২৮ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:০৯

কারাগারে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দী

৬৮ কারাগারে ৭৯ হাজার বন্দী ডিএমপি অ্যাক্টে গ্রেফতারের হিড়িক

কাশিমপুরের একমাত্র মহিলা কারাগারসহ দেশের ৬৮ কারাগারে এই মুহূর্তে বন্দীর সংখ্যা ৭৯ হাজার ছাড়িয়েছে। ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি বন্দী অবস্থান করায় থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসাসহ দারুণ সঙ্কট বিরাজ করছে। কারা অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী শুধু কেরানীগঞ্জের নতুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই আট হাজারের বেশি বন্দী রয়েছে।

এদিকে আদালত ও কারাগার সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকায় ৫৪ ধারায় গ্রেফতারের সংখ্যা কমে গেলেও ডিএমপি অধ্যাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২০-২২ জন গ্রেফতার করে থানা পুলিশ আদালতে পাঠাচ্ছে। অনেকেই জরিমানা দিয়ে মুক্তি পাচ্ছে। তবে যারা জরিমানার টাকা দিতে পারছে না, তাদের পাঠানো হচ্ছে কারাগারে। কারাগারে স্বজনরা অভিযোগ করছেন, আটক বন্দীদের কাছে বাজারমূল্যের চেয়েও বেশি দামে খাবার বিক্রি করা হচ্ছে। এতে গরিব বন্দীর স্বজনেরা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।
কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৬৮ কারাগারে বন্দীর ক্যাপাসিটি রয়েছে ৩৬ হাজার ৬১৪ জন। তার মধ্যে পুরুষ বন্দী ৩৪ হাজার ৯৪০ জন আর মহিলা বন্দীর সংখ্যা এক হাজার ৬৭৪ জন। কিন্তু বর্তমানে কারাগারে বন্দী অবস্থান করছে ৭৯ হাজার ২৮০ জন। তার মধ্যে হাজতি বন্দী (পুরুষ) ৫৯ হাজার ১৮৪ জন ও হাজতি মহিলা বন্দী আছে দুই হাজার ৩৯৪ জন। অপর দিকে সাজাপ্রাপ্ত বন্দী (পুরুষ) ১৭ হাজার ১০৪ জন ও মহিলার সংখ্যা ৫৯৮ জন।

গত রোববার কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে দেখা যায়, ছোট্ট সাক্ষাৎ কক্ষের ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ প্রধান সড়ক থেকেও শোনা যাচ্ছিল। কেউ কারো কথা ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। এর আগে মোবাইল জমা রেখে স্বজনরা ফ্রি স্লিপ কেটে আধঘণ্টার সময় নিয়ে সাক্ষাৎ কক্ষে প্রবেশ করছেন। কারাক্যান্টিনের বাইরের পাশেই পিসির অ্যাকাউন্টের টাকা জমা নেয়া হচ্ছে। লাইন ধরে স্বজনরা বন্দীর কাছে টাকা পাঠাচ্ছে। কারা গোয়েন্দাদের সাক্ষাৎ কক্ষের গেটের সামনে ও কেউ মোবাইল নিয়ে সাক্ষাৎ কক্ষে প্রবেশ করছেন কি না সেটি নজরদারি করতে দেখা যায়। অনেকে স্পেশাল ভাবে (মুখোমুখি) দেখা করতে চাইলেও সেটি হবে না বলে কারারক্ষীরা জানিয়ে দিচ্ছেন।

কারাগারের সার্বিক অবস্থা প্রসঙ্গে স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্তব্যরত একজন সাবইন্সপেক্টর নয়া দিগন্তকে বলেন, এই মুহূর্তে কারাগারে কোনো ধরনের অনিয়ম নাই। সবকিছু কন্ট্রোলের মধ্যে আছে। তবে ভেতরের কারাক্যান্টিনে খাবারের মূল্য কিছুটা বেশি নেয়া হচ্ছে বলে শুনেছি। তা ছাড়া জামিনে মুক্তি পাওয়া আসামিসহ কোথাও আমি কোনো সমস্যা দেখছি না। তারপরও যদি কোনো অনিয়ম থেকে থাকে তাহলে সেটি বন্দীর স্বজনেরা ভালো বলতে পারবেন।
সাক্ষাৎ কক্ষ থেকে দেখা করে বের হচ্ছিলেন এক বৃদ্ধা। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার ছেলেকে কমলাপুর স্টেশন থেকে পুলিশ ১৫ দিন আগে ধরেছিল। খোঁজ নিয়ে মাদকাসক্ত ছেলের সাথে দেখা করেছি আজ। ছেলে কী বললÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ও বলল ভেতরে যে নাশতা ও খাবার দেয়া হচ্ছে সেটিতে সমস্যা আছে। সকাল বেলা একটা পাতলা রুটি খালি দেয়। তারপরও ছেলের কাছে ৩০০ টাকা দিয়ে এলাম। সে বলেছে ভেতরের ক্যান্টিন থেকে কিছু কিনে খাবে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার মাদক মামলার আসামির স্বজন ফয়জুল ও তার সাথের মহিলারা এ প্রতিবেদককে বলেন, কারাগারের ভেতরেতো কষ্ট হবেই। ফয়জুল বলেন, শত্রুতা করে তার সন্তানের বিরুদ্ধে গাঁজার মামলা দিয়েছে। শনিবার আমদানি সেলে ছিল। আজ দেখা হয়েছে। তাকে বাইরে থেকে চিঁড়া ও এক প্যাকেট হলিউড সিগারেট কিনে দিয়ে এলাম। টাকা নিয়েছে ১৭৫ টাকা। বাইরে এক প্যাকেট হলিউড সিগারেটের দাম ৪৫-৫০ টাকা। আর চিঁড়া এক কেজির দাম ৪০-৪৫ টাকা। কিন্তু তারা দ্বিগুণ দাম রাখল। কী আর করব! বাইরে থেকে তো কেউ কোনো খাবার কিনে দিলে সেটি কারারক্ষীরা ভেতরে নিতে দিচ্ছে না।
কারাগারের অনিয়ম সম্পর্কে সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য মিলেছে খিলক্ষেত থানা এলাকার এক আসামির স্বজনের কাছ থেকে। ওই স্বজন তার নাম না জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর উকিলকে বেশি টাকা দিয়েই যদি ছেলে দুটারে ছাড়িয়ে নিতাম তাহলে অনেক শান্তি পেতাম। কারণ আমার মামলায় এ পর্যন্ত উকিলের পেছনে যদি এক লাখ টাকা খরচ হয়ে থাকে সেই তুলনায় এক মাসের ব্যবধানে কারাগারে আসার পর কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়ে গেল। এখানে ভেতরে দফায় দফায় টাকা পাঠাতে বলে। কারারক্ষীরা ফোন করে বলেÑ আপনার ছেলে যোগাযোগ করতে বলেছে। আমরা এখন অস্থির হয়ে পড়েছি। তেল, সাবান আর আরামে থাকা, খাওয়াসহ সব মিলিয়ে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। এই হলো অবস্থা। তিনি এও বলেন, কারাগারের বাইরে আপনারা কোনো অনিয়ম খুঁজে পাবেন না। যা হচ্ছে সবই ভেতরে। ওই যে (সাক্ষাৎ কক্ষের সামনে) ছাতার নিচে দেখছেন কারারক্ষী, যান নগদ টাকা ভেতরে পাঠাতে চাইলে তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। আপনার লোকের কাছে মুহূর্তে টাকা পৌঁছে যাবে। শুধু তারা কমিশন রেখে দেবে।
গত রোববার দুপুরে এসব অনিয়মের ব্যাপারে জানতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোন ধরেননি। পরে তাকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে বন্দীর সংখ্যা কত জানতে চাওয়া হলে সেটিরও কোনো উত্তর দেননি তিনি। যদিও তার দফতরের বাইরে একটি স্লোগান লেখা রয়েছে। সেটি হচ্ছে, ‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত’। উল্লেখ্য গত রোববার দুপুরের দিকে ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন তৌহিদুল ইসলাম কারাগারের সর্বশেষ অবস্থা পরিদর্শনে যান।

আমাদের আদালত প্রতিবেদক মো: শহীদুল্লাহ মিঞা গত তিন-চার মাসের পুলিশের গ্রেফতারের পরিসংখ্যান দিয়ে জানান, এ সময়ের মধ্যে ৫৪ ধারায় মাত্র একজন গ্রেফতার হয়েছে। ১৮ নভেম্বর ঢাকায় নাগরিক সমাবেশে এসে জাহেদ আলী নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী আটক হয়। ৫৪ ধারায় তাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়। শাহবাগ থানার জিডি নম্বর ১১৭৯। এ ছাড়া বেশির ভাগই ‘ডিএমপি অ্যাক্টে’ গ্রেফতার হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিদিন গড়ে ১৮-২০ জনকে বিভিন্ন থানা থেকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। আর এই ধারায় যারা গ্রেফতার হচ্ছে তারা জরিমানা দিয়েই সাথে সাথে ছাড়া পাচ্ছে। যারা জরিমানা দিতে পারে না তাদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/272039