২৮ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:১৫

বেসিক ব্যাংকের অর্থ লোপাট

‘ঋণ প্রস্তাব পরীক্ষা করতে পারিনি’

আরও দু’জন পর্ষদ সদস্যকে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ * সংগ্রহ করে রাখা হচ্ছে পর্ষদ সদস্যদের পাসপোর্ট ও ন্যাশনাল আইডি নম্বর

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জিজ্ঞাসাবাদে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক এক সদস্য বলেছেন, ‘আমি বোর্ড সভায় উপস্থিত থাকতাম। ঋণের প্রস্তাব টেবিলে আসত ঠিকই; কিন্তু এ প্রস্তাব সঠিকভাবে এসেছে কিনা বা ঋণের জন্য আবেদনকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা আবেদন ও ডকুমেন্ট সঠিক ছিল কিনা, তা আমরা পরীক্ষা করতে পারিনি। এমনকি কাকে কীভাবে ঋণ দেয়া হচ্ছে, তা-ও জানতে পারিনি।’ ঋণের ক্ষেত্রে যে অনিয়ম হয়েছে, তা সে সময় বুঝতে পারেননি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলাম যেভাবে ফাইল উপস্থাপন করতেন, আমরা সেভাবে তাতে স্বাক্ষর করে দিতাম।’
বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সাবেক ১৩ সদস্যদের মধ্যে গত তিন কার্যদিবসে পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করেছে দুদক। সোমবার দুদকের তদন্ত টিম ব্যাংকটির সাবেক দুই পর্ষদ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তার হলেন- সাবেক কাস্টমস কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন ও বিসিকের সাবেক চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম। আজ জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে সাবেক পর্ষদ সদস্য কামরুল অ্যান্ড ইসলাম আফতাব কোংয়ের পার্টনার একেএম কামরুল ইসলাম ও চাঁদপুর চেম্বারের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর আকন্দ সেলিমকে। সোমবার দুদকের পরিচালক জায়েদ হোসেন খান ও সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে ১২ সসদ্যের তদন্ত টিম সাবেক পর্ষদ সদস্য ফখরুল ইসলাম ও শাখাওয়াত হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদকালে তাদের মেয়াদে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করেন।

দুদক কর্মকর্তারা একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকলে এক সদস্য বলেন, ‘আমরা বুঝতেই পারিনি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে এতবড় জালিয়াতির ঘটনা ঘটে গেছে।’ ওই সদস্যের এ ধরনের বক্তব্যে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, আপনারা তো পুতুল ছিলেন না। বুঝতে পারিনি বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বের করে দেয়ার দায় আপনাদেরও (পর্ষদ সদস্য) নিতে হবে। দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।’ দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের পর দু’জন সদস্য যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সাংবাদিকরা তাদের ঘিরে ধরে জানতে চান, তারা মিডিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা বলবেন কিনা। এ সময় কোনো কথা না বলে দৌড়ে দুদক কার্যালয় ত্যাগ করেন পর্ষদ সদস্য শাখাওয়াত হোসেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কর্মকর্তারা ব্যাংকটির সাবেক পর্ষদ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য লিখিতভাবে সংগ্রহ করে রাখছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের নাম ও ঠিকানা, তাদের পাসপোর্ট নম্বর, ন্যাশনাল আইডি নম্বর, জন্ম তারিখ। এ ছাড়া তারা কে কখন থেকে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব নিয়েছেন, কত তারিখ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন, এ সংক্রান্ত তথ্য ছাড়া আরও কিছু প্রশ্নের লিখিত জবাব দিতে বলা হয় তাদের। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি শাখা থেকে ঋণ প্রস্তাব করা হয় প্রধান কার্যালয়ে। ওই শাখা থেকে ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে ঋণের জন্য আবেদনকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক নোটও সঙ্গে দেয়া হয়। ক্রেডিট কমিটির নেতিবাচক সুপারিশ থাকার পরও কেন ওইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ অনুমোদন দেয়া হল, সেই প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দিতে বলা হয় তাতে।

এদিকে সোমবার দুদক কর্মকর্তাদের জেরার মুখে একজন পর্ষদ সদস্য নিজেকে আড়ালে রেখে দেয়া বক্তব্যে বলেন, অনিয়মের বিষয়ে তারা জানতেন না। ওই সদস্যের এই বক্তব্যের সূত্র ধরে দুদক কর্মকর্তারা তাকে বলেন, ‘ব্যাংক পরিচালনার দুটি অংশ রয়েছে। একটি হল ব্যবস্থাপনা অংশ, আরেকটি পরিচালনা বোর্ড বা পর্ষদ। ঋণ অনিয়মের দায়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা অংশের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ৫৬ মামলায় তারা আসামি হয়েছেন। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের দায় নেবে কে? আপনারাও তো দায়ী। সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আপনাদের দায় নির্ধারণ করতেই তদন্ত হচ্ছে।’ এ সময় ওই পর্ষদ সদস্য বলেন, ‘আমরা স্বীকার করছি, অনিয়ম হয়েছে। কিন্তু সে সময় টের পাইনি। পরে বুঝতে পেরেছি।’ তিনি আল্লাহর কসম কেটে বলেন, দুর্নীতির ঘটনায় তেমন কিছু জানেন না। অপর একজন পর্ষদ সদস্যদে দুদক কর্মকর্তারা প্রশ্ন করেন, ‘এত বড় দুর্নীতি হল। আপনি কেন নীরব ছিলেন? কেন দুর্নীতির অংশী হলেন? জনগণের টাকা আপনাদের হাতের ওপর দিয়ে বের হয়ে গেল। এখন বলছেন বুঝতে পারেননি। এটা কি ছেলেখেলা?’
দুদক কর্মকর্তারা তাকে বলেন, ‘সরকার বিশ্বাস করে আপনাদের রক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে ব্যাংকে নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু আপনারা রক্ষক হয়ে এ কী করলেন। আপনাদের কেউ চাপ দিয়েছিল কিনা বা তদবির ছিল কিনা- এ প্রশ্নে এক সদস্য বলেন, কারও অনুরোধে বা চাপে তিনি কোনো কাজ করেননি। তবে আরও কিছু কথা বলতে গিয়ে তিনি এক পর্যায়ে বলেন, ‘অনেক কথা আছে। কিন্তু সব বলা যাচ্ছে না।’ কেন বলা যাবে না- এ প্রশ্নে ওই সদস্য চুপ হয়ে যান। তখন দুদক কর্মকর্তারা তাকে বলেন, ‘আপনি কেন ওই অনিয়মের ঋণ প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে বোর্ড মিটিংয়ের রেজুলেশনে স্বাক্ষর করলেন। আপনি তো আপত্তি জানাতে পারতেন। বলতে পারতেন, জালিয়াতির ঋণে আপনার মত নেই।’ এ পর্যায়ে ওই সদস্য নীরব থাকেন।

এর আগে বৃহস্পতিবার দুদক দুই সাবেক পর্ষদ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তখন একজন সদস্য স্বীকার করেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনে বোর্ড সদস্যদের ওপর পরোক্ষভাবে চাপ দিতেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু। যদিও বাচ্চুর বিষয়ে সোমবার দুই সদস্যের কেউ মুখ খোলেননি। দুদক বলছে, তারা মুখ না খুলে নিজেরাই নিজেদের ওপর দায় নিচ্ছে।

বেসিক ব্যাংকের অর্থ লোপাটের ঘটনায় ৫৬টি মামলা করে দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই ও অনুসন্ধান শেষে বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির ঘটনায় ২০১৫ সালের সেপ্টম্বরে মামলাগুলো করেছিল দুদক। বেসিক ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুসহ শীর্ষ ১৩ কর্মকর্তার ঋণ কেলেঙ্কারিতে সম্পৃক্ত থাকার কথা ওঠে আসে। তবে মামলায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত এমডি, ডিএমডি ও জিএমসহ শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের আসামি করা হলেও পর্ষদ সদস্যদের কাউকেই আসামি করা হয়নি। আবদুল হাই বাচ্চু ও পর্ষদ সদস্যদের আসামি করা নিয়ে উচ্চ আদালতে প্রশ্ন ওঠার পর তাদের তদন্তের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বেসিক ব্যাংকের তিনটি শাখায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। তবে এর মধ্যে ২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শনাক্ত হওয়ার ঘটনায় মামলা করে দুদক। এর মধ্যে গুলশান শাখার মাধ্যমে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, শান্তিনগর শাখায় ৩৮৭ কোটি টাকা, প্রধান শাখা থেকে ২৪৮ কোটি টাকা ও দিলকুশা শাখার মাধ্যমে ১৩০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। অনিয়মের মাধ্যমে এ ঋণ বিতরণ শনাক্ত হওয়ার ঘটনায় দুদকের মামলাগুলোর তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা পর্ষদ সদস্যের বক্তব্য পর্যালোচনা করছি। তারা কী কী তথ্য দিয়েছেন আর কী দেননি, তা মিলিয়ে দেখছি। তদন্তের প্রয়োজনে তাদের আবারও ডাকা হবে।

 

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/28/175371