২৯ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৩৪

কোন্ পথে দেশের ব্যাংকিং খাত

কোন্্পথে যাচ্ছে দেশে ব্যাংকিং খাত। নানা অঘটনে একের পর এক ব্যাংকগুলোতে পরিবর্তন আসছে। ব্যাংকিং খাতে এ পরিবর্তনে সাধারণ গ্রাহকরা শঙ্কিত। কার স্বার্থে কোন্ অদৃশ্য শক্তির ইশারায় এই পরিবর্তন তা বুঝতে কষ্ট হলেও দেশের ব্যাংকিং খাতে কালো মেঘের ছায়া স্পষ্ট। পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনে ব্যাংকের বোর্ডে পরিবর্তন সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত বিষয়। দেশে ইসলামী ধারার বড় দুই ব্যাংকের বোর্ডে এ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসার পর অন্য ব্যাংকের পরিচালকরাও বিষয়টিতে বিশেষ নজর রাখছেন। বড় অংকের শেয়ার লেনদেনের কারণে এরই মধ্যে আলোচনায় এসেছে চতুর্থ প্রজম্মের ব্যাংক ফার্মাস।

জানা গেছে, সোনালী, রুপালী, জনতা, আগ্রণী, পূবালী, বেসিক ব্যাংক লোপাটের পর টার্গেট করা হয় দেশের শীর্ষ স্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে। এর মধ্যে প্রথম টার্গেটে পড়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী ব্যাংক। তারপর সোসাল ইসলামী ব্যাংক, ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, কর্মাস ব্যাংক এবং ফার্মাস ব্যাংক। একই পথে পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এবং ঢাকা ব্যাংকে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে যা চলছে তা অশনি সংকেত বহন করছে। ব্যাংকিং খাতে ঘটেছে একের পর এক অস্বাভাবিক বড় কেলেঙ্কারি। যেমন সোনালী ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি ইত্যাদি। সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত দলীয় লোকদের অধীনেই চলে লুটপাটের ব্যবস্থা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়। চলে সরকারি বেসিক ব্যাংকে লুটপাট। ঋণ বিতরণে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ খেলাপির কারণে ধ্বংসের শেষ সীমায় আছে কৃষি ব্যাংক। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিভার্জ চুরি এবং বারবার ব্যাংকটির কেন্দ্রীয় অফিসে আগুন লাগা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও আস্থাহীনতা ও চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকই এখন ধ্বংসের দ¦ারপ্রান্তে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের লাইসেন্স ও জোর করে পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের কারণে এমন অবস্থা দেখা দিয়েছে। সেই সাথে স্বার্থান্বেষী মহলের ভূমিকাও রয়েছে। এতে গোটা ব্যাংকিং খাতের প্রতিই আমানতকারীসহ দেশবাসীর আস্থা নষ্ট হচ্ছে। ব্যাংকিং লেনদেন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন অনেকে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ১০ বছর আগে ব্যাংকের অর্থ এভাবে লুটপাটের কথা কেউ চিন্তাও করেনি। কিন্তু ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শেয়ারবাজার ও ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুটপাট শুরু হয়। সেই সাথে রাজনৈতিক বিবেচনায় চলতে থাকে নতুন নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান ও ব্যাংকগুলোতে পরিচালনা পরিষদে পরিবর্তন। সম্প্রতি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এর আগে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মালিকানা বদল আরেকটি বিশেষ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

সূত্র বলছে, ইসলামী ব্যাংক দেশের অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। যদিও মালিকানা পরিবর্তনের পর ব্যাংকটি নানা অনিয়মে জড়িয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে তারল্য সংকটও। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকরা অনেকেই ব্যাংকটি থেকে তাদের একাউন্ট বন্ধ করে দিচ্ছেন। কমে গেছে এর রেমিট্যান্স সংগ্রহও। একই কায়দায় পরিবর্তন আনা হয়েছে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডও (এসআইবিএল) এখন একটি বিশেষ গ্রুপের অধীনে চলে গেছে। গত ৩০ অক্টোবর এসআইবিএল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন হয়। ওইদিন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) হঠাৎ পদত্যাগ করতে হয়েছে। রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আনোয়ারুল আজিম আরিফ। নতুন এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি কাজী ওসমান আলীকে। এ ছাড়া নির্বাহী কমিটির নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ।

সংসদীয় কমিটিতে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সম্পর্কে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোর্ড সভায় অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে উপস্থিতি দেখিয়ে পর্ষদ সভার কার্যবিররণী করা হয়েছে। নিয়ম ভেঙে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে। ব্যাংকটি গঠনের সময় মূলধন আনায় অনিয়ম, অনিবাসীদের পরিবর্তে বেনামে বাংলাদেশে বসবাসকারী ব্যক্তি কর্তৃক ব্যাংকের শেয়ার কেনা, বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ প্রদান এবং ব্যাংক হতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টির সাথে পর্ষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সম্পৃক্ততার কথা এসেছে প্রতিবেদনে।

নিয়মনীতির তোয়াক্কা ছাড়াই চলছে দেশের ব্যাংকিং খাত। যার অনন্য দৃষ্টান্ত বেসিক ব্যাংক। অত্যন্ত শক্তিশালী এ ব্যাংকটি আজ দেউলিয়ার পথে। পুরো ব্যাংকিং খাত বিপর্যন্ত। কিন্তু বড় বিস্ময়, ব্যাংক লুটপাটকারী দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হয় না। আর অনেক বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ পরিচালকরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে যাচ্ছেন। ১০ বছর আগে যা কল্পনায়ও আসেনি। এই অবস্থায় লুটপাটকে আরো ত্বরান্বিত করতে আসছে ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন। এক পরিবার থেকে চার পরিচালক ও পরিচালকদের মেয়াদ ৯ বছর করা এই দুটো আইনি পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে।

বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের মালিকানা ওই পরিবারগুলোর মধ্যে স্থায়ী করার উদ্যোগ এটি। এটা অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত। খেয়াল রাখতে হবে, রাজনৈতিক স্বার্থ ও স্বজনপ্রীতির কারণে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা বড় ধরনের রাজনৈতিক দুর্নীতি মনে করি। কারণ, ব্যাংকের আসল মালিক আমানতকারীরা। আমানতকারীদের টাকা অন্যদের কাছে ঋণ দিয়ে ব্যাংকের ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। এই মালিকদের অনেকে নিজেরা আসলে কোনো পুঁজি বিনিয়োগ না করে ব্যাংকের মালিক-পরিচালক হয়ে গেছেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন চিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি মাসের ২৭ দিনেই ঢাকা ব্যাংকের ১৮ কোটি ৫০ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জটিতে। লেনদেনকৃত এ শেয়ার ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ২৫ শতাংশের বেশি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত দুই মাসেই ঢাকা ব্যাংকের অন্তত ১০ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছে কয়েকটি শিল্প গ্রুপ। অস্বাভাবিক এ লেনদেনের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়াও শুরু করেছেন ব্যাংকটির পরিচালকরা।

বিষয়টি স্বীকার করেন ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ছয় মাস ধরেই পুঁজিবাজারে ঢাকা ব্যাংকের শেয়ারের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ থেকেই বাজারে কোনো গুজব ছড়াতে পারে। তবে আমরা পুঁজিবাজারে লেনদেনের দিকে লক্ষ্য রাখছি।
১৯৯৫ সালের ৫ জুলাই যাত্রা করা ঢাকা ব্যাংক লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস। ব্যাংকটির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসও। যদিও তাদের দুজনই এখন ব্যাংকটির বোর্ডের বাইরে। এ দম্পতির সন্তান মির্জা ইয়াসির আব্বাস রয়েছেন ঢাকা ব্যাংকের বোর্ডে। এছাড়া পরিচালনা বোর্ডের বেশ কয়েকজন সদস্য রয়েছেন বিএনপি ঘরানার। পরিচালকদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ব্যাংকটির পরিষদে পরিবর্তনের সুর তুলেছে বলে জানা গেছে।

যোগাযোগ করা হলে ঢাকা ব্যাংকের চেয়ারম্যান রেশাদুর রহমান বলেন, বাজারে অনেক কথাই শোনা যায়। সব কথা সঠিক নাও হতে পারে। এ মুহূর্তে আমাদের প্রতি কোনো ইঙ্গিত বা চাপ নেই। সম্প্রতি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনসহ পারিপার্শ্বিক ইস্যুতে অর্থমন্ত্রী কথা বলেছেন। সরকার বিষয়গুলো বিবেচনা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ড. ইব্রাহিম খালেদ বলেন, চর দখলের মতো ব্যাংক দখল চলছে। এভাবে একটি দেশে অর্থিক খাত চলতে পারে না। নতুন নতুন ব্যাংক নানা ইস্যুতে দখল চলছে। এ দখল কে কার ইশারায় করছে তা স্পষ্ট নয়। তবে ব্যাংকিং খাতে কালো মেঘের ছায়া এখন দৃম্যমান। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পরলে দেশের অর্থনীতিতে মহাবিপর্যয় নেমে আসবে।

http://www.dailysangram.com/post/309460