২৬ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:০৩

কক্সবাজার থেকে বালুখালী পানবাজার

চলতে ফিরতে দেখা

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী


২১ নভেম্বর। সকালের ফ্লাইটে সাড়ে ১০টার মধ্যে কক্সবাজার পৌঁছে গেলাম। এরপর বালুখালীর দিকে যাত্রা। প্রধান উদ্দেশ্য বাংলাদেশে এত বড় বিপর্যয় স্বচক্ষে খানিকটা দেখা। আর তা মোকাবেলার জন্য সেখানে যে কর্মযজ্ঞ চলছে, সে সম্পর্কে অবহিত হওয়া। কোনো সন্দেহ নেই, চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও দূরদৃষ্টিহীন পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ এই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু বিপদ এসেই গেছে। আমরা বরং তাকে আরো বহু গুণ বাড়ানোর জন্য সীমান্ত খুলে রেখেছি। যত খুশি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীর লোক আসে আসুক। আমরা বলেছি, তাদের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা করে খাবো। আমরা চরম বন্ধুহীন। আমাদের পরম বন্ধু ভারত, চীন, রাশিয়া সবাই একযোগে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী নিধনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ অসহায়। একা। পথের মাঝখানে দৃষ্টিবিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে আছে। এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হতো না, যদি আমরা যথাসময়ে কূটনৈতিক শোরগোল তুলতে পারতাম, যদি মিয়ানমার সীমান্ত সিল করে দিতে পারতাম। তার কোনোটাই আমরা করিনি। মিয়ানমার আমাদের শত্রু ছিল না, ৭ লাখ লোককে নতুন করে বাংলাদেশের ভেতরে ঠেলে দেয়ার পরও সরকার মিয়ানমারকে অবিরাম তোয়াজ করে যাচ্ছে। আর জনগণকে কেবলই বোঝাতে চাইছে, শিগগিরই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু দেশী-বিদেশী কূটনীতিকেরা এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো মনে করে না যে, রোহিঙ্গা সঙ্কটের আশু সমাধান আছে। সরকার নাগরিকদের কেবলই বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। এমনকি ভারত একেবারে নির্লজ্জভাবে যখন মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে; প্রথম সরকারপ্রধান হিসেবে মোদি সু চিকে সাহস দিতে মিয়ানমারে ছুটে গেছেন; তখন আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি। ভারতীয় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান আশ্রয় নিয়ে আছে এবং আশ্চর্যের ঘটনা, ভারত তাদেরকে স্বদেশে দেয়ার বদলে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছে। তখনো আমরা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখেছিই।

এই যে ব্যর্থতা, এটাকে সাফল্য হিসেবে দেখানোর জন্য সরকারের সে কী নির্লজ্জ কোশেশ! তারা কেবলই বলছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত আসন্ন। শিগগিরই মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নেয়া শুরু করবে। এ এক আকাশ-কুসুম কল্পনা। অথচ আমরা যদি শুরুতেই সীমান্তে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারতাম, যুদ্ধ নয়, সীমান্ত সুরক্ষা করতে পারতাম, তাহলে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ হয়তো এই পর্যায়ে পৌঁছতে পারত না। হয়তো তার আগেই বিশ্বসমাজ আরো বেশি সরব হয়ে উঠত। ভারত, চীন, রাশিয়াকেও সেই হত্যাযজ্ঞ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হতো না। দেখলে দেখত, আমাদের কোনো দায় ছিল না। এখন সব দায় আমাদের। কক্সবাজারের উখিয়া এলাকায় নতুন করে যে ৭ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে, তাদের খাবার-দাবারই প্রধান সমস্যা নয়, প্রধান সমস্যা প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষা, প্রধান সমস্যা বন-বিনাশের আশঙ্কা। শুধু তা-ই নয়, এখানে বর্তমান পরিস্থিতিতে গড়ে উঠবে নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠন। অস্ত্র আর মাদকের চোরাচালান বাড়বে, দেহব্যবসায়ের মতো অসামাজিক কার্যকলাপে একসময়ে ব্যাপক আকার ধারণ করবে। সন্ত্রাস স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হবে। সে দিন সম্ভবত খুব বেশি দূরে নয়।
আমরা বলেছি, মানবিক কারণে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। এ কথা ঠিক এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যার হাত থেকে রক্ষার দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের নয়। এ দায়িত্ব ছিল গোটা বিশ্বের। বিশ্বের যারা মোড়ল, তাদের যে বিশাল দায়িত্ব রয়েছে সে কথা তারা যেন ভুলেই গেছে। আমরা এক দুর্বার বোঝা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সরকার নিজেকে নানা অভিধায় চিহ্নিত করছে। কক্সবাজার থেকে উখিয়া যাওয়ার পথে তার প্রমাণ পেলাম। প্রতি কিলোমিটারে ৮-১০টা করে ব্যানার রাস্তার এপার ওপার টানিয়ে দেয়া হয়েছে। এক পাশে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, অপর পাশে শেখ হাসিনার ছবি, আদর করে দিচ্ছেন হয়তো কোনো রোহিঙ্গা শিশুকে। মাঝখানে ইংরেজিতে লেখা ‘এইচপিএম শেখ হাসিনা, মাদার অব হিউম্যানিটি’। এই একই ব্যানার সারা পথজুড়ে। কিন্তু এখন সরকার বলছে, এই বোঝা বাংলাদেশের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। অনেক দেশই দুই-চার টন করে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে। বেশির ভাগ সহায়তাই দিচ্ছে বাংলাদেশের অতিথিবৎসল মানুষ। শেখ হাসিনা মাদার অব হিউম্যানিটি, বুঝলাম কিন্তু কোনো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ইংরেজি লেখাপাড়ায় শিক্ষিত নয়। তারা এই ব্যানার দেখে শেখ মুজিবুর রহমান আর শেখ হাসিনার ছবি ছাড়া কিছুই বুঝতে পারবে বলে মনে হলো না। কিন্তু আমি নিজেও যা বুঝলাম না, তা হলো শেখ হাসিনা নামের আগে যে, এইচপিএম কথাটি লেখা আছে, তার মানে কী? আমার সঙ্গে গাড়িতে যারা ছিলেন, তাদের কাছে জানতে চাইলাম এইচপিএম কী? তারাও বললেন, জানেন না। জনে জনে তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না। কিন্তু এইচপিএম কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে রইল।

কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প বা কুতুপালংয়ের দূরত্ব ৫০ কিলোমিটারের বেশি। কিন্তু ১০-১২ কিলোমিটার আগে থেকে এক ভিন্ন দৃশ্য চোখে পড়ল। আসলে সেখানে গেলে কে রোহিঙ্গা কে রোহিঙ্গা নয়, এটা চিনে নিতে খুব বেশি কষ্ট হয় না। ময়লা-নোংরা কাপড়, ভগ্নস্বাস্থ্য, চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ, কোলে ও দু’হাতে ধরা তিন-চারজন করে শিশু। দেখলেই বোঝা যায়, এরাই রোহিঙ্গা। তারা রীতিমতো কাজ শুরু করে দিয়েছে। টেম্পোর ড্রাইভার বা হেলপার, চা দোকানের কর্মচারী, মজুর প্রভৃতি কাজে তারা ইতোমধ্যে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশ মানিকগঞ্জ ও রাজশাহী থেকে তাদের কাউকে কাউকে আটক করে আবার ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। যারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, তারা বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে গেছে তুলনামূলক উন্নত জীবনে। সরকার যদিও বলছে, রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারবে না, রোহিঙ্গারা কোনো কাজে জড়াতে পারবে না, কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের কেউ বিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু এর সবই বাতকে বাত। ১০ লাখ লোককে হয়তো বন্দিশিবিরে আটকে রাখা সম্ভব। কিন্তু স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা রোহিঙ্গাদের আটকে রাখা অসম্ভব।

আগে সেখানে সেনাবাহিনীর যে কড়াকড়ি ছিল, এখন আর তা নেই। আমার তো মনে হলো টেম্পো বা বাসে চড়ে তারা চলে যেতে পারবে দূর-দূরান্তে। কেউ হয়তো ফেরাবে না। এখন রোহিঙ্গাদের চেয়ে বরং বেশি সমস্যা হয়েছে স্থানীয় বাংলাদেশীদের। তারা বাজার থেকে ১০ কেজি চাল কিনে নিয়ে যেতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পথে তাদের আটকে দিচ্ছে, বলছেÑ তুমি রোহিঙ্গা। ত্রাণের চাল বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছ। তখন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বাররা এসে তাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, রোহিঙ্গারা ত্রাণসামগ্রী বিক্রি করছে। বিক্রির কারণও আছে। একজন যদি ত্রাণ হিসেবে ২০ কেজি ডাল পেয়ে থাকে, অমন ঝুপড়ির ভেতরে চাল-ডাল সে রাখবে কোথায়? এগুলো বাজারে বিক্রি করে তরিতরকারি পেঁয়াজ নুন কিনছে। এটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ তারা জানে, আবারো ত্রাণ পাবে। ফলে ওই এলাকায় শাকসবজির দাম চার থেকে পাঁচ গুণ হয়ে গেছে। যে এক আঁটি লাল শাকের দাম ছিল ৫ টাকা সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। রোহিঙ্গারা কিনতে পারছে, কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারাই এখন পুষ্টি সঙ্কটে পড়েছে। এলাকায় সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। পথে দেখলাম, বনের গাছ কেটে মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে কোনো রোহিঙ্গা পুরুষ বা নারী, কোলে সন্তান। যত দূর চোখ যায় শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্প, বন উজাড় হয়ে গেছে, এখানে সবুজের চিহ্ন নেই বললেই চলে। গাছ কেটে খুঁটি বানিয়েছে, গাছ কেটে জ্বালানি বানিয়েছে। সবুজ কোথায় পাব। বাংলাদেশী মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। সেটা প্রধানত শহরকেন্দ্রিক। আমরা তাতে অনেকখানি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু গ্রামের ভেতরে পাহাড়ের ওপরে চার পাশে কেবলই বস্তি আর বস্তি গিজগিজে মানুষ। তাদের ছোটাছুটি, চলাফেরা, পানি নেয়াÑ এসব কর্মযজ্ঞ চলছে। কোথাও কোনো ক্যাম্পে নিবন্ধন হচ্ছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ লাইন। সে জীবন মানবেতর।

কুতুপালং পার হয়ে আমরা যাচ্ছি বালুখালীর দিকে। রোহিঙ্গাদের ভিড় বাড়ছে। এলোমেলো চলাফেরায় গাড়ির গতি কমাতে হয়েছে। রেড ক্রিসেন্টের একটি ফিল্ড হাসপাতাল দেখলাম, লোহার গেট বন্ধ। খাঁ খাঁ বিরান। সেখানে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে, এমন মনে হলো না। সঙ্গীদের কাছে জানতে চাইলাম, এই যে এত ছোট শিশু, অসংখ্য গর্ভবতী মা, তাদের চিকিৎসা ও পুষ্টির ব্যবস্থা কী? জানলাম অনেক ছোট ছোট ক্যাম্পে তাদের চিকিৎসা ও ন্যূনতম ওষুধ দেয়া হচ্ছে। অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। তবে সেখানে বড় চিকিৎসা ক্যাম্প সম্ভবত ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর কেন্দ্রটি। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে সেখানে আগত চিকিৎসাপ্রার্থীদের দেয়া হয়েছিল শিশুদের জন্য কেক, মেয়েদের জন্য চাদর আর পুরুষদের জন্য কম্বল। কেন্দ্রটি প্রথমে কেবল একটি নির্মাণাধীন দোতলা দেয়ালবিহীন কাঠামো ছিল। ড্যাব-এর সামনে তাঁবু টানিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে চিকিৎসাসেবা শুরু করে। তখন প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হতো। বিগত ৭০ দিনে তারা প্রায় ২ লাখ শিশু ও নারীকে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধপত্র দিয়েছে।

ভিড় ঠেলে বহু কষ্টে ড্যাবের সেই মেডিক্যাল ক্যাম্পে হাজির হলাম। হাজারে হাজারে নারী ও শিশু চিকিৎসাসেবা নেয়ার অপেক্ষায়। যাদের হাতে কেক ও চাদর তুলে দেয়া হচ্ছিল, তারা বলছিল এর চেয়ে দাওয়াই দাও, আমরা দাওয়াই-এর জন্য এসেছি। ৮-১০ জন তরুণ ডাক্তার ঘার গুঁজে কাজ করছেন। তাদের দেখতেই মনটা ভরে গেল। ভবিষ্যতে যদি তাদের মধ্যে এই সেবার মানসিকতা থাকে, তাহলে আশার আলো নিভবে না। হরেক রকম রোগ, তাদের সমস্যার ভাষা বোঝার জন্য কোথাও কোথাও দোভাষীর ব্যবস্থা আছে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবার, শিশুদের জন্য নানা ধরনের পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান, যথাসম্ভব ওষুধপত্র প্রদান এই কাজ একেবারেই প্রার্থনার মতো করে করছেন চিকিৎসকেরা। প্রত্যেককে দেয়া হয়েছে একটি করে কার্ড। তাতে চিকিৎসার বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। আগে কী চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল, এরপর কী দেয়া হলো সব।

নারীদের বেশির ভাগেরই হাতে ধরা দু-তিনটি শিশু। কোলে একটি, গর্ভেও সন্তান আছে। চমকে উঠেছি! এ কেমন পরিস্থিতি! ড্যাবের মহাসচিব ডা: জাহিদের কাছে জানতে চাইলাম ঘটনা কী? তিনি যা জানালেন, তাতে বিষাদে মন ভেঙে গেল। বললেন, রাখাইনের পরিস্থিতি এমন যে, একটি মেয়ে ১১-১২ বছরের বয়সী হলেই রাখাইন সেনারা প্রতি রাতেই তাদের ধর্ষণ করে। এই ধর্ষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের দ্রুত বিয়ে দেয়া হয় এবং তারা সব সময় গর্ভবতী থাকে, যাতে ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এই পশুদের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা? এই পশুদের পাশে যারা দাঁড়িয়েছে তাদের সম্বোধন করার ভাষা আমার জানা নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/271614