২৬ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:২০

চরম সংকটে নতুন বীমা কোম্পানি

আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি * নিজেদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মিথ্যা প্রলোভনে গ্রাহক বাড়াচ্ছে * বেপরোয়া অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা চালাচ্ছে মালিক পক্ষ

চরম সংকটে পড়েছে দেশের নতুন বীমা কোম্পানিগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলোতে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ইতিমধ্যে এসব কোম্পানির অ্যাকাউন্ট (হিসাব) নেতিবাচক হয়েছে। ফলে ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়েছে কোম্পানিগুলো। কয়েকটি কোম্পানি নামেই টিকে আছে। ভেতরে একেবারে ফাঁকা। এরপর মালিকের অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা তো রয়েছেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় বীমা কোম্পানির সংখ্যা বেশি। তাই নিজেদের মধ্যে তীব্র অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে মিথ্যা প্রলোভনে গ্রাহক বাড়ানোর প্রতিযোগিতাও করছে। সামগ্রিকভাবে যা বীমা খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শেষ পর্যন্ত এসব কোম্পানি টিকে থাকবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। আর জনবলের অভাবে এসব কোম্পানির ওপর নজরদারি করতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ)। এ খাতে যে হারে অনিয়ম হচ্ছে, সে তুলনায় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। যা বীমা কোম্পানিগুলোকে আরও বেপরোয়া করে তুলছে। এরপরও আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আরও নতুন বীমা কোম্পানির জন্য তদবির করছেন কেউ কেউ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাস্তবতা আমলে না নিয়ে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় কোম্পানি অনুমোদন দেয়ার কারণে এ খাত আরও বিশৃঙ্খল হয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ৫০ গুণ বেশি। কিন্তু দেশটিতে বীমা কোম্পানির সংখ্যা মাত্র ১৫টি। বিপরীতে বাংলাদেশে ৭৮টি কোম্পানি কাজ করছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নতুন কোম্পানি অনুমোদনের আগে বিবেচনায় নেয়া উচিত ছিল, আরও কোম্পানির প্রয়োজন আছে কিনা। এছাড়া আগের কোম্পানিগুলো ভালোভাবে কাজ করছে কিনা সেটাও বিবেচ্য বিষয়। তিনি বলেন, প্রয়োজনের বাইরে কোনো কাজ করলে সেখানে বিশৃঙ্খলা হবেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতাও বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে কোম্পানিগুলো স্বেচ্ছাচারিতা চালাবে।

জানা গেছে, বাজারের চাহিদা এবং সব পক্ষের সুপারিশ ও পরামর্শ উপেক্ষা করে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৩-১৪ সালে ১৬টি বীমা কোম্পানির অনুমোদন দেয় সরকার। বতর্মানে এর সবগুলোই সংকটে। এর মধ্যে বেশি সংকটে ৭টি নতুন কোম্পানি। কোম্পানিগুলো পরিচালন ব্যয় মেটাতে গ্রাহকের সঞ্চয়ের টাকার বড় একটি অংশ খরচ করে ফেলেছে। তাই ঝুঁকিতে রয়েছেন এসব কোম্পানির গ্রাহক। আর্থিক সংকটে এসব কোম্পানি কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। নতুন কোম্পানিগুলোকে আর্থিকভাবে লাভজনক হতে বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকার প্রিমিয়াম আয় করতে হয়। কিন্তু এসব কোম্পানি গড়ে ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা আয় করছে এবং আয়ের তুলনায় তাদের ব্যয় হচ্ছে বেশি। এ কারণে ঝুঁকি বেড়েছে। সর্বশেষ বেসরকারি বীমা কোম্পানির লাইসেন্স দেয়া হয় ২০১৩ সালে। তখন সাধারণ ও জীবন বীমার ১৩ কোম্পানি অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই জীবন বীমা। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশের উদ্যোক্তা ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি ও তাদের ঘনিষ্ঠজন। অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলোকে ৩ বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে আসার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ১৬টি বীমা কোম্পানি অনুমোদন পায়। ২০১৫ সালের জুলাইয়ের মধ্যে সেগুলোর শেয়ারবাজারে আসার সময়সীমা শেষ হয়েছে। কিন্তু কোনো কোম্পানিই এ পর্যন্ত আসতে পারেনি। কারণ শেয়ারবাজারে আসতে হলে প্রতিষ্ঠানকে পরপর ৩ বছর লাভজনক হতে হয়। কিন্তু মুনাফায় আসা দূরের কথা, গ্রাহকের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে কোম্পানিগুলো।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সদস্য গকুল চাঁদ দাস যুগান্তরকে বলেন, স্বীকার করতে আপত্তি নেই যে, নতুন বীমা কোম্পানির অবস্থা খারাপ। কারণ এটি প্রতিযোগিতার বাজার। এখানে সক্ষমতা দিয়ে টিকে থাকতে হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে এসব কোম্পানিকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বীমা খাতে দীর্ঘদিন এক ধরনের আস্থার সংকটতো রয়েছেই। এর কারণ হল এ খাতের ইতিবাচক দিকগুলো প্রচার হয় না। কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম নজরদারির জন্য আইডিআরএ সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের জনবল সীমিত। বর্তমানে আইডিআএর কার্যালয়ে মাত্র ৩৪ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। আর ৪৬টি সাধারণ বীমা কোম্পানির জন্য মাত্র ১ জন কর্মকর্তা কাজ করছেন। তবে জনবল বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।

নতুন অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২০১৬ সালে ১৮ কোটি ৩ লাখ টাকার ব্যবসা করেছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করেছে ১৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ফলে নেতিবাচক হয়ে পড়েছে কোম্পানিটির তহবিল। এছাড়া যমুনা লাইফের ১০ কোটি ৫২ লাখ টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় ১০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এনআরবি গ্লোবাল লাইফের ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। স্বদেশ লাইফের ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বিপরীতে ব্যয় ৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ও প্রটেক্টিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৫ কোটি ১১ লাখ টাকা আয়ের বিপরীতে ২০১৬ সালে ব্যয় করেছে ৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

বীমা খাতের মালিক পক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, কিছু কোম্পানির অবস্থা খারাপ। কারণ এটি প্রতিযোগিতার বাজার। এছাড়া এ খাতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। তবে কোম্পানিগুলো তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠছে। আইডিআরএ তাদের সহায়তা করছে। তিনি আরও বলেন, বীমা খাতে এক সময় আস্থার সংকট ছিল। বর্তমানে তা কেটে যাচ্ছে। কারণ বেশ কিছু কোম্পানি বড় বড় দাবি পূরণ করেছে। এটি ইতিবাচক দিক।

আইডিআরএ সূত্র জানায়, দেশের ৭৮টি বীমা কোম্পানির মধ্যে জীবন বীমা ৩০টি ও সাধারণ বীমা ৪৮টি। দুই খাত মিলিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৪৬টি। বর্তমানে এ খাতে সম্পদের পরিমাণ ৩৫ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জীবন বীমায় ২৯ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা ও সাধারণ বীমায় ৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। তবে প্রতারণার কারণে বিশাল এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। ২০১০ সালে নতুন বীমা আইন হওয়ার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/11/26/174831%E0%A6%A8%E0%A6%BF