২৬ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:৩১

১৫ লাখ টন পুরনো আলুর কী হবে

আলু নিয়ে বড় ধরনের বিপাকে পড়েছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। মৌসুম শেষ হতে চললেও হিমাগারে সংরক্ষিত আলু বিক্রি শেষ করতে পারছেন না তারা। অন্যদিকে নতুন মৌসুমের আলু উঠতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় উদ্বৃত্ত ১৫ লাখ টন আলুর কী হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা দিন দিন আরও বাড়ছে। পুরনো আলুর দাম কমেই চলেছে। এখন উৎপাদন খরচও উঠছে না। হিমাগারে সংরক্ষিত পুরনো আলু এখন এই কৃষকদের গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে। হিমাগার মালিকরা বলছেন, কৃষকরা আলু না তুললে তা শেষ পর্যন্ত ফেলে দিতে হবে। কারণ এবার আলু রফতানিতেও মন্দা চলছে।

 

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আলু নিয়ে সরকার কোনো উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে আলুর চাষ কমে যাবে। কারণ কৃষকরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। তখন সরকারকেই বিপাকে পড়তে হবে। এমনকি আমদানি করতে হবে। আলু চাষি ও ব্যবসায়ীরা যাতে ব্যাপক লোকসানের মুখে না পড়েন, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা সরাসরি আলু রফতানি, দেশে আলুর ব্যবহার ও প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, তাহলে কৃষকের এই লোকসান কমানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে রফতানিযোগ্য জাত উদ্ভাবন করে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।

 

অন্যান্য বছরে মৌসুমের শেষভাগে আলুর দাম বাড়ে। কিন্তু এবার উৎপাদন বেশি থাকায় বাজারে সরবরাহ বেশি। এতে আলুর দাম দিন দিন কমছে। দেশের বাজারে গত কয়েক মাস ধরে বেশির ভাগ সবজির দর অনেক বেশি। কিন্তু পুরনো আলুর কেজি ২০ টাকা। এখন শীতের সবজির দাম কমতে থাকায় আলুর দাম কমে কেজি ১৫/১৬ টাকায় নেমেছে।

 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ সমকালকে বলেন, চাহিদার চেয়েও দেশে আলুর উৎপাদন বাড়ছে। কৃষকরা পছন্দসই ফসলই আবাদ করছে। এ ক্ষেত্রে আলু উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। তবে আলু উৎপাদনে আলাদা প্রণোদনা দেওয়া হয় না। তিনি বলেন, দেশে উৎপাদিত আলুর বিদেশে চাহিদা কম থাকায় রফতানি সীমিত। রফতানি উপযোগী জাতের আলু উৎপাদনে গবেষণা করা হচ্ছে। গবেষণা থেকে ওই জাতের আলু ও চাষ পদ্ধতি চিহ্নিত হলে কৃষকদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া হবে। তখন আলু ব্যাপকভাবে রফতানি করা যাবে।

 

আলু উৎপাদন : ফলন ভালো হওয়ায় প্রতি বছর দেশে আলুর উৎপাদন বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে আলুর উৎপাদন ১৪ লাখ টন বেড়ে এবার ১ কোটি টন হয়েছে। দেশে প্রতি বছর ৮০ লাখ টন আলুর চাহিদা আছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এ হিসাবে গত পাঁচ বছর ধরে চাহিদার উদ্বৃত্ত আলু উৎপাদন হচ্ছে।


কৃষি মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, হিমাগারে ৫৩ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা হলেও এ পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ আলু কম দামে বিক্রি করা হয়েছে। এখন ২৯ লাখ টন অবিক্রীত আলু থেকে ১০ লাখ টন বীজ বের হবে। বাকি ১৯ লাখ টন আলু থেকে মৌসুমের আগে ৪ লাখ টন বিক্রি হতে পারে। এর পরও ১৫ লাখ টন অবিক্রীত থাকবে। এই আলু ফেলে দেওয়া ছাড়া কৃষকদের আর কোনো উপায় থাকবে না। প্রতি বস্তা আলু ১৪০০ টাকা হিসাবে প্রায় ২ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা নিশ্চিত লোকসান হবে।

একই দরে সংরক্ষণ করা ৩৮ লাখ টন আলু ৭০০ টাকা বস্তা হিসেবে বিক্রিতে প্রায় ৩ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এতে কৃষকদের মোট লোকসান হচ্ছে ৫ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। হিমাগার মালিকদের দেওয়া ঋণ, ভাড়াসহ সব মিলিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হবে। অ্যাসোসিয়েশনের সুপারিশে বলা হয়, আলুর ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য ত্রাণকার্য, কাবিখা, ভিজিএফ ও ভিজিডি কার্ড এবং ওএমএসে সরকারিভাবে আলু বিতরণ করা হোক। তাহলে আলু চাষি ও ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও রক্ষা পাবেন। এ সংকট সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি ও মনিটরিং সেল গঠনের দাবি জানিয়ে অ্যাসোসিয়েশনের চিঠিতে আরও বলা হয়, আলুর ঋণ পুনঃতফসিল করে সময়সীমা বাড়াতে হবে। পদক্ষেপ নিতে হবে আলু রফতানি বাড়াতে।

কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, চলতি মাসের শুরুতে ৮ থেকে ৯ টাকা কেজিতে হিমাগারে রাখা পুরনো আলু বিক্রি হয়। এখন তা ৫ থেকে ৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশে আলুর দামের এই অবস্থার মধ্যে ভারত থেকে চোরাই পথে আসা নতুন আলু ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত ১৬ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারত থেকে অবৈধ পথে আলুর চোরাচালান বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন তারা। তিনি বলেন, এবার কৃষক ও ক্ষুদ্র আলু ব্যবসায়ীরা ঋণের টাকা ও হিমাগারের আলু সংরক্ষণ ভাড়া পরিশোধ করতে পারবেন না। এ সমস্যার সমাধান না হলে কৃষকরা আলু চাষে নিরুৎসাহিত হবেন। তখন সরকারকেই বিপাকে পড়তে হবে।


রফতানি : বর্তমানে আলু রফতানির চিত্র মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। আলু রফতানি অর্ধেকে নেমেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে আলু রফতানি থেকে আয় হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আলু রফতানিতে আয় হয়েছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, আলু সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় মালয়েশিয়ায়। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ব্রুনেই, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। আলু রফতানিতে সরকার কয়েক বছর ধরে ২০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দিয়েছিল। ২০১৬ সালে তা কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এখন আবার নগদ সহায়তা ২০ শতাংশ করা হয়েছে।

আলু রফতানিকারক সমিতির সভাপতি শেখ আবদুল কাদের সমকালকে বলেন, দৃষ্টির অগোচরে অপরিকল্পিত ও অদক্ষভাবে আলু উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা উপযোগী জাতের অভাবে আলু রফতানিতে পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে লাখ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকছে। এই আলু যাতে ফেলে দিয়ে নষ্ট করতে না হয়, এ জন্য তিনটি পরামর্শ দেন তিনি। প্রথমত, প্রচলিত পুরাতন জাতের গ্রানুলা ও ডায়মন্ডের পরিবর্তে রফতানি উপযোগী জাতের আলু চাষ বাড়ানো জরুরি। দ্বিতীয়ত, দেশে আলু খাওয়া বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, প্রক্রিয়াজাতকরণ বাড়াতে হবে।


আবদুল কাদের আরও বলেন, আলুর মান ভালো না হওয়ায় ভারত, পাকিস্তান, মিসরসহ অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে রফতানিতে পেরে উঠছে না বাংলাদেশ। বড় বাজার ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া ও ভিয়েতনামে আলু রফতানি বন্ধ আছে। এ ছাড়া আফ্রিকার দেশগুলোতে প্রচুর রফতানির সম্ভাবনা আছে। এসব দেশে রফতানি বাড়ানো সম্ভব হলে বিলিয়ন ডলারের বেশি আলু রফতানিতে আয় করা সম্ভব হবে।

 

http://samakal.com/economics/article/17111641