২৯ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৪৪

খলনায়করা অধরা

১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক কেলেঙ্কারি

অভিযুক্তদের ধরতে না পারা স্বেচ্ছা গাফিলতি -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অপরাধীর শাস্তি হওয়া উচিত -ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ : লুটেরারা উচ্চ পর্যায়ের হলেই এড়িয়ে যায় দুদক -ড. ইফতেখারুজ্জামান
ব্যাংক হলো টাকা পয়সার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কিন্তু ব্যাংকের টাকা লুট যেন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। দেশের ব্যাংকগুলোতে গত কয়েক বছরে পনের হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। অসংখ্য মামলাও হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাও চিহ্নিত। অথচ বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার হয়নি; লুটেরারা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। উদ্ধার হয়নি টাকা। হবে কিনা তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ। এমনকি ব্যাংকের অর্থ লুটের হোতাদের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যও নেই ব্যাংকগুলোর কাছে। ব্যাংকগুলোতে ঘটে যাওয়া এসব লুটপাটে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পরিচালনা পরিষদ এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকলেও তারা স্বপদে বহাল রয়েছেন। শুধু বহালই নয়; ব্যাংক কোম্পানি আইনের পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের পদকে আরও পাকাপোক্ত করেছেন। এমনকি ব্যাংক লুটের সাথে জড়িতদের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যও নেই ব্যাংকগুলোর কাছে। অন্যদিকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতি ও হয়রাণি করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ যেন ‘মরার ওপর খড়ার ঘা’ প্রবাদের মতো।
এদিকে ব্যাংকে একই পরিবারের চারজনকে পরিচালক নিয়োগ এবং একটানা নয় বছর পরিচালক পদে থাকার বিধান যুক্ত করে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের প্রস্তাব উঠেছে জাতীয় সংসদে। যা আগে ছিল ২ জন এবং ৬ বছর। ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, এ আইন হলে বেসরকারি ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েমের সুযোগ তৈরি হবে। মূলত প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সুযোগ দিতেই ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হচ্ছে। আর্থিক কেলেঙ্কারীর এ ঘটনায় জড়িত লুটেরাদের টিকিটিও স্পর্শ করছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দুরের কথা, তাদেরকে কখনো সন্দেহের তালিকায়ই রাখছে না। অথচ প্রতিদিনই হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন কোন কোন ব্যাংক কর্মকর্তা। এমনকি চাকরি হারানোর ভয়ে কোন ঋণ পাস করার ব্যাপারেও উৎসাহী হচ্ছেন না তারা।

টেরি টাওয়েলস রপ্তানির ভুয়া তথ্যে সরকারি-বেসরকারি পাঁচটি ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বিসমিল্লাহ গ্রুপের কর্ণধাররা। ২০১১ ও ২০১২ সালে সংঘটিত এ কেলেঙ্কারি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে ধরা পড়ে ২০১৩ সালে। তার আগেই নিরুদ্দেশ হন বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী ও চেয়ারম্যান নওরীন হাসিব। এর পর থেকেই তাদের ব্যাপারে কোনো খোঁজ নেই ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকগুলোর কাছে। বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে তাদের অসহায়ত্বের কথা। তারা জানান, দেশ ছাড়ার পর আজ পর্যন্ত ব্যাংকের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি বিসমিল্লাহ গ্রুপসংশ্লিষ্টরা। এমনকি বিসমিল্লাহ গ্রুপের কর্ণধাররা কোথায় আছেন, সে ব্যাপারে তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। যদিও একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছে, ব্যাংক থেকে আত্মসাৎ করা অর্থে গ্রুপের কর্ণধাররা দুবাইয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছেন বলে শোনা যায়। দুবাইয়ে হোটেল ব্যবসা চালুর তথ্যও আছে তাদের কাছে। মাঝেমধ্যে শোনা যায় যুক্তরাষ্ট্রে নির্বিঘেœ বসবাসের কথাও।
বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ কেলেঙ্কারীর ঘটনায় ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদসহ রাঘব বোয়ালরা জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব না হলেও ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। এমনকি ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর বিসমিল্লাহ গ্রুপের এমডি ও চেয়ারম্যানসহ ৫৪ জনকে আসামি করে ১২টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আসামিদের মধ্যে ৪১ জন বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা। মামলা দায়েরের আগে তদন্ত চলাকালেই গ্রুপের ১১টি প্রতিষ্ঠান সুকৌশলে মালিকানা হস্তান্তরের কাজটি সম্পন্ন করে। পরে ওই টাকা বিদেশে পাচার করে নিজেরাও পালিয়েছেন দেশ থেকে। অথচ বিষয়টি নিয়ে এখন আর কোনো আলোচনা নেই বললেই চলে।
বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংকে ব্যাপক ধরপাকর শুরু হয়। আটক করা হয় অফিসার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ডিএমডি পদমর্যাদার লোকদের। অথচ যেসব সচিব, চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের নির্দেশে ব্যাংকাররা অনিয়মে সহায়তা করেছেন তাদেরকে সন্দেহের তালিকায় পর্যন্ত রাখা হয়নি। আটক করা হয়নি ব্যাংকের সর্বোচ্চ দাপ্তরিক ক্ষমতার অধিকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের। দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংক লুটের হোতাদের সবসময়েই আড়াল করার চেষ্টা চলে এসেছে। আর তাদের দিকে যাতে কারো মনোযোগ না থাকে সেজন্য নিচের সারির কর্মকর্তাদের একের পর এক আটক করা হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংক লুটের ঘটনার গভীরে না যাওয়ায় দুদকের অভিযানকে ‘আইওয়াশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকরা।
“উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও মূল ইস্যু এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায় দুদকের মধ্যে”- এমন বক্তব্য টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীদের প্রতি নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে। তাদের সুরক্ষা দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে।

“পরিচালনা পরিষদ ও এমডির সহায়তা ছাড়া এত বড় বড় অনিয়ম সম্ভব নয়। তাঁদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি। তাঁরা আটক না হওয়াটা একধরনের দুর্বলতা।” “মূল হোতাদের বিচারের আওতায় আনা না গেলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে পারে”- সতর্ক করে দেন দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের প্রধান। এদিকে ব্যাংক লুটের ঘটনায় সোনালী, অগ্রণী ও বেসিক ব্যাংকের সাবেক তিন এমডি দুদকের মামলার আসামি হলেও এত বছরেও তাদেরকে আটক করতে পারেনি সংস্থাটি।
“মামলার পর এমডিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় দুর্নীতির সহায়ক পরিবেশ আরও বাড়বে” উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “তাঁরা দেশের বাইরে থাকলে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নিতে হবে। তাদের দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।”

মামলায় নাম থাকার পরও সাবেক এমডিদের খুঁজে না পাওয়াকে সংস্থার ‘স্বেচ্ছা গাফলতি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, “তাদের খুঁজে বের করা কঠিন কাজ নয়। তাদের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা আছে, স্থাবর সম্পদ আছে। তাদের খুঁজে না পাওয়ার কোন যৌক্তিক কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না।” “ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সব অপরাধীর শাস্তি হওয়া উচিত” উল্লেখ করেছেন সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
এদিকে তিন এমডি’র বিরুদ্ধে ‘লোকদেখানো’ মামলা হলেও সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের বোর্ডের কোন সদস্যের বিরুদ্ধে একটিও মামলা হয়নি। সন্দেহের তালিকায়ই আনা হয়নি অর্থমন্ত্রণালয়ের এমন কোন কর্মকর্তাকে যাদের হাতে থাকে এমডিদের চাকরি- যারা চাইলেই এমডিদের বাধ্য করতে পারেন যেকোন কাজ করাতে- মেয়াদ বাড়ানোর লোভে যাদের নির্দেশ মেনে চলতে দেখা যায় রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের এমডিদের। অথচ যেকোন তদন্তে সম্ভাব্য সব দিক নিয়েই অনুসন্ধান করা একটি সতসিদ্ধ নিয়ম।

সোনালী ব্যাংকে যখন আড়াই হাজার কোটি টাকার হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে তখন এমডি ছিলেন হুমায়ুন কবির। অর্থমন্ত্রণালয় ২০১০ সালের ২০ মে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয় তাকে। তার মেয়াদ শেষ হয় ২০১২ সালের ১৯ মে। আর হলমার্ককে ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয়া হয় ২০১২ সালের এপ্রিলে। যেদিন হলমার্কের ঋণ ফাইলে হুমায়ুন কবির স্বাক্ষর করেন সেদিন এমডি’র কক্ষে যা ঘটেছিল তা এই প্রতিবেদকের কাছে বর্ণনা করেছেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী। হলমার্কের ফাইলে এমডি যেন স্বাক্ষর না করেন সে অনুরোধ নিয়ে ওইদিন এমডি’র কাছে গিয়েছিলেন সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন একজন প্রভাবশালী এজিএম, যিনি বর্তমানে ডিজিএম হিসেবে কর্মরত। তার সঙ্গে ছিলেন একজন জিএম (বর্তমানে একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক) ও একজন ডিজিএম (বর্তমানে অবসরে) পদমর্যাদার ব্যক্তি। হলমার্কের ঋণ ফাইলে তারা স্বাক্ষর না করার অনুরোধ জানালে এমডি তাদেরকে জানান, তিনি নিরুপায়। “আপনার কথা শুনলেতো আমি ব্যাংক চালাতে পারবো না। আমাকে অনেককেইতো মেনটেইন করে চলতে হয়।”

ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “এসময় এমডি’র কক্ষে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলতে বলতে প্রবেশ করেন ডিএমডি (সাবেক) মইনুল হক। তার হাতে ছিল একটি ফাইল। ফাইলটি এমডির সামনে রেখে তিনি বলেন, ব্যাংকিং সচিব কথা বলবেন। এমডি ফোনে অনেক্ষণ ধরে ব্যাংকিং সচিবের সঙ্গে কথা বলেন। ফাইলে স্বাক্ষর করার জন্য আরও কিছুদিন সময় চান। শেষ পর্যন্ত তিনি ফোন রেখে মুখ কালো করে স্বাক্ষর করে দেন।” ওই সচিব অবসরে গেলেও এখন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। দুদকের মামলায় ডিএসডি মইনুল হকেরও নাম রয়েছে। আজ পর্যন্ত তাকে ‘খুঁজে’ পায়নি দুর্নীতি দমন কমিশন।
এদিকে এই অর্থ লুটের ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলামসহ পরিচালনা পরিসদের কয়েকজন সদস্যের নাম ঘুরেফিরে এলেও তাঁদের বাদ দিয়েই অভিযোগপত্র দিয়েছিল সংস্থাটি।
হুমায়ুন কবিরকে সর্বশেষ প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে। ওইদিন তিনি দুদকে হাজিরা দিয়েছিলেন। তখন তিনি গণমাধ্যমের কাছে বলেছিলেন, “আমার এক সুতা পরিমাণও দোষ নাই।”
ওইদিনের পর থেকে দুদক ও সোনালী ব্যাংক- কেউই তাকে ‘খুঁজে’ পায়নি। জানা গিয়েছিল, তিনি কানাডায় চলে গিয়েছিলেন। তবে গতবছরের শুরুর দিকে তাকে গুলশানের একটি অফিসে দেখা গেছে। সেখানে সোনালী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গেও তার দেখা হয়েছে। বেশ কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পর বর্তমানে তিনি দেশে আছেন, এমন তথ্য হুমায়ুন কবিরের এক ঘনিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে জানা গেছে।

সোনালীর সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরের প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ব একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘হুমায়ুন কবির স্যারকে আমি খুব ভালো করে চিনি। তিনি যখন ব্যাংকের এমডি আমি তখন স্থানীয় শাখার মহাব্যবস্থাপক। উনি এতটাই সৎভাবে চলতেন যে, ১০ হাজার ২০ হাজার টাকার সংকটে পড়তেন। আমার কাছ থেকেও বহুদিন তিনি টাকা ধার করে চলেছেন। ওনার মতো ব্যক্তি হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে- আমার বিশ্বাস হয় না। আমি ওনার সঙ্গে কথা বলে যতদুর জেনেছিলাম, হুমায়ুন কবির স্যার একজন সচিবের চাপে পড়ে হলমার্ককে ঋণ দিয়েছিলেন। আর ওনার এমডি পদের মেয়াদ বাড়ানোর লোভেই এই অন্যায় চাপে নতি স্বীকার করেছিলেন, যেটা করে উনি ফেঁসে যান।’

এদিকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিকুর রহমান আটকের পর মারা যান। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় তার ‘দায়’ ছিলোনা- সোনালী ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জোর গলায় বলেছেন।
বেসিক ব্যাংকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ২৭ জন ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৫৬টি মামলা করে দুদক। অথচ ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু সহ বোর্ডের কারো বিরুদ্ধেই প্রশ্ন পর্যন্ত তোলেনি কমিশন। যদিও এই লুটের ঘটনায় বাচ্চুকে সবচেয়ে বেশি ‘অভিযুক্ত’ করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে। অর্থমন্ত্রীও বাচ্চুর সংশ্লিষ্ট থাকার কথা একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন। দুদকের মামলায় ৫ ব্যাংক কর্মকর্তাকে আটক করা হলেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত বোর্ডের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করেনি সংস্থাটি। তবে গণমাধ্যমের ব্যাপক চাপের মুখে গত মাসের শুরুতে বাচ্চু সহ তৎকালীন পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের তালিকায় নেয় দুদক।
বাচ্চুকে দীর্ঘদিন জিজ্ঞাসাবাদের তালিকার বাইরে রাখায় একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছিলেন, ‘বেসিক ব্যাংকে হরিলুটের পেছনে আবদুল হাই বাচ্চু জড়িত। তারপরও দুদক তাকে কেন আসামি করছে না তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।’ বাচ্চুকে আসামি না করায় অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করে দুদককে তলব করেছিল।

বেসিক ব্যাংকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির সময় এমডি ছিলেন কাজী ফখরুল ইসলাম। তাকে ২০১৪ সালের ২৫ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অপসারণ করে। তাকেও আর খুঁজে পায়নি দুদক। তার সঙ্গে মালয়শিয়ায় দেখা হওয়ার তথ্য এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন একাধিক ব্যক্তি।
অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৫ সালের ৮ ডিসেম্বর বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ তিন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুস সোবহান, মো. সেলিম ও রুহুল আলমকে অপসারণ করে। এরপর থেকে জেলে রয়েছেন ফজলুস সোবহান ও মো. সেলিম। ‘নিখোঁজ’ আছেন সাবেক সেনা সদস্য রুহুল আলমও, যাকে বাচ্চুর ডানহাত হিসেবে চিনত ব্যাংক পাড়ার সবাই।

অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদের মেয়াদে অনিয়মের মাধ্যমে জজ ভুইঞা গ্রুপকে ৫৬৪ কোটি টাকা, মুন গ্রুপকে প্রায় ৭শ কোটি টাকা ও তানাকা গ্রুপকে ৩শ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার অভিযোগ ওঠে। এসব ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে আবদুল হামিদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়ায় মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ দিন আগে (২৯ জুন ২০১৬) অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পরের দিন দুদক আটক করে ডিএমডি (ভারপ্রাপ্ত এমডি) মিজানুর রহমানকে। পরে ৪ আগস্ট জামিন পান তিনি। ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় অগ্রণী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করলেও বোর্ডের কারো বিরুদ্ধেই কোন অভিযোগ আনেনি।
জানতে চাইলে বড় আসামিদের কেন আটক করা হচ্ছে না- জানতে চাইলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্রাচার্য্য বলেন, তদন্ত কর্মকর্তারাই প্রয়োজন মনে করলে আসামিদের গ্রেপ্তার করেন। এ বিষয়ে কমিশন বিশেষ কোন নির্দেশনা দেয় না। “অনেক সময় গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেও কাউকে আটক করা সম্ভব হয় না। কেউ পালিয়ে যান। কেউ আদালত থেকে জামিন নিয়ে নেন।”

https://www.dailyinqilab.com/article/106465