২৭ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:১২

ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁস করেও ধরা পড়ে না কেউ

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর (পিইসি) শেষ পরীক্ষা গণিতেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। আগেই ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গণিত প্রশ্নের সঙ্গে গতকাল রবিবার অনুষ্ঠিত মূল পরীক্ষার প্রশ্নের প্রায় হুবহু মিল পাওয়া গেছে।
কিন্তু ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে প্রশ্ন বিক্রি করা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন।
প্রতিটি পরীক্ষার আগের রাতে ও পরীক্ষার দিন সকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ করে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ ও ব্যক্তিগত নামে খোলা আইডি থেকে এই প্রশ্ন দেওয়া হয়। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে বেশ কয়েকটি পেজ, আইডি ও মোবাইল ফোন নম্বর শনাক্ত করা গেছে, যেখানে পরীক্ষার প্রশ্ন দেওয়ার পাশাপাশি ফলাফল বদলে দেওয়ার ‘কাজ করা হয়’ বলেও ঘোষণা আছে। গত শুক্রবার এ নিয়ে কালের কণ্ঠে বিস্তারিত প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। তখন প্রশাসনসহ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নেবেন বলে জানিয়েছিলেন। তবে গতকাল পিইসি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেও এ বিষয়ে পুলিশ প্রশাসন বা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো তত্পরতা লক্ষ করা যায়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রশ্ন ফাঁসকারী শনাক্ত করে দেওয়া ও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার তথ্যও পাওয়া গেছে। এর পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

গত বৃহস্পতিবার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামালের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেছিলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন ফাঁসের কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি।
’ গতকাল সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় ফোন করলে তিনি একটা মিটিংয়ে আছেন বলে জানিয়ে পরে ফোন দিতে বলেন। কিন্তু রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি।
পরীক্ষায় জালিয়াতি এবং সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করেন এমন তিনজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা হয় কালের কণ্ঠ’র। তাঁদের মধ্যে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষায় জালিয়াতি প্রতিরোধে গঠিত মনিটরিং কমিটির সদস্য। তিনি বলেছিলেন, তাঁরা মাধ্যমিক বা উচ্চতর পর্যায়ে এ ধরনের জালিয়াতি প্রতিরোধে কাজ করেন। প্রাথমিক পরীক্ষার ব্যাপারে তাঁদের কোনো
তত্পরতা নেই। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কখনো তাঁদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। এমনকি ব্যক্তি উদ্যোগে কোনো অভিযোগও তাঁরা পাননি।

একই রকম তথ্য জানান পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) মোল্লা নজরুল ইসলাম এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপকমিশনার (ডিসি) মো. আলিমুজ্জামান।
তবে গতকাল ‘ফুড সেফটি অথরিটি’র যুগ্ম সচিব মাহবুব কবির মিলন তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, তিনি নিজে একটি ফেসবুক পেজে প্রশ্ন ফাঁসকারীকে শনাক্ত করে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে প্রশ্ন বিক্রি চলছে। অথচ কোনো প্রতিকার নেই। তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, প্রকাশনার আইনসহ অনেক আইনে এর প্রতিকার করা যায়। বিষয়টি এখন এমন হয়ে গেছে যে এটি কোনো অপরাধই না। ’
‘অপরাধ করে ব্যবসা করছে একদল, আর সন্তানরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে এ চিন্তা থেকে একশ্রেণির অভিভাবকও ছুটছেন তাদের কাছে’—এমন মন্তব্য করে মাহবুব কবির প্রশ্ন রাখেন, ‘এতে বাচ্চারা কী শিখছে? আর প্রশাসনের অবস্থা কোথায় দাঁড়াচ্ছে?’

প্রশ্ন ফাঁসকারী একটি চক্রকে শনাক্ত করে ডিসি প্রাথমিক শিক্ষাকে জানিয়েছিলেন মাহবুব কবির। বললেন, ‘শুনেছি তিনি জিডি করেছেন। লোকেট (স্থান শনাক্ত) করা গেছে। আর কী হয়েছে, জানি না। ’
অন্য একটি সূত্র জানায়, শনাক্ত হওয়া পেজটির নাম ‘পিএসসি জেএসসি এসএসসি হেল্প সেন্টার’। এই পেজে আসিফ হুদা আকরাম নামে ০১৭৫০৬০৫৭৭৬ মোবাইল ফোন নম্বরে ঘোষণা দিয়ে পিইসি পরীক্ষার প্রশ্ন বিক্রি করে। গতকাল পর্যন্ত নম্বরটি চালু দেখা যায়। ওই পেজে পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তন করে দেওয়ারও বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে। সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হয়েছেন, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে ওই মোবাইল ফোনটি ব্যবহার হচ্ছে।
গতকাল প্রাথমিক শিক্ষা অধিপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়নি।

অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ নাজমুল আলমের কাছে গতকাল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে মন্ত্রণালয়েরই কাজ। আমরা তাদের সহায়তা করব। তবে কেউ যদি থানায় মামলা বা জিডি করে তবে পুলিশের সেই বিভাগ অবশ্যই তদন্ত করবে। ’

শনাক্ত হওয়া চক্রটির ব্যাপারে স্থানীয় থানায় জিডি হয়েছে কি না, মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে সৈয়দপুর থানার ওসি শাহজাহান পাশা বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কারো কোনো জিডি বা অভিযোগের ব্যাপারে আমার জানা নেই। ’
গত ১৯ নভেম্বর পিইসি ও ইবতেদায়ি পরীক্ষা শুরুর দিন থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। গত শুক্রবার কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ফেসবুকের যেসব আইডি থেকে প্রশ্ন দেওয়া হয়, সেসব আইডির নামও দেওয়া হয়।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে, ‘পিএসসি গণিত প্রশ্ন এই মাত্র পেলাম’, ‘পিএসসি এক্সাম কোয়েশ্চেনস ২০১৭’, ‘পিএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ২০১৭’, ‘পিএসসি জেএসসি এসএসসি এইচএসসি ডিগ্রি অনার্স মাস্টার্স অ্যাডমিশন টেস্ট বিসিএস জব কোয়েশ্চেনস আউট’, ‘পিএসসি জেএসসি এসএসসি এইচএসসি কোয়েশ্চেনস সাজেশন অল বোর্ড এক্সামিন ২০১৭+২০১৯+২০+২১বিডি’এবং ‘পিএসসি জেএসসি এসএসসি এইচএসসি অল ঢাকা বোর্ড কোয়েশ্চেনস ২০১৭’সহ কয়েকটি পেজে প্রশ্ন ফাঁস করে বিক্রির বিজ্ঞাপন ও প্রশ্ন দেখা যায়। একইভাবে নোমান ইসলাম, রাকিব হাসান, সামিরা খান, অলি জামিল, সাব্বির ভাই, এম.ডি মোশাররফ, সাদা এ্যাপ্রন, মেঘ বালক, এন কে নাহিদ হাসান, অরিন খান, খন্দকার রিজভি আলম, হিমু আহমেদ, এমডি রবিন সরকার, আনুয়ারুল হকসহ বেশ কয়েকটি আইডি থেকে গণিত প্রশ্নপত্র বিক্রির ঘোষণা দিতে দেখা যায়।

গত শনিবার একটি অনলাইন পত্রিকায় ‘প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার রবিবারের গণিত প্রশ্ন অনলাইনে!’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে গণিত পরীক্ষার প্রশ্নও দেওয়া হয়। সে প্রশ্নের সঙ্গে মূল পরীক্ষার প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া যায়। এ ছাড়া ‘সাকিরুল ইসলাম’, ‘মাহসান’ ‘সানজিদা আক্তার’ নামের বিভিন্ন ফেসবুক আইডি থেকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রশ্নেরও অধিকাংশই মিল পাওয়া গেছে মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/11/27/570524