৪ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৯:৩৬

কৃষকের কথাও ভাবুন

আশিকুল হামিদ : খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, কোনো একটি জাতীয় দৈনিক তার প্রধান শিরোনাম করেছিল, ‘ধান কৃষকের গলার ফাঁস’। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে আমি ‘সোনা নয়, সোনালী ফাঁস’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছিলাম। লিখতে গিয়ে নিজেকে বলেছিলাম, ফাঁস তো ফাঁসই, সেটা আবার সোনালী বা রূপালী হয় কিভাবে? কিন্তু প্রশ্ন করেও বোকা না হয়ে পারিনি। কারণ, প্রকাশিত রিপোর্টটিতে জানানো হয়েছিল, এবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এবং মাথায় হাত পড়েছে কৃষকদের। অনেক আশা নিয়ে বোরো ধানের আবাদ করেছিল কৃষক। কিন্তু বিক্রির সময় আসা মাত্র সে ধানই পরিণত হয়েছিল গলার ফাঁসে। মুখে লম্বা অনেক আশ্বাস দিলেও সরকার যথারীতি কোনো সাহায্য করেনি তাদের। তারও আগে কৃষককে খোলা বাজার থেকে অনেক বেশি দামে ভারতীয় সার ও বীজ কিনতে হয়েছিল। সেই সাথে ছিল বিদ্যুতের নিয়মিত লোডশেডিং। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু নয়, দিনের পর দিন চলেছে একই অবস্থা। ফলে পানির মেশিন চালানোর জন্য কৃষককে ডিজেল কিনতে হয়েছে। সেখানেও দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল বিক্রেতারা। ওদিকে প্রয়োজনের সময়ে ব্যাংক ঋণও পায়নি কৃষক। তাকে তাই আবারও সুদখোর গ্রামীণ মহাজন এবং এনজিওদের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল।

সবচেয়ে বড় বিপদে পড়েছিল কৃষক ধান বিক্রির সময়। কৃষকের যখন লাভজনক দামে ধান বিক্রি করা দরকার সরকার তখন ধীরেসুস্থে প্রতি মণ ধানের যে দাম নির্ধারণ করেছিল সে দামে বিক্রি করলে প্রতি মণ ধানে কৃষকের লাভ হতে পারতো বড়জোর ৮০ টাকা। বাস্তবে কিন্তু সেটাও হয়নি। কারণ, সরকার সময় নষ্ট করেছে ‘আজ কিনি, কাল কিনি’ করে। গুদাম সংকটের কথাও প্রচার করা হয়েছিল। অন্যদিকে কৃষকের পক্ষে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সরকারের ভরসায় না থেকে তাকে খোলা বাজারে ধান বিক্রি করতে হয়েছে। আর ঠিক এ পর্যায়ে এসেই সর্বাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষক। কথা আরো আছে। সরকারের ধান-চাল কেনার পদ্ধতিও কৃষকের স্বার্থে ভূমিকা রাখেনি। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনার কথা থাকলেও সরকার সুকৌশলে মধ্যবর্তী মিল মালিকদের মাধ্যমেই বেশি কেনার পদক্ষেপ নিয়েছিল। অর্থাৎ কৃষককে তার কষ্টের ফসল মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করতে হবে, সরকার কিনবে তাদের কাছ থেকে। এর ফলে ইচ্ছামতো দাম হাঁকানোর সুযোগ পেয়েছিল মিল মালিকরা। কৃষককে ঠকিয়েছেও তারা ইচ্ছামতো।
আপত্তি ও উদ্বেগের কারণ শুধু এটাই নয়। একই মিল মালিকরা আবার কিছুদিনের মধ্যে সরকারকেও জিম্মি বানিয়ে ফেলেছিল। সরকার তখন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য মিল মালিকদের কাছ থেকে বেশি দামে ধান-চাল কিনতে বাধ্য হয়েছে এবং এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। বাজারে চালের দাম বেড়েছে ক্রমাগত। সমগ্র এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বলতে হয়েছিল, কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি এবারের বোরো মৌসুমেও।

আজকের নিবন্ধ অবশ্য ধান বিষয়ক নয়, সবজি বিষয়ক। মাত্র দিন কয়েক আগে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বাজারে নানা ধরনের সবজির আমদানি বাড়লেও এই সবজি বিক্রি করে কৃষকদের যেমন লাভ হচ্ছে না তেমনি ক্রেতা তথা সাধারণ মানুষও উপকৃত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। লাভের মুখ দেখার পরিবর্তে একদিকে কৃষকরা লোকসান গুনতে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে তিন-চার গুণ বেশি দাম দিয়ে। কারণ, ফড়িয়া ও পাইকার নামের মধ্যস্বত্তভোগীরা কৃষকদের অনেক কম দামে সবজি বিক্রি করতে বাধ্য করছে। ফলে লোকসানই কেবল গুনতে হচ্ছে না, অনেক সবজির এমনকি উৎপাদন খরচও ওঠাতে পারছে না কৃষকরা। কিন্তু বাজারে যেহেতু একই সবজি বেশি পরিমাণে আসছে এবং চাষীদের মধ্যেও যেহেতু বিক্রির জন্য প্রতিযোগিতা রয়েছে সে কারণে পাইকাররা নিজেদের ইচ্ছামতো দাম বলে বিদায় করছে কৃষকদের। পাছে বিক্রি না হয় এই ভয়ে কৃষকরাও ফড়িয়া ও পাইকারদের হাঁকানো দামে সবজি বিক্রি না করে পারছে না।
খবরে জানানো হয়েছে, বগুড়ার মহাস্থান হাটে কৃষকরা ছোট আকারের যে ফুলকপি চার টাকা দরে বিক্রি করেছে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সে ফুলকপিরই দাম নেয়া হচ্ছে ১৫ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। ১০ টাকার একটি বাঁধা কপি মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকায়। একইভাবে ১৭ টাকার বেগুন রাজধানীবাসীকে ৪০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ১৫ টাকার এক কেজি বরবটি বিক্রি করা হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে। পাঁচ টাকা কেজি দরে কেনা মুলা বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে আর ১৫ টাকা দরের শসা ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে। শিম, জলপাই ও ধনে পাতাসহ অন্য সব সবজির দরও আকাশচুম্বি।

এ শুধু কারওয়ান বাজারের দর নয়, রাজধানীর অন্য সব বাজারেও একই রকম উচ্চ হারে সবজি বিক্রি করা হচ্ছে। একই অবস্থা চলছে দেশের সকল জেলা শহরের বাজারগুলোতেও। কোথাও কোনো বাজারেই শীতের সবজি কম দামে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সবজির আমদানি হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণে। তাছাড়া এবার সারাদেশেই সবজির চাষাবাদ অনেক ভালো হয়েছে এবং সে কারণে এর দামও কমে যাওয়ার কথা। এমন অবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদসহ বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মূল কারণ আসলে ফড়িয়া ও পাইকার এবং ব্যবসায়ী নামের মধ্যস্বত্বভোগীরা। এমন দামই তারা হাঁকিয়ে থাকে কৃষকদের জন্য যা মোটেও লাভজনক নয়। কিন্তু যেহেতু নিজের সব সবজি বাজারে এনে ফেলেছে সেহেতু কৃষকরা দরকষাকষি করার সাহস পায় না। ফড়িয়া ও পাইকার তথা দালালদের হাঁকানো দামেই বিক্রি করতে রাজি হয়ে যায়। অন্য একটি বিশেষ কারণও রয়েছে। কৃষকরা যখন সবজি নিয়ে বাজারে আসে তখন তাদের স্ত্রী-পুত্র কন্য ও পরিবার সদস্যরা অনেক আশায় বাড়িতে অপেক্ষা করে। কারণ, সবজি বিক্রি মানেই টাকা পাওয়া, যা দিয়ে সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস কেনা সম্ভব। প্রত্যেকেরই চাল ডাল তেল মরিচ থেকে লবণ ও সাবান পর্যন্ত অসংখ্য জিনিসের চাহিদা থাকে। সে কারণে খালি হাতে ফিরে যাওয়ার চাইতে যে দাম পাওয়া যায় তা নিয়েই কৃষকরা বাড়িতে যায়।
এভাবে শুধু কৃষককে নয়, ক্রেতা তথা সাধারণ মানুষকেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। তাই বলে এজন্য আবার পাইকার ও ফড়িয়াসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের দোষারোপ করার সুযোগ নেই। কারণ, তারা পরিবহন ব্যয় এবং পথে পথে চাঁদা দেয়ার কথা শুনিয়ে থাকে। এই চাঁদা শুধু গুন্ডা-সন্ত্রাসীদের নয়, পুলিশকেও দিতে হয়। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের এই অভিযোগ অস্বীকারও করা যায় না। কারণ, আসলেও সারাদেশে চাঁদাবাজি চলছে বাধাহীনভাবে। সে কারণেই মহাজন ও মধ্যস্বত্বভোগীরা চাঁদার জন্য দেয়া অর্থ হিসাবে ধরেই কোনো পণ্যের জন্য মোট বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারণ করে। দামও তারা ওই হিসাবের ভিত্তিতেই আদায় করে থাকে।

বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে। প্রসঙ্গক্রমে কৃষক ও কৃষিখাত সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। কারণ, তৈরি পোশাকসহ রফতানির মাধ্যমে আয় বাড়ানোর প্রচারণা চালানো হলেও কৃষিখাতই এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে এখনো এই খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। আর কৃষককে বাদ দিয়ে যেহেতু কৃষিখাতের কথা কল্পনা করা যায় না, সেহেতু কৃষকের সমস্যাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এখানে একটি কথা না বললেই নয়। দেশের বাজেটে সাধারণত কৃষিখাতকে শুধু নয়, গ্রামীণ অর্থনীতিকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে প্রচারণা চালানো হয়। সরকার অর্থনীতিকে ‘গ্রামমুখী’ করার ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে কৃষিখাত ও কৃষকের অবস্থা সব সময় একই রকম থেকে যায়। বর্তমান সরকারের আমলেও পরিস্থিতিতে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্যযোগ্য হয়নি। সেচ থেকে সার পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃষকরা বঞ্চিত হয় চরমভাবে। কখনো চাল বা শাক-সব্জির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মনে হতে পারে যেন কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। অন্যদিকে সত্য হলো, লাভবান হওয়া দূরে থাকুক, অনেক পণ্য বিক্রি করে কৃষকরা এমনকি খরচের অর্থও ওঠাতে পারে না। ফসল কাটার, ঘরে ওঠানোর এবং বিক্রি করার কোনো একটি ক্ষেত্রেই কৃষক নিজের ইচ্ছামতো কিছু করতে পারে না। লাভবান হওয়ারও সুযোগ পায় না। মহাজন ও এনজিওদের কাছ থেকে নেয়া ঋণের অর্থ ফেরৎ দেয়ার চাপ এত প্রত্যক্ষ ও প্রচন্ড থাকে যে, খুব কম সংখ্যক কৃষকের পক্ষেই কষ্টের ফসল বাড়ি পর্যন্ত নেয়া সম্ভব হয়। পরিবর্তে তাদেরকে ক্ষেত থেকে ফসল বিক্রি করে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হয়। না হলে তার ওপর নির্যাতন নেমে আসে।
বিক্রি করার প্রক্রিয়ায়ও পদে পদে রয়েছে প্রতিবন্ধকতা। সরকারের পক্ষ থেকে ক্রয়মূল্য বেঁধে দিয়ে আকর্ষণীয় অনেক প্রচারণা চালানো হলেও বাস্তবে কৃষকরা তার সুফল পেতে পারে না। সরকারি ক্রয়কেন্দ্র বা খাদ্য গুদামে যাওয়ার পথে ওঁৎ পেতে থাকে মিল মালিক, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের দালালরা। তারা প্রলোভন ও ভয়-ভীতি দেখায়, কৃষকরা যাতে তাদের কাছে ফসল বিক্রি করে। বেশি অর্থ পাওয়ার আশায় কৃষকদের অনেকে কষ্টে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র পর্যন্ত ফসল নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে নিয়োজিত কর্মচারীরা আগেই মিল মালিক, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে বসে থাকে। কখনো ‘সরকারের টাকা আসেনি’ বলে, কখনো আবার ‘গুদামে জায়গা নেই’ বলে ঘুষখোর কর্মচারীরা কৃষকদের বিদায় করে। সারাদিন বসিয়ে রেখে বিদায়ও করে এমন এক সময়, যাতে সঙ্গে আনা ফসল নিয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার মতো সময়-সুযোগ কৃষকরা না পায় এবং যাতে মহাজন-ব্যবসায়ীর দালালদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কৃষকদেরও তখন উপায় থাকে না- বাড়িতে অনেক আশায় বসে আছে স্ত্রী-সন্তানেরা, রয়েছে ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য মহাজন ও এনজিওদের মারমুখী লোকজন। সুতরাং খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে কৃষকরা দালালদের কাছে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
আর ঠিক এ পর্যায়েই ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় কৃষকদের। যেহেতু সরকারি গুদামে বিক্রি না করতে পেরে বিপদে পড়েছে, সেহেতু দালালদের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার না করে কোনো উপায় থাকে না তাদের। দালালরাও সুযোগ নেয় যথেচ্ছভাবেÑ সকালে যার দাম বলেছে সাতশ’ টাকা, সন্ধ্যায় তারই দাম বলে বসে চার-সাড়ে চারশ’ টাকা। কিন্তু তারপরও কৃষককে ওই দামেই দালালদের হাতে নিজের কষ্টের ফসল তুলে দিতে হয়। শাক-সবজি এবং অন্য সব কৃষি পণ্যের বেলাতেও একই অবস্থার শিকার হয় কৃষকরা। মানুষ সাধারণত যে দামে কৃষিপণ্য কেনে, তার খুব সামান্য পরিমাণই উৎপাদক কৃষকের হাতে পৌঁছায়। অর্থাৎ কৃষক যে দামে তার পণ্য বিক্রি করে বা করতে বাধ্য হয়, তার চাইতে অনেক বেশি দাম দিয়ে দেশের মানুষকে কিনতে হয়। কয়েক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীর বাধাহীন দৌরাত্ম্য এর কারণ। এদের মধ্যে রয়েছে মফস্বল বা জেলা পর্যায়ের পাইকার, রাজধানীর পাইকারী বাজারের আড়ৎদার, অবৈধ টোল আদায়কারী, দীর্ঘ পথের সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ এবং যথারীতি পুলিশ। এসব মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে উৎপাদন কেন্দ্র থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে গিয়ে প্রতিটি পণ্যের মূল্যই অনেক বেড়ে যায়, বহুগুণ বেশি অর্থ গুনতে হয় মানুষকে।

কৃষিঋণের মতো অন্য দু’-একটি বিষয়ও স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। সরকার সাধারণত কৃষিখাতে ঋণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েই দায়িত্ব পালন শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করে। কখনো খোঁজ নিয়ে দেখে না, বরাদ্দকৃত অর্থ কৃষকরা ঋণ হিসেবে পায় কি না, পেলেও পাওয়ার জন্য তাদের কি পরিমাণ ভোগান্তির শিকার হতে হয়। অন্যদিকে মাত্র এক হাজার টাকা ঋণ পেতেও একজন কৃষককে কম করে হলেও দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা শুধু ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ দিলেও প্রথম উপলক্ষেই কারো ভাগ্যে ঋণের অর্থ মেলে না, এজন্য কয়েকবার পর্যন্ত ব্যাংকে যাতায়াত করতে হয়। ফলে ব্যয় বেড়ে যায় কৃষকের। এভাবে ঘুষ ও যাতায়াতের ব্যয় যোগ করলে দেখা যায়, কাগজেপত্রে এক হাজার টাকা লেখা থাকলেও কৃষকের ভাগ্যে ছয়-সাতশ’ টাকার বেশি জোটে না। ওদিকে সুদ কিন্তু তাকে এক হাজারের হিসাবেই দিতে হয়। তাছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই কৃষকরা চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ে ঋণের অর্থ পেতে পারে। ওদিকে চাষাবাদের যেহেতু নির্ধারিত সময় বা মৌসুম থাকে, কৃষকরা সেহেতু সুদখোর গ্রামীণ মহাজন ও এনজিওদের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়। এদের কাছ থেকে পাওয়া ঋণের জন্য অনেক উচ্চ হারে সুদ গুনতে হয়। নির্যাতনের শিকারও হয় কৃষক।

কিন্তু সব জেনেও কোনো মৌসুমেই ‘জাতির মেরুদন্ড’ হিসেবে বর্ণিত কৃষকের স্বার্থে সামান্য পদক্ষেপ নেয় না সরকার। এজন্যই অভিযোগ ওঠে, ক্ষমতসীনদের সঙ্গে মিল মালিক, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে। একই কারণে কৃষকরা ধান ও পাটের পাশাপাশি সবজিও অনেক কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে জাতির জন্য কিন্তু উদ্বেগের বিশেষ কারণ রয়েছে। সে কারণ সম্পর্কে বুঝতে হলে বাংলাদেশের ‘সোনালী আঁশ’ পাটের পরিণতির কথা স্মরণ করতে হবে। মাত্র দশক তিনেক আগেও রফতানি আয়ের বড় অংশ আসতো পাট ও পাটজাত পণ্যের মাধ্যমে। বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল আদমজীসহ ৭৭টি পাটকলে নিয়মিত উৎপাদন হতো, লাখ লাখ মানুষ শ্রমিক হিসেবে চাকরি করতো। ওদিকে চাষাবাদ করে লাভবান হতো পাটচাষীরা। পরিস্থিতিতে অবনতি ঘটেছে স্বাধীনতার পর। ভারতের ষড়যন্ত্রে একের পর এক পাটের গুদামে আগুন লাগানো হয়েছে। ভারত থেকে আমদানি করা নিম্নমানের পাট বীজ ব্যবহার করায় বাংলাদেশের পাট তার গুণগত মান ও বৈশিষ্ট্য খুইয়েছে। এই অজুহাতে ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে পাটচাষীদের বঞ্চিত করেছে দালাল ও ফড়িয়ারা। ফলে পাটচাষীরা পাটের বদলে অন্য ফসলের চাষাবাদে ঝুঁকে পড়েছে। অক্রান্ত হয়েছে পাটকলগুলোও। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তথাকথিত সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রায়াত্তকরণের মাধ্যমে পাটকলগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের দুর্বৃত্তদের জন্য লুন্ঠনের ক্ষেত্র বানানো হয়েছিল। দুর্বৃত্তরা যন্ত্রপাতি পর্যন্ত বিক্রি করে খেয়েছে। ভারতের স্বার্থে একের পর এক পাটকল বন্ধ করা হয়েছেÑ ৭৭টির স্থলে পাটকলের সংখ্যা কমতে কমতে মাত্র ১৫-১৬টিতে এসে ঠেকেছে।

অথচ বাস্তব পরিস্থিতি যে মোটেও পাটের প্রতিক’লে নয় তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ভারতের দিকে লক্ষ্য করলে। বাংলাদেশে যখন পাটকল বন্ধ হয়েছে, পশ্চিম বঙ্গসহ বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তখন নতুন নতুন পাটকল স্থাপিত হয়েছে। এসব পাটকল টিকেও আছে বাংলাদেশের পাটের ওপর নির্ভর করে। প্রশ্ন হলো, ভারতে যদি পাটকলগুলো লাভজনকভাবে সম্প্রসারিত হতে পারে তাহলে পাটের মূলভূমি বাংলাদেশে কেন পাটকল বন্ধ করা হয়েছে? বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়া এবং ভারতের জন্য আন্তর্জাতিক পাটের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করাই ছিল অন্তরালের প্রমাণিত উদ্দেশ্য।

হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে কিন্তু পাটের এই করুণ পরিণতির তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকেই ধান পাট ও সবজির চাষকারী কৃষকদের স্বার্থে এখনই ব্যবস্থা নেয়া দরকার, কৃষকরা যাতে তাদের ফসলকে গলার ফাঁস মনে না করে। একই সঙ্গে দরকার চাষাবাদের ব্যাপারে তাদের উৎসাহিত করা। কৃষকরা যদি লাভবান না হতে পারে তাহলে তারা পাটের মতো ধান ও সবজির আবাদ থেকেও হাত গুটিয়ে নেবে। পাশাপাশি বাড়বে চোরাচালান। মহাজন ও ব্যবসায়ীরা তো বটেই, এমনকি কৃষকরাও ধান-চাল পাচার করবে ভারতে। করবে পেটের দায়ে। এই চোরাচালান প্রতিহত না করা গেলে খেসারত দিতে হবে জনগণকে। উল্লেখ্য, এরই মধ্যে সরকার ভারত থেকে ভারতের শর্তে চাল আমদানি করতে বাধ্য হয়েছে। এই আমদানির পরিমাণ কেবল বাড়তই থাকবে। অমন পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য হলেও কৃষককে ধান ও সবজিসহ সকল কৃষিপণ্যের জন্য লাভজনক মূল্য পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করার বিকল্প নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, একদিকে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকেও কৃষকের স্বার্থে আন্দোলন করতে দেখা যাচ্ছে না। তারা এমনকি কৃষকের স্বার্থে কোনো বিবৃতি পর্যন্ত দিচ্ছে না। ফলে ধান-পাট থেকে সবজি পর্যন্ত সবই কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে উঠতে শুরু করেছেÑ যাকে বলা হচ্ছে ‘সোনালী ফাঁস’!

 

http://www.dailysangram.com/post/309888