৩০ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৫

ফ্লাইওভারের নিচে অবৈধ টার্মিনাল

রাজধানীবাসীর বিড়ম্বনা-২

প্রতিদিনই যানজটের কবলে পড়ছেন নগরবাসী, প্রধান সড়ক দখল করে রেন্ট-এ-কার, ট্যাক্সি ক্যাব, পিকআপ ভ্যান এবং বাস-ট্রাকের পার্কিং, গড়ে তোলা হয়েছে গাড়ির গ্যারেজ : ৩০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফ্লাইওভারের ওপরে বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে ভাঙাচোরা, আস্তর উঠে সৃষ্টি হচ্ছে ছোট ছোট গর্ত

রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভারের উভয়পাশে প্রতিদিনই সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ফলে নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ। ওই ফ্লাইওভার পারাপার হওয়ার সময় ওপর উঠতে এবং নামতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কারণ ফ্লাইওভারকে ঘিরে আশেপাশে এবং নিচে গড়ে উঠেছে বাস-ট্রাক-মিনি ট্রাক প্রাইভেট কারের অঘোষিত টার্মিনাল। শুধু অবৈধ টার্মিনালই নয়, সরকারি জমি ও ব্যস্ততম এ সড়ক জুড়ে নির্মিত হয়েছে অবৈধ দোকানপাট, টিনের ঘরসহ নানা স্থাপনা। এছাড়া ফ্লাইওভারটি চালু হওয়ার এক বছর যেতে না যেতেই ওপরের বিভিন্ন অংশে দেখা দিয়েছে ভাঙাচোরা, আস্তর ও বিটুমিন পাথর ও আস্তর উঠে গেছে। সেখানে ছোট ছোট গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। রাজউকের এ প্রকল্পটি ৩০৬ কোটি টাকার। এত টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভারটি নির্মাণের এক বছরের মধ্যে এ ধরনের ভাঙাচোরা দেখা দেয়াতে নির্মাণ কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ফ্লাইওভারের নিচে অবৈধ স্ট্যান্ড ও টার্মিনালকে ঘিরে ছোট-বড় ২০টি গ্যারেজ-ওয়ার্কশপ গড়ে উঠেছে। ফ্লাইওভারের নিচে ব্যস্ততম রাস্তাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে মিনিবাস, রেন্ট-এ-কার ও ট্রাক টার্মিনাল। রাস্তার ওপরেই গাড়ি ধোয়া-মোছা ও মেরামতের কাজ করার গ্যারেজ রয়েছে। পূর্বপাশের গোটা রাস্তা দখল করেই গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ প্রাইভেট কার টার্মিনাল। বৈধ কাগজপত্রহীন, ফিটনেস ও রুট পারমিটবিহীন প্রায় দেড় শতাধিক প্রাইভেট কারের পার্কিংও রয়েছে। এসব প্রাইভেট কার ভাড়ায় চালানো হয়। এগুলোর মাধ্যমে নানাভাবে চলছে যাত্রী হয়রানি।

ফ্লাইওভারটির সৌন্দর্য নষ্ট করে ‘কার টার্মিনাল’ গড়ে তোলা হয়েছে। নষ্ট হচ্ছে ফ্লাইওভারটির স্বাভাবিক সৌন্দর্যও। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সামনেই চলছে দখলের মহোৎসব। দেখেও যেন না দেখার ভান করছে রাজউক কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. আবদুর রহমান বলেন, আমরা খুব দ্রæত উচ্ছেদ অভিযান চালাবো। সকল অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়া হবে। পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ জন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
রাজউকের চেয়ারম্যান আরো বলেন, ফ্লাইওভারের নীচে অপরাধীদের আড্ডা, অবৈধ পার্কিং এসব দেখার দায়িত্ব পুলিশ বা সিটি করপোরেশনও এড়াতে পারে না।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাস্তার ওপরেই চলছে গাড়ি ধোয়া-মোছা ও মেরামতের কাজ। পূর্বপাশের গোটা রাস্তা দখল করেই গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ প্রাইভেট কার টার্মিনাল।
দেখা গেছে, ৩০০ ফুট রাস্তা যেখানে এসে মিশেছে, সেখান থেকেই এসব পার্কিং শুরু হয়েছে। ছোট ছোট ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে সেখানে শত শত চালক দাঁড়িয়ে আছেন। এখান থেকে গাউছিয়া ও কাঞ্চন যায় সাধারণ মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, ফ্লাইওভারটি নির্মাণ শেষে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের মানুষ বিকেলে দল বেঁধে কুড়িল এলাকায় আসতেন ঘুরে বেড়াতে। কিন্ত এখন আর সেই পরিবেশ নেই। সন্ধ্যার পর থেকেই ফ্লাইওভার নীচে অপরাধীরা ভিড় জমায়। শুধু তাই নয়, অবৈধ পার্কিং ও অঘোষিত ট্রাক টার্মিনালের কারণে স্বাচ্ছন্দ্যে যানবাহনও চলাচল করতে পারে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় তিন শতাধিক অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সেখানে সন্ধ্যা হতেই বখাটে, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্যে ওই এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। স্থানীযরা এ জন্য আইন শৃংখলা বাহিনীকে দায়ী করছেন। এছাড়া রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও রয়েছে উদাসীনতা। তাদের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ফ্লাইওভারে নীচে দখলদাররা বিভিন্ন স্থাপনা তৈরী করে রমরমা বাণিজ্য করে যাচ্ছে। ফ্লাইওভারের নীচের ডোবাতে অবাধে ফেলা হচ্ছে ময়লা আবর্জনা। ফলে ওই স্থানটি অতিক্রমকালে দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পেতে গাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকে না। লোকজন নাকে-মুখে রুমাল চেপে অতিকষ্টে জায়গাটি পার হন।

ওই এলাকার ব্যবসায়ী সাব্বির আহমেদ জানান, শুধু ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধই নয়, নানা সমস্যায় বেহাল অবস্থায় কুড়িল ফ্লাইওভার এলাকা। রাতের বেলা প্রায়ই পর্যাপ্ত আলো না থাকায় নানা অপকর্ম সঙ্ঘটিত হয়। গত বছরের ২৫ অক্টোবর কুড়িল বিশ্বরোডে ছিনতাইকারীরা গাড়িচাপা দিয়ে অনন্ত বিশ্বাস নামে এক রিকশাচালককে হত্যা করে।
কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে কাঞ্চনের পথে ১৭০টি ছোট গাড়ি চলে। ভাড়া নেওয়া হয় ৬০ টাকা। এসব গাড়ির চালক প্রতিদিন ১০০ টাকা ‘লাইন’ বাবদ চাঁদা দেন। মাসে এককালীন চাঁদা হিসেবে দিতে হয় আরো এক হাজার ৩০০ টাকা। সে হিসেবে কাঞ্চনগামী গাড়ি থেকে প্রতিদিন ১০০ টাকা আদায় হয়।
একজন গাড়িচালক বললেন, আমরা চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালাই। পুলিশ, প্রশাসনসহ স্থানীয় নেতারা এই টাকা নেন। তবে কে কত পান তা জানি না।

কথা হয় গাউছিয়াগামী গাড়িগুলোর লাইনম্যান কাম ব্যবস্থাপক বাচ্চু হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের এখান থেকে ১৫০টি গাড়ি চলে। গাড়ি থেকে খরচবাবদ প্রতিদিন ১৫০ টাকা আদায় করা হয়। আর মাসে এক হাজার টাকা। কাঞ্চনে চলাচলকারী গাড়ির লাইনম্যান রাকিব হাসানও স্বীকার করেছেন চাঁদা আদায়ের কথা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় রাজউকের প্রকল্প অফিসের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, দখলের কারণে ফ্লাইওভারটির সৌদর্য নষ্ট হচ্ছে। নিচের কাজ করা হয়েছিল। কিন্তু ওই ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা সেগুলো আস্তে আস্তে ভেঙে ফেলেছে। ট্রাফিক পুলিশ এবং থানা পুলিশ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে অবৈধ পার্র্কিং স্থাপন করা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে ট্রাফিক পুলিশ বলছে, সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব কাজে জড়িত রয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক পরিচয়ে কিছু ব্যক্তি দোকানপাট ও অঘোষিত টার্র্মিনাল তৈরি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর দায়িত্ব রাজউক ও সিটি করপোরেশনের।

https://www.dailyinqilab.com/article/106581