২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:৫৮

বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি : ব্যয় বাড়বে জীবনযাত্রার

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে অবশ্যই জনজীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে -বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ : বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্ত -অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ
গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি বিরূপ প্রভাব পড়বে জনজীবনে। এখন থেকে প্রতি মাসে নতুন করে বাড়তি টাকা গুনতে হবে ভোক্তাদের। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনি ব্যবসা বাণিজ্যসহ শিল্পখাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি যৌক্তিক হয়নি। গণশুনানিতে ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষ দাম না বাড়ানোর পক্ষে মত দেন। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের যৌক্তিকতাও প্রমাণিত হয়নি। গত বৃহস্পতিবার বিইআরসি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার পর থেকে সারা দেশেই এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। গ্রাহক শ্রেণি নির্বিশেষে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে গড়ে ৩৫ পয়সা (৫ দশমিক ৩ শতাংশ)। যা আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। তবে বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) দাম বাড়ানো হয়নি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে এ নিয়ে ৮বার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হলো। সব রাজনৈতিক দল বলছে, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি অযৌক্তিক। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এটাকে সামান্য এবং মামুলি ব্যপার বলা হয়েছে। পাশপাশি জনজীবনে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিকে খুবই সামান্য এবং মামুলি ব্যাপার বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই বৃদ্ধির কারণে জনজীবনে কোনো প্রভাব পড়বে না। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, দাম খুব বেশি বাড়ানো হয়নি। ২০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের এখন থেকে মাসে অতিরিক্ত ২০ থেকে ২৫ টাকা বিল দিতে হবে। গ্রাহক পর্যায়ে যে প্রভাব পড়বে তা সহনীয় বলেই মনে করি।
জনগণের রক্ত চুষে খেতে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমলেও লুটপাট করতে আমাদের এখানে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। যেখানে বিদ্যুতের দাম কমানোর কথা সেখানে পূর্বের তুলনায় বাড়ানো হলো। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণাকে তিনি অযৌক্তিক ও গণবিরোধী নয় ভোটারবিহীন সরকারের লুটপাট নীতির বহিঃপ্রকাশ বলেও উল্লেখ করেন। এদিকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে আগামী ৩০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। এ ছাড়া বিভিন্ন ইসলামী দলও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো দেশের শিল্প খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে সরাসরি পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। সেই সাথে পণ্যের দামও বাড়বে। আর সার্বিকভাবে ভুক্তভোগী হবে সাধারণ মানুষ। তাদের বিদ্যুতের বাড়তি দাম যেমন দিতে হবে, তেমনি পণ্যসামগ্রীও কিনতে হবে বাড়তি দামে। ভোগ্যপণ্যের উৎপাদক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রæপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, গ্যাস বিদ্যুতের দাম যতটা বাড়বে, পণ্যের উৎপাদন খরচ ততটাই বাড়বে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে অবশ্যই জনজীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। সীমিত আয়ের লোকের ওপর এর প্রভাব বেশি পড়বে। কারণ গড় হারে বিদ্যুৎ বিল বেশি আসবে। এ ক্ষেত্রে সরকার বিকল্প পদক্ষেপ নিতে পারতো।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার প্রেক্ষাপটে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। তিনি বলেন, রফতানি আয়ে আমরা ক্রমেই বাজার হারাচ্ছি। প্রতিযোগী দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ক্রমেই বাড়ছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ঠিক হলো না। কেননা আমরা এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। এমন সময়ে এ সিদ্ধান্ত নতুন চাপ তৈরি করবে।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সালাম মুর্শেদী আরও বলেন, দাম বৃদ্ধি কোনো বিষয় হত না যদি চাহিদা মত গ্যাস-বিদ্যুৎ পেতাম। যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে তা পূর্ণ প্রেসারে পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুতে লোডশেডিং বাড়ছে। ফলে খরচ বেড়েছে।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে। সেই হিসাবে বিদ্যুতের দাম কমানোর কথা, অথচ বাড়ানো হয়েছে। আর দেশীয় গ্যাস কোম্পানিগুলো লাভের মধ্যে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্ত।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দর কম। সেটার সঙ্গে সমন্বয় করে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা উচিত ছিল। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম নির্ধারণ করা উচিত। তবে ভোক্তাপর্যায়ে যাতে বিরূপ প্রভাব না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দেশে জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেশি। সরকার যদি তেলের দাম কমিয়ে সমন্বয় করে তাহলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না।

তিনি আরও বলেন, বিদ্যুতের সঙ্গে সব খাত জড়িত। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ালে সব কিছুর দাম বেড়ে যায়। এখন চালসহ নিত্য পণ্যের দাম অনেক বেশি। এমন সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব কিছুর মূল্য আরও বেড়ে যাবে।
আর্থসামাজিক খাতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে সিপিডি’র বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, বিদ্যুতের দাম ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকায় ভোক্তা এবং উৎপাদক সবাই কম দামের যে সুবিধা পাচ্ছিলেন, তা হারাবেন। উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় বাড়বে। অভ্যন্তরীণ বাজারের উৎপাদকের পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতায় সক্ষমতার ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আর উৎপাদনের ব্যয় বাড়লে তাও শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই বর্তাবে।

ক্যাব’র জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে বিশ্ববাজারে অব্যাহতভাবে কয়েক বছর ধরে কম থাকলেও সরকার দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমাবে না। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত তেলের দাম কমানো হলেই বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা কমানো সম্ভব। কিন্তু তারা এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে দাম বাড়ানোর প্রতিই বেশি মনোযোগী, যা দুঃখজনক।

উল্লেখ্য, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ভোক্তা পর্যায়ে পাইকারি ও খুচরা মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৮বার বিদ্যুতের দাম বাড়লো। সর্বশেষ ২০১৫ সালে সেপ্টেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। জানা গেছে, ২০১০ সালের ১ মার্চ গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হয় ৫ শতাংশ। ২০১১ সালের ১ ফেব্রæয়ারি পাইকারি ও গ্রাহক দুই পর্যায়েই বাড়ানো হয়। এর মধ্যে পাইকারিতে ১১ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ। একই বছরের ১ আগস্ট পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানো হয় ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এছাড়া সে বছরের ১ ডিসেম্বর পাইকারিতে ১৬ দমমিক ৭৯ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ১৩ ধমিক ২৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। ২০১২ সালে ১ ফেব্রæয়ারি পাইকারি পর্যায়ে ১৪ ধশমিক ৩৭ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ৭ দশমিক শূণ্য ৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এরপর ওই বছররের ১ সেপ্টেম্বর পাইকারি পর্যায়ে ১৬ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ১৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। ২০১৪ সালের ফেব্রæয়ারিতে পাইকারি পর্যায়ে ৬ দমমিক ৯৬ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাইকারি পর্যায়ে ২ দশমিক ৯ শতাংশ দাম বাড়ে।

https://www.dailyinqilab.com/article/105862