২৯ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৩৯

যে কারণে পদত্যাগে বাধ্য হলেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর

বাংলাদেশ ব্যাংক কড়া তাগিদ দিলেও ফারমার্স ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়েনি। তারল্য সংকট দ্রুত দূর করা হবে বলে কালক্ষেপণ করা হচ্ছিল।

এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তিনশ’ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার শেষ চেষ্টাও অব্যাহত ছিল। কিন্তু পদত্যাগে মোটেও রাজি ছিলেন না একসময়ে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আমলা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। কিন্তু যখন সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দ্রুত বিদায় নেয়ার বার্তা পৌঁছে যায় তখন তার আর কিছুই করার ছিল না।

অগত্যা সোমবার রাতে পদত্যাগের ঘোষণাটি আসে। একই সঙ্গে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতী এবং ভাইস চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আতাহার উদ্দিন। এভাবে ফারমার্স ব্যাংকে বহুল আলোচিত মহীউদ্দীন খান আলমগীর যুগের অবসান ঘটে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে তিনটি ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। ইতিমধ্যে ঋণ বিতরণে জালিয়াতি এবং আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে ব্যাংকটির স্বাভাবিক কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে আমানতকারী সাধারণ গ্রাহকদের মাঝেও নানা প্রভাব ফেলছে। এতে করে গ্রাহকদের অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে নিতে চান। ইতিমধ্যে ফারমার্স ব্যাংকে বড় অঙ্কের অর্থ তুলে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া প্রায় একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং মেঘনা ব্যাংকেও।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদিত ব্যাংকগুলো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে বেশি। এ কারণে ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। আরও দুটি ব্যাংকের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। এরপরও নতুন করে আরও তিনটি ব্যাংক আসার খবরে অনেকে হতবাক হয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া ব্যাংকগুলো অনুমোদনের আগেই বিরোধিতা করা হয়েছে। নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেয়ার পক্ষে কেউ ছিল না। দেশের ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনরা নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। চার বছরের ব্যবধানে এখন সে বিরোধিতার বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ফারমার্সসহ নতুন তিনটি ব্যাংক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। বাকিগুলোর অবস্থাও ভালো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী আরও তিনটি নতুন ব্যাংক দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। শুনে অবাক হলাম। কী করে সম্ভব? যেখানে আগের নতুন ব্যাংকের অবস্থা খারাপ, সেখানে আরও নতুন ব্যাংক! তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আসলে আমাদের বড় সমস্যা হল আমরা চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারি না।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে ঋণ বিতরণ এবং তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হওয়ায় ফারমার্স ব্যাংকের এমডি একেএম শামীমকে কেন অপসারণ করা হবে না, জানতে চেয়ে রোববার নোটিশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সূত্র বলছে, ৭ দিনের মধ্যে গ্রহণযোগ্য জবাব দিতে ব্যর্থ হলে তাকে অপসারণ করা হতে পারে। আগামী সপ্তাহে এরকম খবর শোনা গেলে সে ক্ষেত্রে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

সার্বিক বিষয়ে ফারমার্স ব্যাংকের পদত্যাগকারী চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও এমডি একেএম শামীমের বক্তব্য নিতে কয়েক দফা মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারা কেউ ফোন রিসিভ করেননি। তবে এক প্রশ্নের জবাবে ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত যুগান্তরকে জানান, আমানতকারীরা অর্থ তুলে না নেয় সে জন্য আমরা আস্থার পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছি। তাদেরকে অভয় দেব যে, তাদের টাকা খোয়া যাবে না। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঋণে ব্যাপক অনিয়মের কারণে ফারমার্স ব্যাংক বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়ে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন এ বেসরকারি ব্যাংকের সংকট নিরসনে জোরালো উদ্যোগ নেয়। আমানতকারীদের আস্থা ফেরানোসহ সংকট কাটানোর অংশ হিসেবে পর্ষদ পুনর্গঠনের চেষ্টা চালায়। এ লক্ষ্যে গত সপ্তাহে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ প্রভাবশালী ও বিতর্কিত তিন পরিচালককে ডেকে নিয়ে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করতে বলা হয়। এমনকি জানিয়ে দেয়া হয়, তারা নিজ থেকে সরে না দাঁড়ালে শিগগির তাদের অপসারণ করা হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন কঠোর অবস্থানের পক্ষে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সমর্থন রয়েছে- এমন খবর নিশ্চিত হওয়ার পর তারা পদত্যাগ করেন। এ জন্য খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সোমবার রাতে ফারমার্স ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পর্ষদ সভা ডাকা হয়।

বৈঠক শেষে রাত সাড়ে ৯টায় বাংলাদেশ ব্যাংক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাদের পদত্যাগের বিষয়টি জানায়। এতে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংকে বেশ কিছুদিন ধরে তারল্য ঘাটতি থাকায় এবং আর্থিক সূচকগুলোর অবনতি হওয়ায় জনগণের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়। বেশকিছু আমানতকারী ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেয়ার চেষ্টা করায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসায় প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারিও অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া ব্যাংকের এমডির বিরুদ্ধেও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ লঙ্ঘনের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

ফারমার্স ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৩ সালের জুনে। শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটি। সাইন বোর্ডসর্বস্ব ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান, অন্য ব্যাংকের মন্দ ঋণ কেনা, ঋণের তথ্য গোপনসহ বিভিন্ন গুরুতর জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। গত সেপ্টেম্বর শেষে এ ব্যাংকের ৩৭৮ কোটি টাকার ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকটির মোট ঋণের যা ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ পরিমাণ অর্থ নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ব্যাংকটির বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে যুগান্তরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক খবর প্রকাশিত হয়।

আস্থার সংকটে পড়া ব্যাংকটি অন্য ব্যাংকের তুলনায় উচ্চসুদে আমানত চেয়েও পাচ্ছে না। উল্টো বেশিরভাগই এখন আমানত তুলে নিচ্ছেন। এতে গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে এ ব্যাংক। এ পরিস্থিতিতে গত ৯ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইইএফ (ইকুইটি অ্যান্ট্রাপ্রেনারশিপ ফান্ড) ও গৃহায়ন তহবিল থেকে ৩০০ কোটি টাকার আমানত চেয়ে গভর্নর বরাবর একটি চিঠি দেন ফারমার্সের এমডি। তবে তাতে সাড়া মেলেনি। পরে গত ২১ নভেম্বর তারল্য সহায়তা (রেপোর বিপরীতে) হিসেবে ব্যাংকটিকে স্বল্পমেয়াদে ৯৬ কোটি টাকা দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণের পাশাপাশি এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে।

নানা অভিযোগের ভিত্তিতে ফারমার্স ব্যাংকের ওপর ২০১৪ ও ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একাধিক বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম চালানো হয়। এসব পরিদর্শনে ঋণের তথ্য গোপনসহ বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য পাওয়ায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটিকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। বিভিন্ন ঋণ অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় তখনকার নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান থেকে মাহাবুবুল হক চিশতীকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলেও তা মানেনি ব্যাংকটি। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শাখা সম্প্রসারণ ও নতুন ঋণ বিতরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।

এদিকে বিভিন্ন ঋণ অনিয়মের কারণে মন্দ ঋণের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। ব্যাংকটির ১৯৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। যা আগের প্রান্তিকে ছিল ১৯২ কোটি টাকা। এ ব্যাংকের নেতৃত্বে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার ফরাছত আলী। ব্যাংকটির এমডির দায়িত্বে আছেন দেওয়ান মুজিবুর রহমান। ঋণ অনিয়ম এবং আমানতকারীদের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থতার দায়ে যে কোনো সময় এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের এমডিকেও অপসারণ করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘ শুনানি শেষে বর্তমানে দেওয়ান মুজিবুর রহমানের ভাগ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে ঝুলে আছে।

খেলাপি ঋণের তৃতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছে মেঘনা ব্যাংক। নতুন সব ব্যাংকের আগে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণের জালে ঢোকে। এরপর ক্রমেই পাল্লা ভারি হওয়া ছাড়া কমেনি মন্দ ঋণ। গত তিন মাসে মেঘনা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০০ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হারে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে ব্যাংকটি। চলতি বছরে ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে জানা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মেঘনা ব্যাংক ২ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১৫২ কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭৬ শতাংশ। এ ছাড়া গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২১ কোটি টাকা। এ হিসাবে ৯ মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬২৩ শতাংশ।

মেঘনা ব্যাংকের নেতৃত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও রংপুরের সংসদ সদস্য এইচএন আশিকুর রহমান। ব্যাংকটির এমডির দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ নুরুল আমিন। তবে ঋণ বিতরণ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কারণে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। আগামী ৩১ ডিসেম্বর তার পদত্যাগ কার্যকর হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

 

https://www.jugantor.com/online/economics/2017/11/29/64802