৩০ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫০

পরিকল্পনার বৃত্তে ঢাকার বৃত্তাকার যোগাযোগ

নগরীর অভ্যন্তরীণ যানজট নিরসনে রাজধানীকে ঘিরে বৃত্তাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ প্রায় তিন দশক আগের, কিন্তু সেটা এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে পরিকল্পনার বৃত্তেই। ঢাকার চারপাশে ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের আউটার সার্কুলার রুট (বৃত্তাকার সড়ক) নির্মাণের পরিকল্পনার অগ্রগতি চলমান সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় আটকে রয়েছে। একই পথে প্রায় ৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ সমীক্ষার পর্যায়েও পৌঁছতে পারেনি এখনও।

ঢাকার যানজট নিরসনে গত বছর মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত মহাপরিকল্পনা 'সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি)' ঢাকাকে ঘিরে তিনটি বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে। ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা-বহির্ভূত ফ্লাইওভার প্রকল্প পালে হাওয়া পেলেও সার্কুলার

রুট পরিকল্পনার মধ্যেই আটকে রয়েছে। যদিও গণপরিহন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, যানজট নিরসনে খুবই কার্যকর হবে সার্কুলার রুট। শহরের ভেতরে প্রবেশ না করেই যান চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামছুল হক সমকালকে বলেছেন, 'বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা আরএসটিপিতেই রয়েছে। কিন্তু তা না করে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভার বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করা হচ্ছে, যা গণপরিবহনবান্ধব নয়। উল্টো যানজটের কারণ প্রাইভেটকারকে উৎসাহিত করছে। ফ্লাইওভার বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর সার্কুলার রুট।'

আশির দশকে নগরীর পশ্চিম প্রান্তে হাজারীবাগ থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। পূর্ব প্রান্তে ষাটের দশকে নির্মিত ঢাকা-নারায়াণগঞ্জ ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধ। এই দুই বাঁধের নির্মিত সড়কে যান চলাচল করছে। সোয়াশ' বছর আগে পুরান ঢাকাকে রক্ষায় বুড়িগঙ্গার তীরে নির্মিত হয় বাকল্যান্ড বাঁধ। তেরমুখ থেকে আবদুল্লাহপুর অংশে একলেনের এবং আবদুল্লাহপুর থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধের অংশে দুই লেনের সড়ক রয়েছে।

এই তিন বাঁধের মাঝে তেরমুখ থেকে ডেমরা পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার 'ইস্টার্ন বাইপাস' বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদিত হয় ১৯৯৯ সালে। প্রকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯৮৯ সালে। ২৮ বছরে এ প্রকল্প পরিকল্পনাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এই ২৪ কিলোমিটার বাঁধ নির্মিত হলে পুরো ঢাকা শহরের চারপাশে বাঁধ গড়ে উঠবে। বাঁধের ওপরে চার লেনের সার্কুলার রুট নির্মাণের পরিকল্পনাও তিন যুগ আগের। ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।

কিন্তু অগ্রগতি সামান্য। গত ১ নভেম্বর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সমন্বয় সভায় জানানো হয়, 'প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে। স্টাডি দ্রুত সম্পন্ন করে প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হবে।' সড়ক পরিবহন সচিব নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভা থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে (ঢাকা জোন) এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত দুই বছর ধরে প্রতিটি সমন্বয় সভা থেকে একই নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সমীক্ষার কাজ এগোচ্ছে না। এ বিষয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর জানান, ফিজিবিলিটি স্টাডির (সমীক্ষা যাচাই) কাজ চলছে। কবে নাগাদ শেষ হবে, তা তিনি নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।

সার্কুলার রুটের পথ হবে গাবতলী-রায়েরবাজার-বাবুবাজার-সদরঘাট-শ্যামপুর-কদমতলী-ফতুল্লা-চাষাঢ়া-সাইনবোর্ড-শিমরাইল-ডেমরা-তেরমুখ-আবদুলল্গাহপুর-ধউর-বিরুলিয়া। এর মধ্যে তেরমুখ থেকে ডেমরা পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার ইস্টার্ন বাইপাস নির্মাণ করা হলে পূর্ণ হবে ঢাকাকে ঘিরে বৃত্তাকার পথ।

ইস্টার্ন বাইপাস নির্মাণ করবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। গাবতলী থেকে রায়েরবাজার, বাবুবাজার, সদরঘাট, শ্যামপুর, কদমতলী, ফতুল্লা, চাষাঢ়া, সাইনবোর্ড, শিমরাইল, ডেমরা, তেরমুখ, আবদুলল্গাহপুর, ধউর, বিরুলিয়া হয়ে গাবতলী পর্যন্ত ৬৭ কিলোমিটার চার লেনের সড়ক নির্মাণ করবে সওজ। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিনা বাধায় যান চলাচলে সার্কুলার রুটের ইন্টারসেকশনে ওভারপাস ও আন্ডারপাস থাকবে। এ সড়কে যানবাহন সিগন্যালে পড়বে না। বৃত্তাকার পথে বিনা বাধায় চলবে। সড়কের মাঝখানে পাঁচ মিটার প্রশস্ত মিডিয়ান থাকবে। দুই পাশে ধীরগতির যান চলাচলে পৃথক লেন থাকবে।

গত বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রকল্পের প্রেজেন্টেশন তুলে ধরা হয়। তখন জানানো হয়েছিল, ছয় মাসের মধ্যে প্রকল্পের ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। কিন্তু দেড় বছরেও সমীক্ষা যাচাই শেষ হয়নি। সমীক্ষা শেষ না হওয়ায় প্রকল্প ব্যয়ও নির্ধারণ করা যায়নি। এখনও অর্থায়নের বিষয়টিও নিশ্চিত নয়। ৬৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে সড়ক বিভাগ। অবকাঠামোসহ ভূমির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।

সার্কুলার রুটের প্রথম ফেজে ২৪ কিলোমিটার ইস্টার্ন বাইপাস সড়ক নির্মাণ প্রকল্পও আটকে রয়েছে পরিকল্পনায়। এ প্রকল্পে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জানান, প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পে সড়ক বিভাগ, ওয়াসা, রাজউকও যুক্ত রয়েছে। সম্পৃক্ত সংস্থা সমন্বিতভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।

বৃত্তাকার রেলরুটও পরিকল্পনায় ঘুরপাক করছে। প্রকল্পটি আরএসটিপিভুক্ত নয়। তবে ঢাকাকে ঘিরে বৃত্তাকার সড়ক ও নৌরুটের পাশাপাশি রেলপথ নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের গত মাসে মগবাজার ফ্লাইওভারের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এ কথা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তবে রেল মন্ত্রণালয় বৃত্তাকার এলিভেট রেলরুটের (উড়াল রেলপথ) পরিকল্পনা করেছে আরও আগে থেকেই। রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক জানিয়েছেন, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হবে শিগগির। এর পরই অর্থায়নের বিষয়টি নিয়ে এগোবে রেল মন্ত্রণালয়।

প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৫ সালের ৮ জুন চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশনের (সিসিইসিসি) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্পের প্রাক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছে। তবে একে গ্রহণযোগ্য মনে করছে না রেল মন্ত্রণালয়। সরকারি অর্থায়নে সমীক্ষার প্রস্তাব দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।

আরএসটিপিতে বৃত্তাকার রেল রুটের পরিকল্পনা না থাকায় প্রকল্পটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তদারকি সংস্থা ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। আরএসটিপিতে মেট্রোরেল, বাস র্যা পিড ট্রানজিট, বৃত্তাকার সড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। বৃত্তাকার উড়াল রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নেই। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সমন্বয়ের শর্ত দিয়েছে ডিটিসিএ। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আহমদ জানিয়েছেন, বৃত্তাকার সড়ক ও ইস্টার্ন বাইপাস প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় করে সমীক্ষা যাচাই করতে রেলকে বলা হয়েছে।

২০টি স্টেশনসহ ৮১ দশমিক ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ বৃত্তাকার উড়াল পথ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ২৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। সংসদে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সার্কুলার রেল টঙ্গী, তেরমুখ, পূর্বাচল রোড, বেরাইদ, কাউয়েতপাড়া, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ, চৌধুরীবাড়ি, চাষাঢ়া, ফতুল্লা, শ্যামপুর, সদরঘাট, বাবুবাজার, নওয়াবগঞ্জ, শংকর, গাবতলী, ঢাকা চিড়িয়াখানা, বিরুলিয়া, উত্তরা হয়ে ধউর পর্যন্ত যাবে। প্রায় চার কিলোমিটার দূরত্বে স্টেশন থাকবে। রেল ডিপো ডেমরায় এবং স্টোরেজ ইয়ার্ড নির্মাণ করা হবে বিরুলিয়ায়।

http://samakal.com/capital/article/17111915