২৯ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৪০

সূক্ষ্ম শর্তের মারপ্যাঁচে বেতারে বড় অঙ্কের দুর্নীতির ফাঁদ

বাংলাদেশ বেতারের ট্রান্সমিটার কেনার প্রাথমিক ধাপেই দুর্নীতিবাজদের শক্তিশালী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দরপত্রের মূল্যায়ন থেকে শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা নির্ধারণের প্রতিটি ধাপে তাদের ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’ হাসিলের ফাঁদ অনেকটা স্পষ্ট। অভিযোগ আছে, মোটা অঙ্কের অলিখিত কমিশনের বিনিময়ে পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে টেন্ডারের সুবিধামতো শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধেও গুরুতর নানা অভিযোগ ক্রমেই ডালপালা মেলছে। সব মিলিয়ে বেতার কর্তৃপক্ষ স্বচ্ছভাবে ট্রান্সমিটার কেনার প্রক্রিয়াটি শেষ করতে পারবে কিনা, তা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বেতারের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক নারায়ণ চন্দ্র শীল মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, তিনি এ পদে নতুন যোগ দিয়েছেন। ট্রান্সমিটার ক্রয় প্রক্রিয়ার আদ্যোপান্ত এখনও অবগত নন। তবে প্রক্রিয়াটি সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন হবে বলে নিশ্চিত করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, অনেক সময় ঠিকাদারদের মধ্যে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা ছাড়াও দ্বন্দ্ব থাকে। সে দৃষ্টিকোণ থেকেই কাজ না পেলে তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মনগড়া অভিযোগ করে থাকেন। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার।
সূত্র জানায়, ৪০ কোটি টাকায় এক হাজার কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ট্রান্সমিটার কিনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ বেতার। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এ ট্রান্সমিটার কিনতে গত আগস্টে আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকা হয়। মোট ৮টি প্রতিষ্ঠান টেন্ডার কিনলেও প্রাক-দরপত্র (প্রি-বিড) মিটিংয়ে ৫টি প্রতিষ্ঠান অযোগ্য ঘোষিত হয়। ফলে বাকি ৩টি প্রতিষ্ঠান তাদের দরপত্র প্রস্তাব জমা দেয়। এগুলোর মধ্যে সর্বনিন্ম দরদাতা হয় ক্রোয়েশিয়াভিত্তিক রিজ ট্রান্সমিটার। তারা ৩৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকার দর প্রস্তাব করে। অন্য দুটি কোম্পানি ফ্রান্সের এরিলিজ ও আমেরিকার গেটস এয়ার। তাদের প্রস্তাবিত দর যথাক্রমে- ৩৫ কোটি ৫ লাখ ও ৪০ কোটি টাকা। নিয়মানুযায়ী সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে ক্রোয়েশিয়ার রিজ কোম্পানির কাজ পাওয়ার কথা। কিন্তু পছন্দের কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতে দরপত্রে বৈষম্যমূলক শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। শর্তে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে ১০ বছরের মধ্যে ট্রান্সমিটার স্থাপনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ শর্ত নিয়েই এখন হইচই চলছে।
সূত্র বলছে, ফ্রান্সে দেউলিয়া ঘোষিত থমসন নামের একটি কোম্পানির বাংলাদেশের এজেন্টের সঙ্গে বেতারের প্রভাবশালী মহলের রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এ সুবাদে থমসনের এজেন্টকে কাজ পাইয়ে দিতে অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেয় বেতারের সংশ্লিষ্ট চক্র।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ বেতারের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, দরপত্রের শর্তে বলা হয়েছে ১০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কারণ থমসন কোম্পানি ২০০৯ সালে বাংলাদেশ বেতারে এক হাজার কিলোওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার স্থাপন করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ শর্ত হওয়া উচিত ছিল ‘কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা’ থাকতে হবে। তাহলে বিশেষ কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেয়া অসাধু তৎপরতা গোড়াতেই থেমে যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। বেতারের আরেক কর্মকর্তা বলেন, থমসন দেউলিয়া হয়ে পড়ায় বেতারের একমাত্র এক হাজার কিলোওয়াটের ট্রান্সমিটারটির যথাযথ সার্ভিস ও খুচরা যন্ত্রাংশ কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ট্রান্সমিটার কেনার জন্য যাকে প্রকল্প পরিচালক করা হয়েছে তাকে নিয়েও ঠিকাদারদের আপত্তি ছিল। কারণ ২০০৯ সালে বেতারের জন্য প্রথম এবং এক হাজার কিলোওয়াটের একমাত্র যে ট্রান্সমিটারটি কেনা হয় সেখানেও প্রকল্প পরিচালক ছিলেন নজরুল ইসলাম এবং ওই প্রকল্পেও অনিয়মের অভিযোগ ছিল প্রবল। প্রথমত, ওই ট্রান্সমিটারটি থমসন স্থাপন করলেও সেসময় এ সেক্টরে তাদের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। আর তাদের দ্বিতীয় ট্রান্সমিটার স্থাপনের অভিজ্ঞতা হয় ২০১২ সালে ভারতে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। অর্থাৎ বাংলাদেশে একেবারে অভিজ্ঞতাবিহীন একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ট্রান্সমিটারটি স্থাপন করা হয়। এছাড়া এবার অভিজ্ঞতার শর্ত প্রয়োগ নিয়ে যে ফাঁদ পাতা হয়েছে তাতে নির্ঘাত তারা আবারও কাজ পেতে যাচ্ছে। এটি এখন অনেকটা স্পষ্ট বললেও ভুল বলা হবে না।
সূত্র বলছে, ১০০০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটারের গ্রাহক পৃথিবীতে অত্যন্ত সীমিত। এখন পর্যন্ত এ ধরনের ট্রান্সমিটার স্থাপিত হয়েছে মাত্র ১২-১৩টি। এর মধ্যে ক্রোয়েশিয়ার রিজ ট্রান্সমিটার কোম্পানিই এককভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অন্তত ৮টি ট্রান্সমিটার স্থাপন করেছে।
জানা যায়, বর্তমান টেন্ডারে নটেল নামের একটি কানাডীয় কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে নানা প্রক্রিয়া চলমান ছিল। সেজন্য নটেল দরপত্রও কেনে। কিন্তু এ সেক্টরে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় শেষপর্যন্ত নটেলকে বাদ দিতে হয়। তবে ঠিকাদারদের কেউ কেউ বলছেন, থমসন এবং নটেল একই স্থানীয় প্রতিনিধি দিয়ে পরিচালিত, যার সঙ্গে এরিলিজের স্থানীয় প্রতিনিধির ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব রয়েছে। অনেকে মনে করেন, থমসন, নটেল ও এরিলিজের প্রতিনিধি ভিন্ন নামে হলেও পর্দার আড়ালে থমসনের প্রতিনিধি হিসেবে জনৈক মামুনকে কাজ পাইয়ে দিতে এত কলাকৌশল চলছে, যিনি বেতারের প্রভাবশালী এক কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

অবাক কাণ্ড হচ্ছে জনৈক মামুনের সঙ্গে বেতারের প্রভাবশালী কর্মকর্তার সখ্যতার বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। কারণ এরিলিজের নামে দরপত্র কেনা হলেও বেতারের পক্ষ থেকে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণার সময় থমসনের নাম উল্লেখ করা হয়। প্রি-বিড মিটিংয়েও থমসনের প্রতিনিধি হিসেবে জনৈক মামুন উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, দেউলিয়া হওয়ার পর থমসন কিনে নেয় ফ্রান্সেরই আরেক কোম্পানি এরিলিজ। বর্তমানে এরিলিজের পক্ষে বাংলাদেশ এজেন্ট শহীদ এন্টারপ্রাইজ বাংলাদেশ বেতারে দরপত্র জমা দিলেও সব কলকাঠি নাড়ছেন থমসনের ওই এজেন্ট। এরিলিজের ব্যানারে তাকে ব্যবসা পাইয়ে দিতেই পর্দার আড়ালে জোর প্রচেষ্টা চলছে।
এদিকে এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক নজরুল ইসলামের বক্তব্য জানতে চাইলে মঙ্গলবার রাতে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চান না। যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/29/175621