২৮ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৫৫

শতফুল ফুটতে দাও

বাংলাদেশ-মিয়ানমার ব্যবস্থাপত্র নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচল

গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে Arrangement on Return of Displaced Persons from Rakhine State স্বাক্ষরিত হয়েছে। কূটনীতিতে লিখিত দলিল স্বাক্ষরে যেসব পরিভাষা ব্যবহৃত হয়, সেগুলো আমাদের অনেকের কাছেই বহুল পরিচিত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সমঝোতা স্মারক, সম্মতি ও চুক্তি। কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রে এগুলোর কোনোটিই ব্যবহৃত হয়নি। ব্যবহৃত হয়েছে Arrangement বা ব্যবস্থা। সাধারণ কূটনৈতিক ভাষায় যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর পালনীয়তার শর্ত সমান নয়। তারপরও এগুলোর পরিবর্তে বা এগুলোর সম্পর্কে দু’পক্ষের মধ্যে মিল না হওয়ায় ভিন্ন একটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যা হল Arrangement. বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে Arrangement-এর শক্তি কতটুকু তা বুঝতে হলে আমাদের বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মহলে এ সম্পর্কে যা ব্যক্ত হয়েছে তাকে মিশ্র প্রতিক্রিয়াই বলতে হবে।

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে, যাদের বেশিরভাগই মুসলমান, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে তাদের বিতাড়নের জন্য চরম অমানবিক প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে। এ প্রক্রিয়াকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল জাতিগত নিধন ও গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এই নিধন প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে তথাকথিত ‘আরসা’ নামক একটি জঙ্গি সংগঠনের কার্যকলাপকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ‘আরসার’ অস্তিত্ব রয়েছে কিনা অথবা রোহিঙ্গা বিতাড়নকে সিদ্ধ করার জন্য এর অজুহাত টানা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে বাংলাদেশের জনমনে যথেষ্ট সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এই সংশয় অমূলক নয়। কারণ ১৯৭৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে, হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য করা হয়েছে।

জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গারা চরমভাবে নিগৃহীত। মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ১৩৬টি জাতিসত্তার মধ্যে রোহিঙ্গারা স্বীকৃতি পায়নি। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক জাতিসত্তা চরম বিদ্রোহাত্মক কর্মকাণ্ড চালালেও তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত জাতিসত্তা। সেই তুলনায় খুবই নিরীহ, দরিদ্র ও বঞ্চিত রোহিঙ্গারা হয়ে পড়েছে শাসকগোষ্ঠী ও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের চক্ষুশূল। আমরা জানতাম সর্বজীবে দয়া করাই হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের মূল চেতনা। কিন্তু মিয়ানমারে প্রতিষ্ঠিত থারভেডা বৌদ্ধ গোষ্ঠী চরম হিংসাশ্রয়ী। তারা বিশ্বাস করে মিয়ানমারে তারা ছাড়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, বিশেষ করে মুসলমানদের থাকার কোনো অধিকার নেই। এ ধরনের চরম জাত্যাভিমানসম্পন্ন মনোভাব মানবতার মূল্যবোধবিরোধী। কী কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের থারভেডা বৌদ্ধদের চরম ঘৃণার পাত্রে পরিণত হল সেটি জাতি মনস্তত্ত্বের গভীর গবেষণার বিষয়।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, ১৯৮২ সালের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। অন্যদিকে তারা বাংলাদেশেরও নাগরিক নয়। অর্থাৎ তারা হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রহীন বা Stateless। পৃথিবীতে কোনো জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। রাষ্ট্রহীন মানুষরা মর্যাদাহীন ও পরিচয়হীন হয়ে পড়ে। একই কারণে মানুষ হিসেবে তারা রাষ্ট্র থেকে কোনোরকম নিরাপত্তা পায় না। এমনকি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়, সেসবও তারা দাবি করতে পারে না। মিয়ানমারের ভেতরে ও বাইরে ৩০-৪০ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। সুষ্ঠু কোনো আদমশুমারি হয় না বলে তাদের প্রকৃত সংখ্যাও জানা যায় না। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যেগুলোর লোকসংখ্যা এর চেয়েও কম। মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলে মানতে চায় না। তারা বলে এরা মুসলমান বাঙালি। নবম শতাব্দী থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে রোহিঙ্গারা আরাকানে বসবাস করে আসছে। মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর অদ্ভুত বক্তব্য হল, এরা সবাই ১৮২৪ সালের পর মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করেছে। মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী যে বছরটিকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের বছর বলে চিহ্নিত করে সেই বছর থেকেও বহু প্রজন্মের রোহিঙ্গার জন্ম হয়েছে। নাগরিকত্ব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইন বলে, যে শিশুটির জন্ম যে দেশে সেই শিশুটি সেদেশেরই নাগরিক। এমনকি কোনো শিশুর জন্ম যদি একটি দেশের বিমানের মধ্যে হয়ে যায়, সেই কারণেও শিশুটি সেদেশের নাগরিক হওয়ার অধিকার রাখে। অথচ সামরিকতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত বেয়াড়া রাষ্ট্র মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিতে চায় না। এর আগেও আমি যুগান্তরে রোহিঙ্গা জাতির দীর্ঘদিনের ইতিহাস সম্পর্কে লিখেছি। সেই ইতিহাস প্রমাণ করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরই নাগরিক। একজন নাগরিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে যেসব অধিকার পায়, রোহিঙ্গারাও মিয়ানমার রাষ্ট্রের কাছ থেকে সেসব অধিকার পাওয়ার যোগ্য।

কথা আছে, একটি খারাপ চুক্তির চাইতে কোনোরূপ চুক্তি না হওয়াই শ্রেয়। কিন্তু প্রতিপাদ্য ক্ষেত্রে চুক্তি হয়নি, হয়েছে Arrangement বা ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় যৎসামান্য হলেও যে অর্জনটি হয়েছে তা হল- মিয়ানমার কর্তৃক একটি সমস্যা যে বিদ্যমান তার স্বীকৃতি, এটি যে ভাষায়ই বলা হোক না কেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘আমাদের স্বার্থ কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়নি বা বাধাপ্রাপ্ত হয়নি ... আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মুসলমানদের ফেরত পাঠানো এবং আমরা মিয়ানমারকে রাজি করাতে পেরেছি তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে।’ এই Arrangement-এর অনেক সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে কবে নাগাদ রোহিঙ্গারা ফেরত যাবে তার কোনো উল্লেখ না থাকা এবং তারা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবে কিনা সেই প্রশ্নটিও উঠেছে। অভিজ্ঞতায় বলে, নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না থাকার ফলে মিয়ানমার রোহিঙ্গা বিতাড়নে দায়-দায়িত্বহীন আচরণের সুযোগ পেয়েছে। Arrangement অনুযায়ী, ‘উভয় দেশ সম্মত হয়েছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দুই মাসের মধ্যে শুরু করতে এবং এটি যুক্তিসঙ্গত সময়ে সম্পন্ন করা হবে।’ ‘যুক্তিসঙ্গত সময়’ কথাটি অস্পষ্ট হলেও একেবারে অনর্থক বলা যাবে কি? আন্তর্জাতিক মহল এ সমস্যার গভীরতা, ব্যাপকতা ও নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে সচেতনতার যে পরিচয় দিয়েছে এবং তার ফলে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা অগ্রাহ্য করা মিয়ানমারের পক্ষে কঠিন হবে। অনেকে মনে করেন, চীনের সাহায্য নিয়ে মিয়ানমার আবার নিভৃতচারী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পিছপা হবে না। বিভিন্ন পাশ্চাত্য শক্তির প্রতিক্রিয়া দেখে, বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রতিক্রিয়া থেকে আঁচ করা যায়, মিয়ানমার যতটুকু মুক্তদ্বার নীতি গ্রহণ করেছে, তা থেকে তাকে পশ্চাৎমুখী হওয়ার সুযোগ দেয়া হবে না। মিয়ানমারের প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনও তার জাতীয় স্বার্থেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক তা চায় না। সে কারণেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফর করে মিয়ানমার যাওয়ার পর পুরো পরিস্থিতিতে একটি নাটকীয় মোড় পরিবর্তন আমরা লক্ষ করলাম। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের কাছ থেকে একটি কাগজ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেন। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা ধরে দরকষাকষি চলল। শেষ পর্যন্ত একটি কাগজ পাওয়া গেল। কাগজটির নাম সমঝোতা স্মারক নয়, মতৈক্য নয়, চুক্তিও নয়; কাগজটির নাম হল- Arrangement. Arrangement কথাটি সাধারণভাবে কূটনৈতিক দলিলে ব্যবহৃত হয় না। তদসত্ত্বেও শব্দটি একেবারে তাৎপর্যহীন নয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে একটি ব্যবস্থা হবে। সেই ব্যবস্থার পথনকশা তৈরির জন্য যৌথ কর্মসম্পাদন কমিটিও হবে।

বড় উদ্বেগের বিষয় হল, কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে? এক্ষেত্রে বড় বাধা হল রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই কর দেয়া, সহায়-সম্পদ ধ্বংস করা। ওরা আরাকানে ফিরে গিয়ে কোথায় আশ্রয় নেবে? অস্থায়ী শিবিরের কথা উঠেছে। তবে অস্থায়ী শিবিরের জীবনও রোহিঙ্গাদের কাম্য নয়। তাই দ্রুত নিজস্ব আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। একটি সংবাদে পড়লাম, চীন ও ভারত এজন্য Pre-Fabricated ঘরবাড়ি তৈরি করে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। রোহিঙ্গাদের অসন্তুষ্ট রাখা এবং আরাকান রাজ্যে অস্থিতিশীলতা বজায় রাখা চীন বা ভারত কারোরই স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থের অনুকূল নয়। এ কারণেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আশঙ্কার চেয়ে কম সময়ে সম্পন্ন হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মিয়ানমারের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি আদায় করা। এ লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশকে অনেক কাজ করতে হবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা যে হাজার বছর ধরে মিয়ানমারের নাগরিক এই ঐতিহাসিক সত্যটি তথ্য-প্রমাণের আলোকে বিশ্বসভায় তুলে ধরতে হবে। মিয়ানমার যেসব দেশের কথা শোনে, তাদের কাছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটি যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য অপর একটি চ্যালেঞ্জ হল, যারা এ দেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের আরাকানে ফিরে যেতে রাজি করানো। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বের মর্যাদা লাভ করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সম্মতি অর্জন সহজ হবে না। এমনকি সম্ভবও হবে না। যদি সবকিছু ভালোয় ভালোয় এবং সময়মতো শেষ হয়, তারপরও একটি বড় দুঃখ বাংলাদেশের মানুষের মনে থাকবে- যদি রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী নিধনের জন্য যারা দায়ী তারা শাস্তি এড়িয়ে যায়। এ ক্ষত বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি অব্যাহত কালো ছায়া বিস্তার করে চলবে। সমস্যাটির টেকসই সমাধান হলে হয়তো কালক্রমে বাংলাদেশিরাও এই দুঃখ ভুলে যেতে পারে। কারণ কথায় বলে, Time is the best healer. অনেক দুঃখ এবং অনেক কষ্টের মধ্যেও আমরা প্রতিটি প্রতিবেশীকে প্রতিবেশীর মতোই পেতে চাই। বাংলাদেশের সেই সদিচ্ছা কারও অজানা নয়।

ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

https://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/11/28/175548