২৮ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:১০

অপসারণ করা হচ্ছে এমডিকে

ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ

৫০ শতাংশের বেশি লোকসানি শাখা সিআরআর ঘাটতিতে সাড়ে ১৮ কোটি টাকার জরিমানা

ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতি পদত্যাগ করেছেন। অপসারণ করা হচ্ছে ব্যাংকটির এমডি এ কে এম শামীমকেও। কার্যক্রম শুরুর চার বছরের মাথায় ডুবতে বসছে নতুন প্রজন্মের দি ফারমার্স ব্যাংক। ইতোমধ্যে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ায় ওই ঋণ আর আদায় হচ্ছে না। আমানতকারীরাও ব্যাংক আমানত সংগ্রহে সাড়া পাচ্ছেন না ব্যাংকটির। ফলে তীব্র তারল্য সঙ্কটের মুখে পড়েছে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকটি। গত এক বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারছে না। ক্রমাগত সিআরআর ঘাটতির ফলে ইতোমধ্যে ব্যাংকটিকে সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর ৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে। এসব কারণে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীমকে কেন অপসারণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী গত রোববার রাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফারমার্স ব্যাংকের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চিঠিতে আগামী সাত দিনের মধ্যে এমডিকে কেন অপসারণ করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমডিকে অপসারণের বিষয়ে প্রধান দু’টি কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর তা হলো, ব্যাংকে তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে এমডি ব্যর্থ হয়েছেন। এ কারণে নগদ জমা বা সিআরআর এবং সংবিধিবদ্ধ জমা বা এসএলআরের অর্থ রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নতুন করে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, গত ২৭ অক্টোবার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে তা অবহিত করতে বলা হয়েছিল। এরই ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমডিকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ফারমার্স ব্যাংকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফারমার্স ব্যাংকের বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ৩ জুন ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে ব্যাংকটি। কার্যক্রম শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই ঋণ নিয়মাচার পরিপালনে এবং ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় শিথিলতা দেখা দেয়। ফলে ব্যাংকটিতে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হতে থাকে। মোটা দাগে ১৩টি বিশেষ অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ব্যাংকের নিজস্ব ঋণ নীতিমালা অনুসরণ না করে গ্রাহকদের ঋণসুবিধা দেয়া হয়েছে। ঋণের অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত না করে গ্রাহকদের উদ্দেশ্যবহির্ভূত খাতে অর্থ স্থানান্তরে পরোক্ষ সহায়তা করা হয় ব্যাংক থেকে। অস্তিত্বহীন ও সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়। ঋণ নিয়মাচার লঙ্ঘন করে ব্যাংকের পরিচালকসহ অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ দেয়া হয়। অপর্যাপ্ত ও ত্রুটিপূর্ণ জামানতের বিপরীতে ঋণ প্রদান ও খেলাপি গ্রাহকের বিপরীতে ঋণ দেয়া হয়। এভাবে ১৩টি অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে।

আর আর্থিক দুর্বলতার বিষয়ে বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান অনিয়ম প্রতিরোধ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার উন্নতি এবং ঋণ নিয়মাচারে শৃঙ্খলা আনয়ন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ায় আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার লক্ষ্যে গত বছরের ১৩ জানুয়ারি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু এর পরেও ব্যাংকটির পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বছর যাবৎ ফারমার্স ব্যাংকে তীব্র তারল্য সঙ্কট রয়েছে। বর্তমানে এ সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ব্যাংকের মূল তারল্য পরিমাপক সূচক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যাংকটি ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। যেমন গত এপ্রিল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ব্যাংকটি একটানা সিআরআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। এ ছাড়া, গত জানুয়ারি থেকে গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি বেশ কয়েক দিন এসএলআর সংরক্ষণেও ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতে এ সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করার আশঙ্কা করছে স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংক।

ক্রমাগত নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থ (সিআরআর) বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দণ্ডসুদ ও জরিমানা বাবদ ৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যাংকটির কাছ থেকে আদায় করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরো ১১ কোটি ৩১ লাখ টাকা আদায় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অর্থাৎ গত এক বছরে ব্যাংকটির ওপর আরোপিত দণ্ডসুদ ও জরিমানার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
ব্যাংকটির পরিচালনায় যথাযথ নিয়মাচার অনুসরণ না করায় আয়ের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত বছরের জুনের পর থেকে একমাত্র গত ডিসেম্বর ত্রৈমাসিক ছাড়া ব্যাংকটি ক্রমাগত লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। গত জুন প্রান্তিকে ব্যাংকটির নিট লোকসানের পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকটির মোট ৫৪টি শাখার মধ্যে ২৮টিই লোকসানে পরিচালিত হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যাংকটির মোট শাখার ৫০ শতাংশের বেশিই লোকসানি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নিয়মের বাইরে বেশি ঋণ দিয়ে এসব ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকটি। ফলে ব্যাংকটিতে বড় ধরনের তারল্য সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এ দিকে, এখন আর আমানত সংগ্রহে সাড়া পাচ্ছে না ফারমার্স ব্যাংক। গত সেপ্টেম্বর শেষে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশই খেলাপি। মার্চ-জুন সময়ে ব্যাংকটি খেলাপি গ্রাহকদের থেকে মাত্র ৭ কোটি টাকা আদায় করেছে। শীর্ষ ১০ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই ব্যাংকটির পাওনা ১৩৪ কোটি টাকা।
জানা গেছে, সম্প্রতি তারল্য সঙ্কটে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা আমানত চেয়ে চিঠি দিয়ে কোনো সাড়া পায়নি ব্যাংকটি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপোর মাধ্যমে ৯৬ কোটি টাকা জোগান দেয় ব্যাংকটিকে। এর পরও গত বৃহস্পতিবার নিয়মমতো বাংলাদেশ ব্যাংকে সিআরআর ও এসএলআরের অর্থ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। এর আগে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ব্যাংকটিতে রাখা তাদের মেয়াদোত্তীর্ণ আমানত সুদাসলে তুলতে গেলে কয়েক দফায় চেক ডিজঅনার হয়। ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করেছিল ফারমার্স ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রেস বিজ্ঞপ্তি
দ্য ফারমার্স ব্যাংক সম্পর্কে গত রাতে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, দ্য ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডে বেশ কিছু দিন ধরে তারল্য ঘাটতি বিরাজ করায় এবং আর্থিক সূচকগুলোর অবনতি ঘটায় জনগণের মধ্যে দ্বিধা/সঙ্কোচ তৈরি হয়। লক্ষ করা যাচ্ছে, বেশ কিছু আমানতকারী ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলনের চেষ্টা করার ফলে ব্যাংকটির সমস্যা ঘনীভূত হচ্ছে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসার পর প্রয়োজনীয় রেগুলেটরি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী পরিচালক পদ হতে পদত্যাগ করেছেন। তাদের পদত্যাগপত্র ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। ইতোমধ্যে পর্ষদে নতুন চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। একই সাথে নির্বাহী কমিটি, অডিট কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি পুনর্গঠিত হয়েছে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ লঙ্ঘনের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পুনর্গঠিত পর্ষদ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নে সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন মর্মে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন।
এমতাবস্থায়, ব্যাংকের সম্মানিত আমানতকারী এবং আন্তঃব্যাংক লেনদেনে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষকে সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার জন্য আহ্বান করা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকটির ওপর নজরদারি অব্যাহত রাখছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/272057