২৯ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৪৮

আবার কেন নতুন ব্যাংক

আরও তিনটি নতুন ব্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত অনাকাঙ্ক্ষিত। তারা প্রশ্ন করেছেন, সর্বশেষ অনুমোদন দেওয়া নয়টির মধ্যে একাধিক ব্যাংকের অবস্থা যখন করুণ, তখন সরকার আবার কেন নতুন ব্যাংক দিতে চাইছে, তা বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার তাতে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকও অর্থ মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছে, নতুন কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক স্থাপন বাস্তবসম্মত হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তির পরও গত মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনটি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হবে। যদিও আইন অনুযায়ী ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের। এর আগে ২০১৩ সালে সরকারের ইচ্ছার কারণে নতুন নয়টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্তকে এককথায় অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। সমকালকে তিনি বলেন, এমনিতেই এখন ব্যাংক খাতের অবস্থা সুবিধার নয়। চার বছর আগে নতুন যে নয়টি ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে, তার মধ্যে তিনটির অবস্থা খারাপ। বাংলাদেশ ব্যাংকও নতুন ব্যাংক দিতে চাইছে না। এরপরও সরকার যদি বাংলাদেশ ব্যাংককে এ কাজে বাধ্য করে তাহলে তা হবে খুবই দুঃখজনক। বাংলাদেশে এখন ৫৭টি ব্যাংক আছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মনে করেন সোনালী ব্যাংক এবং শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক

সংস্থা বিএসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সর্বশেষ গত বছরের ২১ জুলাই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মালিকানায় সীমান্ত ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশে এখন তফসিলি ব্যাংকের (ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সপ্রাপ্ত) সংখ্যা ৫৮টি। এর বাইরে আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংকসহ ছয়টি ব্যাংক রয়েছে, যেগুলো তফসিলি নয়। এসব ব্যাংক বিশেষ উদ্দেশ্যে আলাদা আইনের মাধ্যমে গঠিত। এ ছাড়া দেশে ৩৩টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানও জনসাধারণের কাছ থেকে আমানত নেয় এবং ঋণ বিতরণ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদও মনে করেন, কোনো অবস্থাতেই আর নতুন ব্যাংকের দরকার নেই। তিনি সমকালকে বলেন, এর আগে অনুমোদন দেওয়া নয়টি ব্যাংকের অবস্থা বিশ্নেষণ করলে নতুন ব্যাংক দেওয়ার পক্ষে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের অবস্থা করুণ। আরও দুটি ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। এ ছাড়া সার্বিকভাবে ব্যাংক খাত এখন খারাপ অবস্থায়। আরও নতুন ব্যাংক এলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী তসলিম সমকালকে বলেন, তিনি নতুন আর কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন দেখেন না। এখনও সবাই ব্যাংকিংয়ের আওতায় আসেনি- নতুন ব্যাংক দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর এ যুক্তি যথার্থ নয়। বিদ্যমান ব্যাংকগুলোই আরও বেশি লোককে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে পারে। নতুন ব্যাংক দেওয়া হলে সর্বশেষ অনুমোদন দেওয়া নয়টি ব্যাংকের ব্যবসা কমে যাবে এবং ব্যাংক খাত আরও ঝামেলায় পড়বে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই পরিচালক।

বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলেছে : অর্থমন্ত্রীর দপ্তর থেকে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলা ব্যাংক এবং পিপলস ইসলামী ব্যাংক নামে দুটি নতুন ব্যাংক স্থাপনের বিষয়ে লিখিতভাবে সরকারের আগ্রহের কথা জানানো হয়। গত ৬ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রীর নজরে আনার অনুরোধ করে মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক তার অবস্থানপত্র পাঠায়। এতে পরিসংখ্যান ও যুক্তি উপস্থাপন করে সবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বেসরকারি উদ্যোগে নতুন কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক স্থাপন বাস্তবসম্মত হবে না।

অর্থমন্ত্রী অবশ্য গত সোমবার তিনটি ব্যাংকের কথা বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বাংলা ব্যাংক ও পিপলস ইসলামী ব্যাংক ছাড়া পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি ব্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। পিপলস ইসলামী ব্যাংকের নেতৃত্বে আছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা এম এ কাশেম। বেঙ্গল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে রয়েছেন আওয়ামী লীগের এমপি ও বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম।

বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো অবস্থানপত্রে জানায়, নতুন নয়টি ব্যাংক দেওয়ার পর ২০১৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্ষদ সভায় দেশের চলমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আর কোনো অনিবাসী বা বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক স্থাপনের সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত হবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ার যে বাংলাদেশ ব্যাংকের, তাও এ পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

নতুন ব্যাংক না দেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্য আর্থিক সূচক পর্যালোচনা করেছে। এ বিষয়ে অবস্থানপত্রে বলেছে, ব্যাংকগুলোর মোট সম্পদ, ঋণ ও আমানতের পরিমাণ বাড়লেও এগুলো বৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে কমছে। মূলধন পর্যাপ্ততার হার, সম্পদের বিপরীতে মুনাফার হার এবং ইক্যুইটির বিপরীতে মুনাফার হারও নিম্নমুখী। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের হারও বেড়েছে। মোট কথা, ব্যাংক খাতের সম্পদের প্রকৃত গুণগত মান সন্তোষজনক নয়। সর্বশেষ অনুমোদন দেওয়া নয়টি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।

যেভাবে ৫৮ ব্যাংক : আশির দশকের শুরুতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়। এরশাদ সরকারের সময়ে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে নয়টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে আটটি ব্যাংক অনুমোদন পায়। তৃতীয় পর্যায়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সময়কালে ১৩টি বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। ২০০৫ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ২৭২তম সভায় বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংক স্থাপন-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা উপস্থাপন করা হলে পর্ষদ তা অনুমোদন করে। তবে তার অর্থ এই ছিল না যে, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। বরং দেশের অর্থনীতি ও অর্থবাজারের আকার, সঞ্চয় সৃষ্টি ও মূলধন গঠনের হার, আর্থিক খাতের গভীরতা, বিদ্যমান ব্যাংকিং অবকাঠামো ও ব্যাংকিং সেবার চাহিদা এবং ব্যাংকগুলোর প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান প্রভৃতি বিবেচনায় নতুন কোনো ব্যাংক স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ যুক্তিসঙ্গত হবে না মর্মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ ওই সময় মতামত দেয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে প্রবাসীদের মালিকানায় তিনটিসহ নয়টি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয় সরকার। লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ার থাকলেও বিভিন্ন সরকারের আমলে এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে।

 

http://samakal.com/economics/article/17111845