননি। নিষ্পত্তিকৃত মামলায় যারা শাস্তি পেয়েছিলেন, তাদের শাস্তিও মওকুফ করিয়ে নিয়েছিলেন। যাদের শাস্তি হয় নিয়মানুযায়ী তাদের শাস্তি মওকুফ করতে হলে একদিনের জন্য হলেও তাদের আদালতের নির্দেশ পালন করতে হয়, জেলের ভেতর ঢুকতে হয়।

কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীদের বেলায় তা মেনে চলা হয়নি, সে প্রশ্নও উঠেনি। বেগম জিয়াসহ বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আগের মতই রাজনৈতিক হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। বিচারকদের বিচারিক স্বাধীনতা কতটুকু আছে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। স্বয়ং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির অবস্থা দেখে কি আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি না? সরকারের তথা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে তিনি টিকে থাকতে পারেননি। তাকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে এবং দেশের বাইরে থেকেই পদত্যাগ করতে হয়েছে (যদিও তিনি পদত্যাগ করেননি বলে একটি মেসেজও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে)। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা ভিন্ন মতাবলম্বী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া কতটুকু ইনসাফ পাবেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠাটা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক বলেই ইনসাফে বৈষম্য সৃষ্টি অন্যায়। দুনিয়া পাল্টায় কথাটা মনে রাখা দরকার। রম্য সাংবাদিক বন্ধুবর মরহুম বুরহান উদ্দিন খান প্রায়ই একটা সংস্কৃত শ্লোক বলতেন, ‘করতল কলিতা মলক বদং মলং, পৃথিবী যে গোলং।

অর্থাৎ পৃথিবী হাতের তালুর ন্যায় চ্যাপটা নয়, বরং গোল, যদিও বাংলাদেশের মানচিত্র আদৌ গোল নয়। অবশ্য মনুষ্য চরিত্রে বার বার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি দিয়ে ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ভালোবাসা না থাকলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না। রাজনৈতিক শিষ্টাচারের প্রধান উপাদান শান্তি, ভালোবাসা, পারস্পরিক সহনশীলতা ও শ্রদ্ধা। আমাদের সমাজে এই শিষ্টাচার অনুপস্থিত। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে মেনিফেস্টো দিয়েছিল তাতে রাজনৈতিক শিষ্টাচার ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ছিল। তাদের ৯ বছরের মাসনে কি এর পরিচয় পাওয়া যায়?
[দুই]
নিরীহ, নিরপরাধ মানুষের উপর সন্ত্রাসবাদের দায় চাপিয়ে তাদের শাস্তি প্রদান নিঃসন্দেহে একটি মারাত্মক অপরাধ। এই অপরাধের সাথে যদি রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনও অঙ্গ বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা প্রশাসন জড়িয়ে পড়ে অথবা আইনি প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতার ব্যাপারে নাগরিক সমাজ সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়ে তাহলে রাষ্ট্র উৎপীড়কে পরিণত হয়। এ ধরনের রাষ্ট্র মানুষের অভিশাপের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। গত নয় বছর ধরে আমাদের দেশে নিরপরাধ মানুষের প্রতি রাষ্ট্রীয় উৎপীড়ন সকল মাত্রা অতিক্রম করেছে। এই উৎপীড়ন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে পারিবারিক পরিম-লেও এসে ঢুকে পড়েছে। কেউ এখন নিরাপদ নয়। এই উক্তি বা মন্তব্যের স্বপক্ষে লক্ষ লক্ষ উদাহরণ আছে। সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ দিচ্ছি।

গত ৩০ নবেম্বর বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় একটি মারাত্মক ও উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে। আমার দৃষ্টিতে নিউজ সেন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটি পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলে লীড নিউজ হবার উপযুক্ত ছিল। কিন্তু এর প্রতি আমাদের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ট্রিটমেন্ট ছিল অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানির মত। অনেক পত্রিকা সংবাদটি ছাপেনইনি। অনেকে ছেপেছেন নিতান্ত না পারতে, সিঙ্গেল কলামে এমন এক জায়গায় যেখানে পাঠকদের সহজে চোখ পড়ে না। সংবাদটি ক্ষমতাসীন দলের একটি অঙ্গ সংগঠনের বিরাট একটি অপকর্ম নিয়ে। তাদের এ ধরনের অপকর্ম অহরহ ঘটায় হয়তো কেউ পান্তাভাত’ মনে করে একে Proper treatment দেননি।

আবার এমনও হতে পারে যে, পছন্দের বা ভালোভবাসার দলটির অপছন্দনীয় কাজটির উপর নিউজ করতে তারা লজ্জা পেয়েছেন। তাদের এই লজ্জা জাতিকে যে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে তা কি তারা ভেবে দেখেছেন?
এখন সংবাদটিতে আসি। এতে বলা হয়েছে, ময়মনসিংহের গৌরীপুরে উপজেলা যুবলীগের কোন্দলের জের ধরে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসভবনসহ পাঁচ স্থানে একযোগে পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার যুবলীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হবার কথা ছিল। এইদিন ভোরে সম্মেলন মঞ্চেও আগুন দেয়া হয়। উপজেলা প্রশাসন শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সম্মেলন স্থগিত করা হয়। বিক্ষুব্ধ যুবলীগ কর্মীরা সম্মেলন প- করার জন্য স্থানীয় এমপি নাজিমুদ্দিন আহমদকে দায়ী করেন। প্রতিবাদে তারা ইউএনও’র বাসভবন, সিনেমা হল মোড়, স্টেশন রোড মোড়, কালিপুর মধ্যম তরক এবং বালুয়াপাড়ায় একযোগে পেট্রোল বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। গৌরীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ দেলোয়ার আহমদ জানান, পেট্রোল বোমা বিস্ফোরণের আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। কে বা কারা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। ইউএনও কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারির পর পর পৌর কাউন্সিলর ও উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী মোফাজ্জল হোসেন খান অভিযোগ করেন যে, সম্মেলন স্থগিত করে জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ১৪৪ ধারা জারী করেছেন। তার এই মন্তব্যের পেছনে কোন যুক্তি আমি খুঁজে পায়নি। যুবলীগের সম্মেলন হওয়া না হওয়ার সাথে জামায়াত-শিবিরের সম্পর্ক কি?
সরকারের এমন আচরণের অর্থ হতে পারে জামায়াতকে সরকার নির্বাচনী রাজনীতির জন্য ভীতিকর মনে করে। এই ধরনের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ সামনে রেখেই মানবিক ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে সরকার নির্বাচনী মাঠের বাইরে রাখতে চায় জামায়াতকে।

জামায়াত নেতারা ঘরোয়া বৈঠকে বসলেও তাদের নাশকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালানোর মিথ্যা অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা ও ব্যবহারের মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। মামলা হয়। আবার বাস্তবে যারা নাশকতা সৃষ্টি করেন, বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেন তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কেউ অপরাধ না করেই শাস্তি পাবেন আর কেউ অপরাধ করেও শাস্তি পাবেন না এটা সভ্য আচরণ নয়। এই মিথ্যা অভিযোগে জামায়াতের আমীর এবং সেক্রেটারি জেনারেলকে সরকার গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছেন। একযোগে পাঁচ জায়গায় পেট্রোল বোমা বিস্ফোরণ সরকারী কর্মকর্তার বাসায় হামলা এবং অগ্নিসংযোগের জন্য সরকারী দলের লোকেরা ছাড় পাবে কেন এ বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া দরকার। এসব কাজ কি সন্ত্রাস ও নাশকতা নয়?

http://www.dailysangram.com/post/310008