২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১০:২২

সমঝোতার পরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধার পাহাড়

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। তবে, ফেরত প্রক্রিয়া কেমন হবে তার বিস্তারিত এখনও ধোঁয়াশার আবর্তে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কতটুকু সফল হবে আর সে লক্ষ্যে কী কী বাধা রয়েছে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা তাদের অভিমত তুলে ধরছেন। ক্রমাগত উদ্বেগ জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে গত তিন মাসে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ৬ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম। এ অভিযানকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ বলে আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ।

এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের তরফে মিয়ানমারকে চাপ দেয়া হচ্ছে এখনও। বাংলাদেশও একই আহ্বান জানিয়ে আসছে। সেই আলোচনার সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার দু’দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা সই হয়। এরপর, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি এক বিবৃতিতে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয়ভাবে কাজ করবে। বাংলাদেশ বরাবরই এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংশ্লিষ্টতা চেয়ে আসছিল। চুক্তি সইয়ের খবর আসার পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের দাবি জানিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, যখন কিনা বাংলাদেশে এখনও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল অব্যাহত রয়েছে তখন এই চুক্তি ‘প্রিম্যাচিওর’। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। ইউএনএইচসিআর বলেছে, তারা এখনও চুক্তির বিস্তারিত হাতে পান নি। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তাদের ভূমিকা কতটুকু থাকবে, বা আদৌ থাকবে কিনা সেটাও নিশ্চিত না সংস্থাটি।

সামনে যেসব বাধা
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতো বিশেষজ্ঞরাও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। উদ্বেগ রয়েছে, এর বাস্তবায়ন খুব সহজ কোনো কাজ হবে না। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে রয়েছে নানান চ্যালেঞ্জ।
১। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে মিয়ানমার। এর মধ্যে অন্যতম হলো- ফেরত যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের দেশটিতে তাদের বাসস্থানের প্রমাণ দেখাতে হবে। এক্ষেত্রে যে ধরনের পরিচয়পত্র বা প্রামাণ্য দলিলাদি চাওয়া হচ্ছে তা বেশির ভাগ রোহিঙ্গাদের কাছেই নেই। দশকের পর দশক ধরে নাগরিকত্বহীন অবস্থায় তারা মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। ফলে, যে পরিচয়পত্র তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে তা বেশির ভাগ রোহিঙ্গাদের কখনও দেয়াই হয় নি। যাদেরও বা কোনো প্রকার পরিচয়পত্র আছে, তারা যখন প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন তখন স্বভাবতই ওই পরিচয়পত্র সঙ্গে আনার সুযোগ পান নি। যদি কেউ এনেও থাকেন সে সংখ্যা আহামরি বেশি নয় বলেই ধারণা করা হয়। সুতরাং, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার এ শর্তে বাদ পড়ে যাবার শঙ্কা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার।

২। বলা হচ্ছে ভলান্টারি রিপ্যাট্রিয়েশন বা সেচ্ছা প্রত্যাবাসনের কথা। কত সংখ্যক রোহিঙ্গা আসলে মিয়ানমারে ফিরে যেতে ইচ্ছুক তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। যে নৃশংসতা তারা মিয়ানমারে ভোগ করে এসেছে, সম্ভাবনা রয়েছে এরপর অনেকে আদৌ আর সেখানে ফিরে যেতে চাইবেন না।
৩। মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হলেইং সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, যে পরিমাণ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাব করেছে, সে পরিমাণ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়া অসম্ভব। এমন বক্তব্যের ফলে সন্দেহ থেকেই যায় যে, পালিয়ে আসা পুরো জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নেবার ইচ্ছা আদৌ মিয়ানমারের আছে কিনা।
৪। মিয়ানমারের সেনাপ্রধান আরো বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের রাখাইনের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মতামত প্রাধান্য দেয়া হবে। যদি তারা এ পদক্ষেপকে সমর্থন করে, তবেই রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরানো হবে। বলা হয়, স্থানীয় বৌদ্ধরাই মিয়ানমারের প্রকৃত নাগরিক। তাদের কাছে অগ্রহণীয় কোনো সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করবে। এখানেও সন্দেহ থেকে যায়। কারণ, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চালানো রোহিঙ্গা নিধন অভিযানে তাদের সঙ্গে অনেক স্থানীয় বৌদ্ধ উগ্রপন্থিরাও যোগ দিয়েছিল- এমন স্পষ্ট প্রমাণ আছে। সে ক্ষেত্রে, যাদের লক্ষই ছিল রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করা, তারাই রোহিঙ্গাদের এখন ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দেবে- তেমন আশা করা কতটা যৌক্তিক তা সহজেই অনুমেয়।

৫। রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ফিরে গেলেও সেখানে রোহিঙ্গারা তাদের ফেলে আসা বসতবাড়ি ফেরত পাবে না। এ প্রসঙ্গে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য ক্যাম্প নির্মাণ করবে। নিজ বাড়িঘর হারিয়ে ক্যাম্প কিংবা পুনর্বাসন শিবিরে বসবাস করতে ইচ্ছুক হবেন কজন রোহিঙ্গা, সেটাও একটা প্রশ্ন। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এ ধরনের পরিকল্পনার ধারণাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থা। সংস্থাটি বলেছে, এ ধরনের শিবিরে রোহিঙ্গাদের কার্যত এক রকম বন্দি করেই রাখা হবে।
৬। অক্টোবরে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা জমিজমার সব ফসল কেটে নিতে বলেছে। আরো বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা পরিত্যক্ত জমিজমা, ভূখণ্ড বাজেয়াপ্ত করবে সরকার। এমতাবস্থায় ঘরবাড়ি, জমিজমা, ফসলাদি- সব কিছু হারিয়ে ফেলা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে কি নাগরিক সুবিধা পাবে সে প্রশ্নও উঠছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের শরণার্থী অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক তাদের জমিজমা ফেরত ও বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ করে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।

৭। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি যদিও বলছেন যে, মিয়নামারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে শান্তিপূর্ণ এবং স্বতঃস্ফূর্ত, কিন্তু সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কারণ, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া কার্যত সে দেশে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের সরকারে সুচির একক কর্তৃত্ব নেই। একদিকে দেশটির স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব তাদের সেনাবাহিনীর। অপরদিকে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর মনোভাব ধোঁয়াশাপূর্ণ।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে হওয়া সমঝোতা একটি অগ্রগতি সন্দেহ নেই। তবে, সন্দেহ নেই, প্রত্যাবাসনের সফলতা নিশ্চিত করতে এসব চ্যালেঞ্জ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। বাংলাদেশ চায় শান্তিপূর্ণভাবে সমঝোতার মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান করতে। সরকারের তরফে সেটা স্পষ্ট করা হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটুকু সফল হয় কূটনৈতিক সমঝোতা।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=93540