৫ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৪

নাগরিক হিসেবে আমরা কতটুকু সুশৃঙ্খল

ইকতেদার আহমেদ

শৃঙ্খলা নাগরিক হিসেবে একজন ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। একজন নাগরিক শিশু হিসেবে জন্ম-পরবর্তী নিজ পারিবারিক অঙ্গন এবং অতঃপর বিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে থাকে। একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও কর্ম জীবনে শৃঙ্খলা অপরিহার্য। নিয়মানুবর্তিতা, নিয়মবদ্ধ রীতি, নিয়মানুগত্যতা, প্রথা, ধরন, প্রণালী, পদ্ধতি প্রভৃতি শৃঙ্খলার সমার্থক। শৃঙ্খলার সাথে দায়িত্বশীলতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শৃঙ্খলাবোধসম্পন্ন ব্যক্তি সব সময় দায়িত্বশীল হয়ে থাকেন। শৃঙ্খলাবোধ একটি দেশ ও জাতির গর্বের বিষয়। একটি দেশ ও জাতির মধ্যে শৃঙ্খলাবোধের মাত্রা যত অধিক, সে দেশ ও জাতি তত বেশি সভ্য, উন্নত ও সমৃদ্ধ। ব্যক্তির মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ থাকলে তিনি হবেন অপরের অধিকারের ব্যাপারে সজাগ ও সচেতন। শৃঙ্খলাবোধসম্পন্ন ব্যক্তি রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে পালনে সদাসর্বদা সচেষ্ট থাকেন।

শৃঙ্খলা একটি দেশ ও জাতিকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের সম্মুখে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো জাপান। খনিজ সম্পদ দ্বারা জাপান সমৃদ্ধ না হলেও সুশৃঙ্খল মানবসম্পদের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশটি একদা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্র ছিল। সম্প্রতি চীন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্রের আসন দখল করায় বর্তমানে জাপানের অবস্থান তৃতীয়। চীনের নাগরিকরাও জাপানের নাগরিকদের ন্যায় সুশৃঙ্খল ও কর্মঠ। জাপানের একটি শিশুর মধ্যে ও শৃঙ্খলাবোধ ও দায়িত্বশীলতা কতটুকু প্রবল তার উদাহরণ ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে দেশটিতে সংগঠিত সুনামি-পরবর্তী এক পশ্চিমা সাংবাদিকের সংবাদ বিবরণীতে পাওয়া যায়। ওই সাংবাদিক উল্লেখ করেন, সুনামি-পরবর্তী তিনি পর্যবেক্ষণ করেন একটি আশ্রয়শিবিরে খাদ্যের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষমাণ লাইনের শেষভাগে একটি শিশু দণ্ডায়মান ছিল। লাইনে অপেক্ষারতদের মধ্যে বিতরণের উদ্দেশ্যে টেবিলের ওপর যে পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী রক্ষিত ছিল তিনি উপলব্ধি করতে পারেন, তা দিয়ে লাইনে দণ্ডায়মান সবাইকে খাদ্য প্রদান সম্ভব হবে না। এমতাবস্থায় ওই সাংবাদিক শিশুটির অসহায়ত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তার বরাদ্দকৃত খাদ্যসামগ্রী শিশুটিকে প্রদান করেন। এর কিছুক্ষণ পর ওই সাংবাদিক লক্ষ্য করলেন, শিশুটিকে দেয়া খাদ্যসামগ্রী শিশুটি টেবিলের ওপর রেখে পুনরায় লাইনের যে স্থানে দণ্ডায়মান ছিল সে স্থানে ফিরে গেছে। এ বিষয়ে ওই সাংবাদিক শিশুটিকে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়, আমার সম্মুখে লাইনে এমন অনেক আছেন যাদের খাদ্যের প্রয়োজন আমার চেয়েও বেশি। শিশুটির কাছ থেকে এমন জবাব পাওয়ার পর ওই সাংবাদিক উপলব্ধি করেন চরম বিপদ ও বিপর্যয়ের মুখে যে শিশুর মধ্যে শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধ অটুট, সে শিশু যে দেশ ও জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করছে তাদের কখনো কোনো ধরনের বিপর্যয় পরাভূত করতে পারবে না।
ওই সাংবাদিক জাপানে দায়িত্বপালন শেষে তার কর্মক্ষেত্র ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তনের সময় আমাদের দেশের একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কার্যক্রম অবলোকনের প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বাংলাদেশে আগমন করেন। এ দেশে অবস্থানকালে বেসরকারি সংস্থাটির কর্মকর্তাদের তিনি জানান তাকে বহনকারী বিমানটি হজরত শাহজালাল র: আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর যাত্রীদের অবতরণের নিমিত্ত বোর্ডিং ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই বেশির ভাগ যাত্রী নিজ নিজ মালামালসমেত বিমানের সম্মুখপানে অগ্রসর হতে থাকেন। বিমানের ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা বিমান সম্পূর্ণ না থামা পর্যন্ত যাত্রীদের নিজ নিজ আসনে অবস্থানের জন্য অনুরোধ করলেও তাদের নিবৃত্ত করা যায়নি। তার বর্ণনা মতে, যাত্রীদের বেশির ভাগ ছিলেন এ দেশীয়। তিনি বিভিন্ন দেশে তার দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতা তার জন্য ছিল অভিনব।
আমাদের দেশের অনেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে থাকেন। এসব ব্যক্তির অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় তারা ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে বিমানে ভ্রমণের সময় কখনো যাত্রীদের অবতরণকালীন হুড়োহুড়ির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন না যা শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রায়ই প্রত্যক্ষ করে থাকেন। একটি দেশ ও জাতির নাগরিকদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধের অভাব থাকলে তাদের মধ্যে এমন আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, এটি আজ আমাদের অনেকের বদ্ধমূল ধারণা।

পৃথিবীর সব উন্নত, সমৃদ্ধ ও সভ্য দেশে ট্রেন, বাস, বিমান, জাহাজ, লিফট প্রভৃতিতে ওঠা ও নামার সময় সব আরোহীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে দেখা যায়। তারা সব সময় ‘আগে নামতে দিন ও পরে উঠুন’ এ নিয়ম বা রীতি অনুসরণ করে থাকেন। আমাদের দেশে কিছু নির্ধারিত বাস এবং কিছু কার্যালয়ের লিফটে আরোহণের সময় লাইন ধরে আরোহণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেলেও এগুলোর একটা বড় অংশ এখনো কোনো ধরনের নিয়মনীতির বালাই ব্যতিরেকেই চলছে।

সব উন্নত দেশে মহাসড়ক ও সড়ক দিয়ে চলাচলের সময় যানবাহন সম্পূর্ণ শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলাচল করে। পেছনের গাড়ি সামনের গাড়িকে অতিক্রম করতে চাইলে প্রয়োজনীয় সঙ্কেত প্রদান ব্যতিরেকে তা কখনো করে না। আমাদের দেশে সড়ক ও মহাসড়ক, উভয় ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার কোনো বালাই নেই। রাজধানী ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে চলাচলরত যানবাহনগুলো সামনের গাড়িকে অতিক্রম করার সময় কোনো ধরনের সঙ্কেত ছাড়া ডান বা বাম উভয় পাশ দিয়ে অতিক্রম করা এখানে অনেকটা স্বাভাবিক হিসেবে দেখা হয়। গণপরিবহনগুলোর যাত্রী ওঠা ও নামার জন্য স্থান নির্ধারিত করে দেয়া থাকলেও এগুলোর চালকদের থোড়াই শৃঙ্খলা মেনে চলতে দেখা যায়। গণপরিবহন চালকেরা যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা করার জন্য এবং অধিক যাত্রী পাওয়ার আশায় পেছনের গণপরিবহন যেন সামনের গণপরিবহনকে অতিক্রম করতে না পারে, সে হীন উদ্দেশ্যে তার পরিবহনটিকে সড়কের ওপর এলোপাতাড়ি করে রাখে। এর ফলে পেছনের গণপরিবহনসমেত সব ধরনের যানবাহনের অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। যানবাহন চলাচল যেন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ট্রাফিক পুলিশ নিয়োজিত থাকলেও এদের বেশির ভাগই বিষয়টি উপেক্ষা করে অন্যভাবে অন্যায় প্রাপ্তির সুযোগের অপেক্ষায় সব সময় ব্যস্ত।

সুযোগের সমতা ও আইনের দৃষ্টিতে সমতা-আমাদের সংবিধানের দু’টি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রথমোক্তটি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং শেষোক্তটি মৌলিক অধিকার। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানে সব নাগরিকের জন্য এ দু’টি অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে এ দু’টি অধিকার ভোগের বিষয়ে আমাদের পার্থক্য হলো- অন্যান্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সব নাগরিক সমভাবে অধিকারটি ভোগ করে আর আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বিশেষ নাগরিকদের ক্ষেত্রে অধিকার দু’টি ভোগের বিষয়ে ছাড় দেয়া হয়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান সড়কযোগে চলাচলের সময় অপরের চলাচলের পথ কখনো রোধ করা হয় না এবং ট্রাফিক সঙ্কেত মেনে অপরাপর যানবাহনের মতো তাদের যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু আমাদের দেশে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান চলাচলের সময় অপরের চলাচল রোধ করা হয় এবং তাদের বহনকারী যানগুলোকে কখনো ট্রাফিক সঙ্কেতের কারণে থেমে থাকতে হয় না।

যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা না থাকায় যানজট আমাদের রাজধানী ঢাকা শহরে অসহনীয় হয়ে ওঠে। যানজটের কারণে রাজধানী শহরে চলাচলকারী প্রতিটি নাগরিকের প্রতিদিন ২-৩ ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়। কিন্তু যানজটের দুর্ভোগ হতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কিছুসংখ্যক পদধারী অবমুক্ত। আইন মেনে চলা বা না চলা এদের জন্য কোনো ধরনের নিয়মনীতির বাধ্যবাধকতায় যেন পড়ে না। তাদের যানবাহন যখনই যানজটের কবলে পড়ে তখন তারা সুযোগমতো উল্টো পথ দিয়ে চলে গন্তব্যে পৌঁছার প্রয়াস নেন। তাদের চলাচলের সময় যানবাহনের সম্মুখের আসনে পুলিশের পোশাক পরিহিত অস্ত্রধারী গানম্যান উপবিষ্ট থাকায় উল্টো পথে চলাচল নির্বিঘœ করার ক্ষেত্রে এ সুবিধাটিকে সহায়ক হিসেবে দেখা হয়।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় নাগরিকেরা তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে ক্রয় করে থাকেন। এসব দেশের সরকারপ্রধানসহ রাষ্ট্রের উচ্চপদধারীরা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে পণ্যসামগ্রী কিনে মূল্য পরিশোধকালে অপর সব নাগরিকের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে যথারীতি তা সমাধা করেন। আমাদের দেশে অধুনা বেশ কিছু ডিপার্টমেন্টাল স্টোর চালু হয়েছে। এগুলোয় সরকার প্রধান বা উচ্চ পদধারীরা উন্নত দেশের মতো না গেলেও কিছুসংখ্যক পদধারী এবং তাদের স্ত্রীদের দেখা যায় অস্ত্রধারী নিরাপত্তা রক্ষীসমেত কেনাকাটা শেষ করে মূল্য পরিশোধের সময় লাইনে দাঁড়ানোর তোয়াক্কা না করে নিরাপত্তা রক্ষীর উপস্থিতিতে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে অনেকটা লজ্জাহীনভাবে বীরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মূল্য চুকিয়ে প্রস্থান করেন।

নাগরিক হিসেবে আমরা যে সুশৃঙ্খল ও দায়িত্বশীল নই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর উপস্থিতি লক্ষণীয়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ঘটে যাওয়া অগণিত ঘটনা জাতি ও দেশ হিসেবে সত্যিই আমাদের জন্য দুঃখ ও মর্মবেদনার কারণ। আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধের বৃদ্ধি ব্যতিরেকে আমাদের পক্ষে দেশ ও জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে উচ্চ আসনে সমাসীন হওয়া সম্ভব নয়। হ
লেখক: সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/273872