২৮ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৫৪

৭ই মার্চের ভাষণ ও আনন্দ শোভাযাত্রা

গত ২৫ নভেম্বর রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারী-বেসরকারী স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একটি আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা তথা ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় সরকারী উদ্যোগে এই আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই শোভাযাত্রায় যাতে সরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এনজিওগুলো অংশগ্রহণ করে সে জন্য মন্ত্রিপরিষদ ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহ থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়। এই নির্দেশনা অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, রাজনৈতিক কর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এতে অংশগ্রহণ করেন। মিছিলটি ছিল বিশাল ও বর্ণাঢ্য। ঢাকা মহানগরীতে মিছিল শেষে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য রাখেন। সরকারী দল সরকারীভাবে শোভাযাত্রা ও সমাবেশের ব্যবস্থা করায় মেট্রোপলিটন পুলিশের তরফ থেকে অনুমতি প্রদান অথবা শর্ত আরোপের প্রশ্ন উঠেনি। তবে সমাবেশ আয়োজনে সরকারী যন্ত্র ব্যবহৃত হওয়ায় সরকারী কোপানলে পড়ার ভয়ে এমন বহু ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকেও এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে যারা বা যাদের আওয়ামী ঘরানার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয় না। ফলে রেসকোর্স ময়দান বা সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে আগত জনতার দলীয় বিভাজন খুবই কঠিন বলে মনে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরকারী কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী এতে ঢাকাতেই প্রায় ১৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সারাদেশে খরচের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান একজন অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে রেসকোর্স ময়দানে তার ভাষণটিও ছিল অসাধারণ সন্দেহ নেই।

১লা মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দেন। এতে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এইদিন শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরি পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ৩ মার্চ হরতাল পালিত হবার পর শেখ মুজিবুর রহমান অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি দাবি জানান। এরপর ৭ই মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে তিনি ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” তিনি আরো ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো।” রেসকোর্সের এই জনসভায় আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম। তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান এবং ইয়াহিয়া খান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তার ডাকে পালিত অসহযোগ সারা দেশকে অচল করে তুলেছিল।
৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ভাষণটি জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমদের রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্ররণা। ইউনেস্কোর একটি ম্যানডেট আছে। এই ম্যান্ডেট অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের অন্যকোন দেশের নেতার (যেমন মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাহাথির মোহাম্মদ, আব্রাহাম লিংকন অথবা মাও সেতুং, নেপোলিয়ান বোনা পার্টি, স্টালিটন অথবা অন্য কেউ) বক্তৃতা কিংবা কোনও নবী-রাসূল (সা.)-এর ভাষণকে (যেমন রাসূল (সা:)-এর বিদায় হজ্বের ভাষণ) বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছে কিনা আমি জানি না। তারা যদি ৭ই মার্চের ভাষণের জন্য শেখ মুজিবকে সম্মানিত করে থাকে তাহলে বাংলাদেশ এজন্য গর্বিত। ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী সকল ভাষণকে তাদের এই স্বীকৃতি দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
পর্যবেক্ষক মহলে আনন্দ শোভাযাত্রা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা চলছে। সরকারী উদ্যোগে যে শোভাযাত্রা ও মহাসমাবেশ হয়েছে তার পেছনে ব্যয়িত অর্থ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন জনগণের অর্থ অপচয় করে এই আয়োজন প্রকৃত অর্থে অর্থহীনই। যে দেশে এই দুর্মূল্যের বাজারে মানুষ চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনতে ব্যর্থ, চিকিৎসা খরচ নির্বাহ করতে পারে না, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খায়, সে দেশে অর্থের অপচয় কোনও যুক্তিতেই স্বীকার করে নেয়া যায় না। বক্তৃতার স্বীকৃতির জন্য আনন্দ-উচ্ছ্বাস কোনও ফল বয়ে আনতে পারে না। ৭ই মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান তার সংগ্রামকে মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি মানুষকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেছেন। এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু মানুষ কি স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে? তারা কি স্বৈরাচার ও আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছে? যদি না পায় তাহলে আনন্দ শোভাযাত্রা অর্থহীন।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘ইন্নাল মোবাজ্জেরিনা কানু ইখওয়ানুস শায়তোয়ান’। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। অপচয় কল্যাণ ডেকে আনে না। শোভাযাত্রা এবং সমাবেশ সেদিন যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

ষাটের দশকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে (দক্ষিণ গেটে) প্রতিদিন বিকেলে আবদুল নামক একজন হেকিম বক্তৃতা করতেন। তিনি একজন ভাল বক্তা ছিলেন। তার বক্তব্যে মুসলিম জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য ফুটে উঠতো এবং তিনি একজন ভাল বিশ্লেষকও ছিলেন। আমি তার একজন নিয়মিত স্রোতা ছিলাম। একদিন তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের উপর বক্তব্য রাখলেন। স্রোতারা তার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করলেন, মুঘল সাম্রাজ্যের পতন কেন হলো আপনারা কি বলতে পারেন। উত্তর তিনি নিজেই দেয়া শুরু করলেন। বললেন, বেগম অসুস্থ, সাহেব তার শিয়রে বসে মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তোমার জন্য কি করতে পারি? বেগম বললেন, তুমি কি আমার ইচ্ছা পূরণ করবে? সাহেব কথা দিলেন। বেগম বললেন, আমার কবরের উপর এমন একটা ঘর করবে যা দুনিয়ার সেরা ঘর হয়, বাস্ বেগম মারা যাবার পর সে ঘর তৈরি হলো। বিশ হাজার লোক ২২ বছর পরিশ্রম করে সারা দুনিয়া থেকে হীরা, জহরত এনে সজ্জিত করে এই ঘর তৈরি করা হলো এবং তার নাম দেয়া হলো ‘তাজমহল’। মুঘল সম্রাট শাহ্জাহান তার স্ত্রী মমতাজ মহলের কবরের উপর এই সৌধ তৈরি করেছিলেন। দরিদ্র প্রজাদের খাজনার অর্থ থেকে এর খরচ যোগান দেয়া হয়েছিল। প্রজারা অভুক্ত থেকে খাজনা পরিশোধ করেছে। তারা রোগের চিকিৎসা পায়নি। এ কারণেই রাষ্ট্র জনগণের অর্থ নিয়ে সতর্ক থাকা ভাল।

 

http://www.dailysangram.com/post/309291