৪ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৯:৪১

ঘটনাবহুল ২০১৭

দেখা অদেখা

সালাহউদ্দিন বাবর

২০১৭ সাল একটি ঘটনাবহুল বছর হিসেবে অতিক্রান্ত হতে চলেছে। ২০১৮ নির্বাচনের বছর। তার আবহ সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু আগামী বছরের জন্য কোনো শুভবার্তা রেখে যাচ্ছে না বিদায়ী বছরটি। বছরটিতে এমন কিছুই ঘটেনি, যা আগামীতে জাতিকে উদ্বুদ্ধ বা আশান্বিত করতে পারে। বরং বছরটির মন্দ বিষয়গুলো আগামী বছরে নানাভাবে ঘুরেফিরে এসে দেশকে ভোগাবে। ২০১৭ সাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে তেমন কোনো সাফল্য নেই। একটি বছর যায়, সে বছর থেকে কিছু প্রাপ্তি আশা করা হয়, যা দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দুর্ভাগ্য, এমন বছর সবার কাম্য হলেও তা হয়ে আছে দুর্লভ।

আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক নেতাদের কোনো একটি বছরকে বদলে দিয়ে সেখানে জাতির জন্য সৌভাগ্যের একটি বছর রচনার দায়িত্ব হলেও তারা সে নিয়ে ভাবনা-পরিকল্পনা করেন কি না, এর কোনো নজির দৃষ্টিগোচর হয় না। ভালো কিছু অর্জনের জন্য অনেক কিছুর সাথে জাতীয় ঐক্য নিতান্ত প্রয়োজন। সব বিষয়ে ঐক্য হবে, এটা অবশ্য বাস্তব নয়। কিন্তু আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করি, তা কিছুতেই ভালো কিছু অর্জনের জন্য সহায়ক নয়। কল্যাণচিন্তায় সবাইকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে, তার প্রয়োগপদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে। সেই ভিন্নতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে, কিন্তু বৈরিতা থাকবে না। এখন যা বিরাজ করছে, এমন বৈরিতা ২০১৭ সালে বেড়েছে। এই বৈরিতা সৃষ্টিতে লক্ষ করা গেছে, যারা ক্ষমতাসীন তারা বেশি সক্রিয়। অথচ জনগণ জাতীয়পর্যায়ে বৈরিতার চেয়ে ঐক্যকে পছন্দ করে। তা প্রমাণিত হয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে। কারো ডাক দেয়া ছাড়াই গোটা জাতি দুস্থ রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত যে ত্রাণ রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছে, তা প্রধানত সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে। তাদের দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও তারা রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় যে দিগন্ত ছোঁয়ার মতো, সেটাই বোঝা যায়। অথচ জনগণের সামর্থ্যরে এই পরিধিটা বাড়ানো প্রতিটি সরকারের দায়িত্ব। অথচ এ কথা বলা যাবে না, বর্তমানে বা অতীতে কোনো সরকার নিবিষ্টচিত্তে এই দায়িত্ব পালন করেছে।
২০১৭ সালে যেসব ঘটনা জাতীয় জীবনকে আলোড়িত করেছে এবং ইতিহাস হয়ে থাকবে, তার কয়েকটির ওপর আলোকপাত করতে চাই। আমরা আশা করব, নিশ্চয়ই আমাদের জাতীয় নেতারা বিষয়গুলো ভাববেন এবং এর প্রতিবিধান করার চেষ্টা করবেন। অতীত থেকে আমরা শিক্ষা পেতে চাই। যাতে আমরা আমাদের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে একটি নতুন প্রভাতের সূচনা করতে পারি। অতীত পর্যালোচনা করা, আর তা থেকে শিক্ষা নেয়ার ব্যাপারে কারো অহমিকা থাকা উচিত নয়। যারা কাজ করেন, স্বাভাবিকভাবেই কিছু ভুল তাদের হবে। কিন্তু যারা কিছুই করেন না, তাদের ভুল হয় না। যারা কাজ করেন না তাদের যেমন ভুল হবে না, সেই সাথে তাদের মুখে সমালোচনাও সাজে না।
রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ নির্বাহী বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগের দিনকাল ২০১৭ ভালোভাবে কাটেনি। নির্বাহী বিভাগের মূল দায়িত্ব দেশ পরিচালনা করা। সে ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের সাফল্য তেমন কিছু নেই। দেশের অর্থনীতি চলতে হয় বলে চলছে। রফতানি বাড়েনি, দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, রাষ্ট্রে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রয়েছে চরম অস্বস্তি, শিক্ষাঙ্গনে মারদাঙ্গা চলছে, ছাত্রসংগঠন বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ ছাত্রসংগঠন বেপরোয়া, আন্তঃকলহ ও অন্তঃকলহে তারা জড়িত। চলছে নকলবাজি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষাঙ্গনে বিরাজ করছে অসহনীয় বিশৃঙ্খলা। যারা এসবের প্রতিবিধান করবেন তারা দলপ্রীতির কারণে চোখ-মুখ বন্ধ করে আছেন। খুনখারাবি, গুম, অরাজকতার পক্ষে প্রশাসনের সাফাই গাওয়া হয়। নাগরিক জীবন, ভয়ভীতি, অভাব, অভিযোগ, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলায় ভরে আছে। দেশের মানুষ অসুখী এবং অস্বস্তিতে দিন অতিবাহিত করছে। এসব দুঃখ-কষ্ট দূর করার ব্যাপারে নির্বাহী বিভাগের কোনো প্রয়াস নেই, অথচ তারা আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। শেষ হতে চলেছে বছরটি এভাবেই কাটিয়ে দিচ্ছে নির্বাহী বিভাগ।

সমাজে যাদের কোনো ভূমিকা থাকে না বা কোনো গুরুত্ব নেই, তাদের কাজ বা প্রয়োজন অনুভূত হয় না, তারা আছে কি নেই তা বোঝার উপায় থাকে না। তেমন একটি অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ, আইন বিভাগ। অথচ আইন বিভাগের ভূমিকা হওয়ার কথা সব বিভাগের ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে। সবার কাজের তদারকি ও জবাবদিহিতা করাই এই বিভাগের দায়িত্ব। ইতঃপূর্বে আইন বিভাগ বা সংসদ এই ভূমিকাই পালন করেছে। পৃথিবীর সব দেশেই সংসদ রাষ্ট্রের ওয়াচডগ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্র যেসব দেশে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সেখানে সংসদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার ভূমিকা পালনের জন্য স্বীকৃত। সংসদে বিরোধীদলীয় সদস্যদের এমনকি একটি ছায়া মন্ত্রিসভাও থাকে। সরকারকে জবাবদিহি করতে হয় সংসদের কাছে। অথচ বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র কায়েম থাকা সত্ত্বেও এখানে সংসদের কোনো ভূমিকা আদৌ রয়েছে তা অনুভূত হয় না।
কারণÑ একটাই আর তা হলো সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই। যাচ্ছে বছরে সংসদ কতবার অধিবেশনে মিলিত হয়েছে, কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা কেউ বলতে পারবে না। এমনকি সংবাদপত্রে সংসদের খবরাখবর তেমন প্রকাশ পায় না তার গুরুত্বহীনতার কারণে। ২০১৭ সালে দেশে বহু ঘটনা ঘটেছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ঘটেছে অনেক কিছু। কিন্তু তা নিয়ে আমাদের সংসদ কোনো আলোচনা বা প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালে গঠিত এই সংসদ বিরোধী দলহীন হওয়ায় এর গুরুত্ব যেমন হারিয়েছে, তেমনি কোনো ভূমিকাও নেই।
রাষ্ট্রের অপর বিভাগ হচ্ছে বিচার বিভাগ, এর গুরুত্বও সমধিক। ২০১৭ সালে বিচার বিভাগ, বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। কখনো কখনো মনে হয়েছে নির্বাহী বিভাগ যেন বিচার বিভাগের প্রতিপক্ষ। সমাপ্তপ্রায় বছর ধরেই চলেছে সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে টানাপড়েন। এই টানাপড়েনের জের ধরেই সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছে। সরকারের সাথে বিচার বিভাগের সঙ্কটের সূচনা হয় নি¤œ আদালতের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি-মঞ্জুরিসহ নি¤œ আদালতের শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি নিয়ে। সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায়ের বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের সাথে সুপ্রিম কোর্টের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। সেটাই নির্বাহী বিভাগের সাথে বিচার বিভাগের মনোমালিন্যের সূচনা করে। তা ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানে আইন প্রশাসন বিচার বিভাগের ক্ষমতার পৃথকীকরণের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এই পৃথকীকরণ কার্যত দেখা যায় না। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের আচরণ, বিচার করার অধিকার, এমনকি তাদের শাস্তি দেয়ার অধিকার জাতীয় সংসদকে দেয়া হয়। এই সংশোধনী বাতিল করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। বস্তুত এ সংশোধনী, আদালতের অধিকার ও ক্ষমতা হরণ করার উদ্দেশ্যেই হয়েছে। এ জন্য আদালত নিজের অবস্থান এবং সেই সাথে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এ সংশোধনী বাতিল করে। এই রায় এবং রায়ের যে পর্যবেক্ষণ অংশ তা নিয়ে সরকার মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হয়। সে থেকে সরকারের সাথে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সরকার তার প্রতি বিরূপ হয়ে নীরবে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। এই ডামাডোলের মধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি অসুস্থতার কথা বলে ছুটিতে যান। ছুটি চলার একপর্যায়ে তিনি অস্ট্রেলিয়া যান। সেখান থেকে দেশে ফেরার কথা থাকলেও সিঙ্গাপুরে আসেন এবং সেখান থেকে তার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে কানাডা চলে গেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে দেশ ত্যাগের আগে তিনি ঢাকায় বলে যান, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। এ দিকে সরকারের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে অসুস্থতাসহ নানা অভিযোগও করা হয়। এমন ঘটনা বিশ্বে নজিরবিহীন। বিচার বিভাগ নিয়ে এমন সঙ্কট বাংলাদেশে অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি।

সমাপ্তপ্রায় বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বহু যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠিত হয়েছে। নানা ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে বিগত কমিশন বিদায় নেয়ার পর এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনের নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনাররা দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর রাজনৈতিক মহলে মিশ্রপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। গত আগস্ট মাসে আগামী নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর মতামত নিতে ইসি সংলাপের আয়োজন করে। ৪০টি নিবন্ধিত দল সংলাপে অংশ নেয়। এই সংলাপ সাফল্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এর আগে নির্বাচন কমিশন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করিয়েছে। এখন সবাই অপেক্ষায় রয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন ও কয়েকটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কিভাবে পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। বিগত ইসির অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষ যেমন হতাশ, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষুব্ধ। দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মতভেদ রয়েছে তার মূলে রয়েছে বিগত নির্বাচনগুলোর অনিয়ম। এখন একটি বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তার সাথে কমিশনের সম্পৃক্ততা আছে। আর সেটা হলোÑ বিএনপির নির্বাচনসহায়ক সরকারের দাবি প্রসঙ্গে। নির্বাচন কমিশনের কাছে সংলাপের সময় বিএনপিসহ আরো অনেক দল দাবি করেছে নির্বাচনে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য সংসদ ভেঙে একটি নির্বাচন সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। বিষয়টি সব বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও ইসি এ ব্যাপারে তেমন অর্থপূর্ণ কোনো বক্তব্য তো দেননি, পক্ষান্তরে তারা বিষয়টি সম্পর্কে তাদের অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়টি এখন রাজনৈতিক অঙ্গনের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে ২০১৭ সালে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে এবং তা চলছে। সংবাদপত্রগুলোতেও নির্বাচনের বিষয়ে বহু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এসব লেখা ও আলোচনার মুখ্য বিষয় হচ্ছে আগামী নির্বাচন যেন যেকোনো মূল্যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রশ্নমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি দলের পক্ষ থেকে ‘প্রশ্নমুক্ত’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। চার বছর ধরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সবার কথা আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে এই অস্থিরতার অবসান হতে হবে। আর এটা বলা প্রাসঙ্গিক হবে যে, পরবর্তী সংসদ নির্বাচন শুধু হলেই চলবে না; অবশ্যই অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ হতে হবে। আর চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলতে হয়, তেমন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব বহুলাংশে ক্ষমতাসীন সরকারের এবং ইসির।

২০১৭ সাল রাজনৈতিক-সামাজিক দিক থেকে দেশের তেমন কোনো অর্জন নেই। এর আগের বছরগুলো যেমন গতানুগতিক অতিবাহিত হয়েছে, তেমনি শেষ হতে চলেছে চলতি বছর। তেমন কোনো ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য রেখে যাচ্ছে না, যাতে বছরটিকে অন্যান্য বছরের তুলনায় বৈশিষ্ট্য দান করবে। সমাপ্তপ্রায় বছরটিতে দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা দূর হয়ে স্থিরতা আসেনি। সামাজিক জীবনেও তেমন কোনো কিছু ঘটেনি, যা সমাজের অগ্রযাত্রায় অবদান রাখতে পারে। আন্তর্জাতিক জীবন থেকেও তেমন কোনো বিষয় চয়ন করা যায় না, যা আমাদের বিশ্বের কাতারে শামিল করতে পারে। বিগত প্রায় বছরটিতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এই দু’জনের বক্তব্য-বিবৃতি তাদের কার্যক্রম ছিল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রধান আলোচ্য বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা ঢাকায় দু’টি বিশাল জনসমাবেশে বক্তব্য রাখেন। এ দু’টি ভাষণই দেশের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বেশ কিছুকাল দেশের বাইরে ছিলেন। দেশে ফেরার পর তিনি দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। গত অক্টোবর মাসে বেগম জিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখার জন্য কক্সবাজার গমন করেন। যাওয়ার পথে ২৮ অক্টোবর তার গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। এই হামলায় গাড়িবহরের বেশ কিছু গাড়ি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিএনপি অভিযোগ করেছে এই হামলা ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের দিয়ে সংঘটিত হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার জন্য খুবই ক্ষতিকর হয়েছে। এটা রাজনীতির অঙ্গনের জন্য কালো চিহ্ন রেখে গেছে।
বিএনপির মিত্র ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীকে বিগত বছরের মতো ২০১৭ সালেও নানা চাপের মুখে রাখা হয়েছে। এই দলের বহু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শত শত মামলা এবং তাদের আটক করা হয়েছে। জামায়াতকে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে দেয়া হচ্ছে না। গত অক্টোবর মাসে ঢাকা থেকে জামায়াতে ইসলামীর আমির মকবুল আহমাদ, সেক্রেটারি জেনারেল ডা: শফিকুর রহমানসহ দলের ৯ জন নেতাকে আটক করা হয়। তাদের আটকের সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে পুলিশ কিছু জানায়নি। এটা জামায়াতের জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আগমন এ দেশের আর্থসামাজিক জীবনে বিরাট এক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে ২০১৬ সাল থেকে এখন ২০১৭ সালে ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
মিয়ানমার সরকার এবং সে দেশের সেনাবাহিনী আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালায়। শত শত বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। মিয়ানমারের সেনারা নিরীহ রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতে শুরু করে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা নর-নারীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এতে এই নিরীহ মানুষ প্রাণ রক্ষার জন্য বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে শুরু করে। বাংলাদেশের জনগণ সহানুভূতির সাথে তাদের আশ্রয় দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘ সময় আশ্রয় ও ত্রাণ দেয়া সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেছে এবং তাদের কিছু সহায়তাও দিচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে এসব সাহায্য অব্যাহত থাকবে কি না এবং রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরে যাওয়া সম্ভব কি না, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে বটে। কিন্তু সে সমঝোতায় কী রয়েছে, তা জানা যায়নি। অবশ্য তা সরকারের কাছে প্রকাশের জন্য ইতোমধ্যে দাবি উঠেছে। রোহিঙ্গা সমস্যাটি নিয়ে সমাপ্তপ্রায় বছরে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে দেশে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থানের কারণে এখানকার আর্থসামাজিক জীবনে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের পেছনে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টি জরুরি বটে কিন্তু তাদের ফেরার সাথে কয়েকটি বিষয় সংশ্লিষ্ট। নাগরিকত্ব দিয়ে সম্মান ও নিরাপত্তার সাথে তাদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। এখানে আন্তর্জাতিক ভূমিকা গুরুত্বপূর্র্ণ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অপরিপক্বতা প্রকাশ পায়। প্রথম দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিশাহীন কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং কোন পথে অগ্রসর হবে তা যেন নির্ণয় করতে পারছিল না।

শেষ হচ্ছে বছরে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি শোচনীয় ছিল। হত্যা, গুম, হানাহানি ও নারী, শিশু নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ ও ভীতিজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শোচনীয়। মাদক দেশের যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে চলেছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা দেশের এই অবস্থায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পরিস্থিতির এমন অবনতি রোধ করতে না পারলে সব কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এত সব হতাশাজনক অবস্থার মধ্যেও একটি বিষয় এ বছর লক্ষ করা গেছে, উগ্রপন্থীদের তৎপরতা কমেছে। এখানে-সেখানে কিছু উগ্রপন্থীর অবস্থান থাকলেও সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা লক্ষণীয়। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির একটি ব্যারোমিটার হচ্ছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। বছরের এ পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো চাপ সংবাদপত্রের প্রতি লক্ষ করা না গেলেও নীরবে কলকাঠি নাড়া হয়। সংবাদমাধ্যম কিছুটা ভীতগ্রস্ত, নিজেরাই নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে। সব সমালোচনা সহ্য করার পরিবেশ নেই। কিন্তু একটি শুদ্ধ সমাজের জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা জরুরি।

শেষ কথা হচ্ছে, আগামী বছর দেশে গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ নির্বাচন। দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক সমাজ চায় ভালো একটি নির্বাচন, যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা বিতর্ক হবে না। এমন নির্বাচনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশের প্রয়োজন সর্বাধিক। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি এখন পর্যন্ত ভালো নির্বাচনের জন্য যে পরিবেশ দরকার সেটা দেশে বিরাজ করছে না। এই পরিবেশজনিত সঙ্কটের বীজ কিন্তু বহু আগে বপন হয়েছে। সহিষ্ণুতা ও পরমতের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব যৌক্তিক বিষয়ে একমত না হওয়ায় অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে বড় বাধা হয়ে আছে। আমরাই উপযুক্ত, সক্ষম, সেরা এই মনোভাব পোষণ করে থাকে আমাদের সরকারি দল। কিন্তু এই যোগ্যতা যাচাইয়ের দায়িত্বটা পালন করার কাজটা সবাই মিলে দিন না জনগণের ওপর। তারাই বেছে দিক উত্তম ও মন্দকে। ইতিহাস বলে, এ দেশের মানুষ কখনোই ভুল করেনি সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে। আসুন না আগামী বছর জনগণকে এই দায়িত্বটা অবাধে পালন করার সুযোগ দিই, কে যোগ্য হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/273552