২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১০:২৫

ওয়াক্ফ সম্পত্তি দখল করে অবৈধ ইটভাটা

রগুনার আমতলীতে ওয়াক্ফ এস্টেটের কৃষিজমি জোরপূর্বক দখল করে আবুল বাশার ওরফে নয়ন মৃধা নামের এক ব্যক্তি ইটভাটা নির্মাণ করেছেন। ইটভাটার কারণে এলাকার পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এই ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আবুল বাশার মৃধা আওয়ামী লীগের এক নেতার আত্মীয়। সেই প্রভাব খাটিয়ে জমি দখল ও ইটভাটা করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেও জমি রক্ষা করা যাচ্ছে না। উল্টো তিনি নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এর ৮ ধারা অনুযায়ী কৃষিজমি, আবাসিক এলাকায় ভাটা স্থাপন দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত উপজেলা বা ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়ক থেকে কমপক্ষে আধা কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করাও নিষিদ্ধ। যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৮-এর উপধারা (১)-এর বিধান লঙ্ঘন করে নিষিদ্ধ এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, আবুল বাশার মৃধা ২০১৫ সালে আমতলী সদর ইউনিয়নের সেকান্দারখালী গ্রামে ৫ একর জমিতে জিমি ব্রিকস নামে ইটভাটা নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ওই ভাটার দক্ষিণ পাশে মৃত কাশেম তালুকদারের ওয়াক্ফ এস্টেটের ফসলি জমি রয়েছে। ওই জমির মোতোয়ালি শাহিন তালুকদার ও শহিদ তালুকদার। তাঁরা জমির অংশীদারদের কোনো অনুমতি না নিয়ে ৩২৬ নম্বর খতিয়ানের ২৫ দশমিক ৩৭ একর জমি ২০১৪ সালে দেখাশোনা ও মামলা পরিচালনার জন্যআবুল বাশার মৃধাকে ক্ষমতা অর্পণ করেন। ২০১৬ সালে আবুল বাশার ওয়াক্ফ এস্টেটের অন্য অংশীদারের অনুমতি ছাড়াই ওই জমিতে ইটভাটার সম্প্রসারণ শুরু করেন এবং ইট তৈরির জন্য জমির মাটি কাটেন।

খবর পেয়ে ওয়াক্ফ এস্টেটের উত্তরাধিকারী মৃত মজিবুর রহমান তালুকদারের মেয়ে সাহিদা আক্তার ও ছেলে রূপক তালুকদার বাধা দিতে গেলে মাটি কাটার যন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে তাঁদের পিষে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। পরে পৈতৃক জমি রক্ষায় সাহিদা আক্তার বরগুনা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন বরাবর আবেদন করেন। চেয়ারম্যান বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য জেলা পরিষদের দুজন সদস্যকে দায়িত্ব দেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা পরিষদ সদস্য মনিরুল ইসলাম খান ও শাহিনুর তালুকদার যথানিয়মে চারজন জমি পরিমাপক (সার্ভেয়ার) নিয়ে জমির কাগজপত্র পর্যালোচনা করে জমির মালিক রূপক তালুকদার ও তাঁর বোন সাহিদা আক্তারকে তাঁদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেন। তাঁরা নিজেদের অংশের জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চার রোপণ করেন।
আবুল বাশার মৃধা গত ২৪ অক্টোবর রূপক ও সাহিদার মালিকানাধীন জমির গাছের চারা কেটে ও উপড়ে ফেলে ওই জমি থেকে পুনরায় মাটি কাটতে শুরু করেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁরা বাধা দিলেও তা উপেক্ষা করে মাটি কাটতে থাকেন আবুল বাশার মৃধা ও তাঁর লোকজন। উপায় না পেয়ে সাহিদা আক্তার ৪ নভেম্বর আবুল বাশারকে আসামি করে আমতলী থানায় মামলা করেন।

যোগাযোগ করা শাহিনুর তালুকদার বলেন, ‘জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নির্দেশে আমরা জমির ফয়সালা করে দিই। আবুল বাশার মৃধা সালিসের সিদ্ধান্ত না মেনে সেই জমি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।’
১৮ নভেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, আমতলী-কুয়াকাটা আঞ্চলিক সড়ক ঘেঁষে গড়ে তোলা এই ভাটায় ইট তৈরির জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাকে করে আনা মাটি সড়কের পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ইটভাটার চারপাশে রয়েছে অন্তত ৮০ একর ফসলি জমি ও জনবসতি। ভাটার আগুনের তাপে ওই এলাকার খেতের ফসল ও গাছপালা নষ্ট হচ্ছে।
জানা যায়, ওয়াক্ফ এস্টেটের জমির মাটি কেটে ও ঘর তুলে দখলে নিয়েছেন আবুল কাশেম মৃধা। সাহিদা আক্তার বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে ঢাকায় ওয়াক্ফ প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১২ নভেম্বর ওয়াক্ফ প্রশাসক শহীদুল ইসলাম বরগুনার জেলা প্রশাসককে ইটভাটা বন্ধ ও মাটি খনন বন্ধ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে চিঠি দেন। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বরগুনা জেলা প্রশাসকের পক্ষে আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়ে ১৫ নভেম্বর একটি চিঠি দেওয়া হয়।
সাহিদা আক্তার অভিযোগ করেন, তাঁদের মালিকানাধীন জমি দখল অব্যাহত রেখেছেন আবুল বাশার মৃধা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি বলেন, আবুল বাশার মৃধা প্রভাবশালী, তাই কেউ বাধা দিতে সাহস পাচ্ছে না। এভাবে ইটভাটা চলতে থাকলে এলাকার বাড়িঘর ও ফসলি জমি ধ্বংস হয়ে যাবে।
বরগুনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৬ সালে ‘জিমি ব্রিকস’ নামে এই ভাটাটির লাইসেন্স দেওয়া হয়। তবে ভাটাটির পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আরেফিন ইসলাম বলেন, ‘আমি যতদূর জানি তাতে জিমি ব্রিকসের মালিক পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু এখনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।’
আবুল বাশার মৃধা জমি দখল করে ইটভাটা নির্মাণ করার কথা অস্বীকার করে গত মঙ্গলবার বলেন, ‘আমি যে জমিতে ইটভাটা নির্মাণ করেছি, তা আমার ক্রয় করা। ইটভাটার পাশে কাসেম ওয়াক্ফ এস্টেটের ওই জমি আমাকে শাহিন তালুকদার ও শহিদ তালুকদার দেখাশোনা করার জন্য দিয়েছেন। এ জন্য ওই জমি ইট তৈরির মাটি রাখার কাজে ব্যবহার করছি। সাহিদা ও রূপক তালুকদারের জমি পিলার দিয়ে নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। আমি সে জমি দখল করিনি।’ ইটভাটার বৈধতার বিষয়ে বলেন, ‘আমি আইনের বিষয়ে জানি না। ভাটা করার জন্য প্রশাসনের কাছে লাইসেন্স চেয়েছি। তারা আমাকে লাইসেন্স দিয়েছে। আইনে না থাকলে কীভাবে তা দিল।’
জেলা প্রশাসক মো. মোকলেসুর রহমান বলেন, ওই ভাটাটির ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1372906